সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাজনীতির তিনটি শনির দশা! তারপর বৃহস্পতি!

গোলাম মাওলা রনি

রাজনীতির তিনটি শনির দশা! তারপর বৃহস্পতি!

বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেন বারবার তিনটি শনির দশার আবির্ভাব হয় এবং সেগুলোর পর কেন চতুর্থ দৃশ্যে বৃহস্পতি দেখা যায় তা আমার মাথায় ঢোকে না। আমি নিয়তিতে বিশ্বাস করা একজন সাদামাটা হাবাগোবা মানুষ। জটিল গণনা অর্থাৎ অঙ্ক আমার মাথায় ঢোকে না। বিজ্ঞান নিয়েও আমার দুর্বলতা সীমাহীন। জীববিদ্যা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, মহাকাশবিদ্যা কিংবা পানিবিদ্যার নাম শুনেছি বটে- কিন্তু বিষয়বস্তুর গভীরে  ঢুকতে পারিনি কোনো দিন। ফলে দীন-দুনিয়ার অন্য সব বেহিসাবি বেকুবের মতো আমিও প্রকৃতির বিজ্ঞানকে প্রকৃতির লীলাখেলা ভেবে প্রায়ই আশ্চর্য হই এবং কোনো কিছু না ভেবেই শিশুদের মতো চুষনি অথবা লেবেনচুস পেলেই একেবারে চুপ হয়ে যাই। আমি ভেবে পাই না কেন আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগের পেছনে যমদূত ঘোরাফেরা করে। কেন ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট এবং ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগের জীবনে বিভীষিকা নেমে এসেছিল।

১৯৭৫ সালের ৪৯ বছর পর কেন ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের পতন হলো, আবার ১৯৭৫ সালের ২৯ বছর পর কেন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এলো। ইবনে খালদুনের সেই বিখ্যাত উক্তি- প্রতি ১০০ বছর পর ভূখন্ডের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক আকার পরিবর্তন হয় এবং প্রতি ৫০ বছর পর পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। সেক্ষেত্রে ১৯৭৫, ২০০৪ এবং ২০২৪ সালের সংখ্যাগুলোর যোগফল ৩৬ এবং ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট ও ৫ আগস্টকে যোগ করলে পাওয়া যায় ১৪ সংখ্যা। এখন ৩৬ এবং ১৪ যোগ করলে যে ৫০ সংখ্যা হয় তার সঙ্গে ইবনে খালদুনের তথ্য আমি কীভাবে মেলাব তা ভেবে পাচ্ছি না।

ইবনে খালদুন যেভাবে মাটি-মানুষ রাজ্য রাজা রাজধানী গোত্রপ্রীতি দল গঠন নিয়ে নিখুঁত অঙ্ক কষে অনেক কিছু লিখে গিয়েছেন তদ্রুপ হাজার হাজার বছর আগে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধির সঙ্গে পৃথিবীর রাজনীতির কী সংযোগ রয়েছে তাও অঙ্ক কষে বহু জ্যোতির্বিজ্ঞানী নির্ভুলভাবে বর্ণনা করে  গেছেন। তো সেসব বর্ণনার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতির চতুরঙ্গের কী সংযোগ রয়েছে তা আমি বলতে পারব না- তবে ১৯৫৮ সাল থেকে যদি ২০২৪ সালের বাংলার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনগুলো বিবেচনা করি তবে দেখব যে, অতি দ্রুত পর পর তিনটি দুর্ঘটনা ঘটে। তারপর চতুর্থ ঘটনার মাধ্যমে আগের তিনটি দুর্ঘটনার অপছায়া দূর হয়।

বাংলার ইতিহাসের প্রথম সামরিক শাসন জারি হয় ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর। এই অভূতপূর্ব ঘটনার মাধ্যমে আমরা ত্রাণকর্তা হিসেবে জেনারেল আইয়ুব খানকে পাই। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ সালের সীমাহীন রাজনৈতিক অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা এবং ১৯৫৮ সালের পর পর তিনটি দুর্ঘটনার পর যখন চতুর্থ দৃশ্যে মহানায়ক হিসেবে আইয়ুব খানের আগমন ঘটে তখন মানুষ একবাক্যে স্লোগান তোলে দেশ ভালো পাকিস্তান- নেতা ভালো আইয়ুব খান। তাকে নিয়ে বাঙালির আদিখ্যেতা কী পরিমাণ ছিল তা যদি অনুধাবন করতে চান তবে তিনি যেদিন পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন এবং তৎকালীন রেসকোর্সে জনসভা করেছিলেন সেই জনসভার উপস্থিতি এবং জনগণের মন্তব্য পর্যালোচনা করতে হবে। বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জনসভা হয়েছিল আইয়ুব খানকে বরণ করে নেওয়ার সেই সময়ের রেসকোর্সে। আর জনগণ আইয়ুব খানের চেহারা মোবারক দেখে মন্তব্য করেছিল, রাজা তো এরকমই হওয়া উচিত।

পূর্ববাংলার রাজনীতিতে পর পর তিনটি দুর্ঘটনার পরিণামে আইয়ুব খানের অভ্যুদয় ঘটেছিল যার প্রথমটি ছিল-১৯৫৮ সালের ৩১ মার্চ পূর্ববঙ্গ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের অন্তর্দ্বন্দ্ব-কলহবিবাদ এবং আদমজী জুটমিলে ভয়াবহ শ্রমিক সংঘর্ষের জেরে পূর্ববঙ্গে আতাউর রহমান খানের সরকার এবং কেন্দ্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সরকারের পতন হয়।

দ্বিতীয় ঘটনা ঘটে ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৩ তারিখে। সেদিন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলাকালীন আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক প্রজা পার্টির মধ্যে মারামারি শুরু হলে ডেপুটি স্পিকার সাহেদ আলীকে সংসদের ভিতরে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। তৃতীয় ঘটনা ঘটে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। এরপর ২৭ অক্টোবর চতুর্থ ঘটনার মাধ্যমে আইয়ুব খানকে আমরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসতে দেখি।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের তিনটি দুর্ঘটনার পর কীভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলাম এবং চতুর্থ দৃশ্যে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পেয়েছিলাম সেই কাহিনি সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ছিল ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্লক রেইড, তান্ডব এবং রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ। এরপর দ্বিতীয় দুর্ঘটনা ছিল ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার এবং তৃতীয় দুর্ঘটনা ছিল পাকিস্তান সামরিক জান্তার ২৫ মার্চের কালরাতের ভয়াল দৃশ্য ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা। ২৬ মার্চ সকালে দুনিয়া কাঁপানো সাংবাদিক সাইমন ড্রিং পাকিস্তানি জান্তার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান এবং অপারেশন সার্চলাইট নামক ২৫ মার্চ রাতের ভয়াল গণহত্যার ছবি ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেন। বিশ্বব্যাপী হইচই শুরু হয়ে যায়। পাকিস্তানের সহযোগী একটি দৈনিক পত্রিকার শত অপচেষ্টা এবং জেনারেল নিয়াজির দম্ভ বিফলে যায়। পত্রিকাটি প্রচার করেছিল ওগুলো গণহত্যার ছবি নয়- ’৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের মানবিক বিপর্যয়ের ছবি। অন্যদিকে নিয়াজি বলেছিলেন, ম্যায় ইস হারামজাদে কওম ফি নাসল বদল দুঙ্গা অর্থাৎ আমি এই জারজ জাতির বংশগতি বদলে দেব।

স্বাধীন বাংলায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত পর পর তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমটি ছিল- বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড। তারপর খালেদ মোশাররফ ক্যু ব্যর্থতা এবং নিহত হওয়া এবং জেল হত্যাকান্ড। তিন নম্বর দুর্ঘটনা ছিল ১৯৭৫ সালের ২৪ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা এবং গ্রেপ্তারের নির্দেশ এবং ২৬ নভেম্বর সকাল ৯টায় ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসে জাসদের হামলা এবং রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে জিম্মি করার চেষ্টা।

জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড এবং জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা লাভের আগেও তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমটি ছিল ১৯৮১ সালের মে মাসের ৩০ তারিখে প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যাকান্ড। দ্বিতীয়টি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের হত্যাকান্ড, তৃতীয়টি প্রেসিডেন্ট সাত্তারের ক্ষমতাচ্যুতি এবং চতুর্থ দৃশ্যে এরশাদের ক্ষমতা লাভ। এরশাদের পতন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের ক্ষমতা গ্রহণের আগেও তিনটি দুর্ঘটনা ঘটে। প্রথমটি এরশাদের পদত্যাগ। দ্বিতীয়টি ব্যারিস্টার মওদুদের দায়িত্ব গ্রহণ ও পদত্যাগ এবং তৃতীয় হলো- প্রথম ও দ্বিতীয় ঘটনার আগে ২৭ নভেম্বরের একটি দুর্ঘটনা। ওইদিন ডা. শামসুল আলম মিলনকে হত্যার পর যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাই শেষাবধি এরশাদের পতনকে অনিবার্য করে তোলে।

১৯৯৬ সালে বিএনপির পতনের নেপথ্যেও ছিল তিনটি দুর্ঘটনা। প্রথমটি ছিল ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সংসদ থেকে একযোগে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীর ১৪৭ সংসদ সদস্যের পদত্যাগ। দ্বিতীয় ঘটনা ছিল ১৯৯৫ সালের ২৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া এবং তৃতীয় দুর্ঘটনা ছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন। চতুর্থ দৃশ্যে আমরা পেয়ে যাই বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির মইন উদ্দিন- ফখরুদ্দীনের সরকারের নেপথ্যে ছিল তিনটি দুর্ঘটনা। প্রথমটি ছিল- প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের শপথ গ্রহণ যার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে শুরু হয়- তুমুল আন্দোলন। এ অবস্থায় দ্বিতীয় দুর্ঘটনার সূত্রপাত হয় ২ জানুয়ারি ২০০৭ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য শিডিউল ঘোষণা করা। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত নেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমদ এবং তিন বাহিনী প্রধানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সময় তিনি তিন নম্বর দুর্ঘটনার শিকার হন।  তার নেতৃত্বের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পতন হয় এবং মইন উদ্দিন-ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে সেনাসমর্থিত ১/১১-এর সরকার গঠিত হয়।

আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। রাজনীতির চতুরঙ্গ নিয়ে আমি আর অগ্রসর হব না। অতীতের ধারাবাহিক ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে আপনি ইচ্ছা করলে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখের পূর্ববর্তী অথবা পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা নিয়ে একটি সমীকরণ দাঁড় করাতে পারেন।

 

♦ লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

সর্বশেষ খবর