দিন দিন ভূপৃষ্ঠ গরম হয়ে উঠছে এমন কথা আজকাল রেডিও-টেলিভিশনে প্রায়ই শোনা যায়। একসময় রেডিওতেই শুনতে হতো। সব সরকারি রেডিও সিনেমার গান থেকে শুরু করে সুনীল গাভাস্কারের শতরান করার কাহিনি সবই দেখার কিছু ছিল না সবই ছিল শোনার। কানটা খাড়া রাখলে চলত। ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের সময় আইয়ুব খান তাঁর প্রতিপক্ষকে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কারও দাঁত ভেঙে যায় এমন জবাব কামান বন্দুক বিমান আক্রমণে কীভাবে দেওয়া সম্ভব, তা সে সময় কারও আমলে আসত না। যাই হোক, আজকাল বেসরকারি টেলিভিশনেই সবকিছু সচিত্র দেখানো হয়। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ ধরনের অনুষ্ঠানে গাছে পোকা লাগা থেকে শুরু করে সবকিছু দেখা যায়। এসব দেখে গ্রাম থেকে শহরে আসা বসবাসকারীরা তাদের গাঁও-গেরামের স্মৃতি রোমন্থন করে। রাখাল সেজে গরু ও ছাগল নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার স্মৃতি এখনো অনেককে রোমাঞ্চিত করে। কারও হয়তো মনে পড়ে, বেয়াদব প্রকৃতির একটা ছাগল তার সঙ্গে সহযোগিতা করত না, আজকাল ছাগলটির এই আচরণকে মিডিয়ায় হয়তো কিছুটা বামপন্থি কিংবা সন্ত্রাসী এ ধরনের শব্দ সুষমায় তুলে ধরা হতো। এখনকার টিভির ভাষ্যকার হয়তো ছাগলটির একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারত না। ছাগলটি নিয়ে বড় ধরনের কোনো সমস্যার কারণ উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সেখানে টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধি ক্যামেরা নিয়ে স্পট থেকে স্টুডিওতে সরাসরি রিপোর্ট করার জন্য প্রস্তুতও থাকত। মিডিয়া কভারেজ পেয়ে ছাগলটি হয়তো হিরো বনে যেত। আজকাল কুকুরের দাঁত মাজা নিয়ে টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনও তো হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় আইলা কোন পথ দিয়ে আইল আর গেল, তা বোঝার আগেই উপকূলের ঘরবাড়ি লোনা পানিতে একাকার। সয়লাব হয়ে যাওয়া মাছের ঘের, নগেন মাঝির খেয়াঘাট, নইকাটির নুকো মাহাজনের চাতাল, ঘরদোর সবই। সুন্দরবনের কোলঘেঁষে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যে জনপদ তারা সুন্দরবনের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে বেশ ভালো থাকত ঘূর্ণিঝড়ের সময় সিডরের বড় ধাক্কা সুন্দরবন বুক পেতে নিল, আইলার আঘাতও তার ওপর দিয়েই গেছে; কিন্তু জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর পুরো ক্ষমতা আর ছিল না। নদী দিয়ে সে পানি হঠাৎ অমাবস্যার গোনে (জোয়ারে) লোকালয়ের দুর্বল বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে মাড়িয়ে পাড়িয়ে ফল-ফসলের মাঠঘাট সব তলিয়ে দিয়ে গেল। লবণাক্ত পানি মুহূর্তের মধ্যে পাখিমারা, পদ্মপুকুর, প্রতাপনগর, কয়রা, বেদকাশি, গাবুরা, পাতাখালীর সব পুকুর বিধবা করে দিয়ে গেল। সবই প্রকৃতির বিরূপ আচরণ বলে সবাই পাশ কাটাতে চায় নিজেদের সৃষ্ট সমস্যাকে। মরুশহর, অতি আধুনিক বাণিজ্যিক বিনোদনের শহর, কোটিপতি শেখদের শহর দুবাই কীভাবে পিরোজপুরের বলেশ্বর নদীর লাহান লন্ডভন্ড করে দিল। দোষটা যেন কারও না, ন্যানো টেকনোলজির, কৃত্রিম মেঘের, এমনকি নিরীহ নিরপরাধ ড্রোনের।
আসলে এসবের কারণ হিসেবে পরিবেশবিদরা বলছেন, ভূপৃষ্ঠ গরম হয়ে ওঠার ফল। বেশি গরম হওয়ায় প্রকৃতির মাথা নাকি খারাপ হচ্ছে। হিমালয়ের বরফ গলে নদী পানি গড়াচ্ছে সমুদ্রে, অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলেও সমুদ্রের পানি বাড়ছে। আর ছোটবড় ভূমিকম্পে সমুদ্রের তলদেশের এবড়োখেবড়ো পাহাড়-পর্বত উঁচু হয়ে উঠছে। এসব হঠাৎ ফুলে-ফেঁপে ওঠা, স্থানচ্যুত হওয়া পানি যাবে কোথায়? সুনামি হয়ে জলোচ্ছ্বাস হয়ে ছুটছে জনবসতি ভূস্থলের দিকে। এসব নিয়ে গবেষণা করেন যেসব বিজ্ঞ ব্যক্তি তারা বলছেন, সমুদ্র মেখলা ছোট ছোট অনেক দ্বীপরাষ্ট্র নাকি পানিতে তলিয়ে যাবে। অর্থাৎ পৃথিবীর ৩ ভাগ পানি আর ১ ভাগ স্থলের হারাহারি হিসাবে কিছুটা গরমিল হবে। সে না হয় হলো; কিন্তু ঘন জনবসতির কী হবে? তাদের অনুযোগ পৃথিবী উষ্ণ করছে মানুষ আর তার প্রতিশোধের শিকার কেন হবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য? পরিসংখ্যান ব্যুরো গেল শতাব্দীর সত্তর দশক থেকে সেবারের সিডরের সময় পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, সুন্দরবনের গাছ, পাখ-পাখালির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নাকি মানুষই আত্মসাৎ করেছে।
ইদানীং আবদুলপুরের আদনান সাহেবের মাথায় ঢুকল আরেক চিন্তা, দুশ্চিন্তার পোকা। এমনিতে তার অবসর মাথায় নানান ভাবনা-দুর্ভাবনার পোকারা কিলবিল করছে। তিনি এসব থেকেও মুক্তি যেমন পাচ্ছেন না, তেমনি তাদের কাছ থেকে গঠনমূলক কোনো কাজের ঈপ্সিত হিম্মত ও প্রেরণা পাচ্ছেন না। আদনান সাহেব অনেক আগে একটা মহাজন বাক্য শুনেছিলেন, ‘Idle Brain is Devil’s Workshop’. নানান দুর্ভাবনার অনুপ্রবেশে তার মাথা কি শয়তানের কর্মশালা হয়ে গেল নাকি? তার ছেলেবেলার বন্ধু রমেন, পরে সাইকোলজিস্ট হয়েছে শুনেছি। রমেন বলেছিল, অলস মাথা শয়তানের কর্মশালা হয় যৌবন ও মাঝ বয়সে গো। কেননা সে সময় ব্রেন থাকার কথা সতেজ, সজীব ও সক্রিয়। এ সময় মাথা যদি অলস হয়ে পড়ে, তখন শয়তানের দুষ্টবুদ্ধি খেলার জন্য সেটা তো ভাড়া নেবেই। শয়তান তখন তাকে ভালো গঠনমূলক ও সৃজনশীল চিন্তা-ভাবনা থেকে যত বেশি দূরে রাখতে পারবে শয়তানের তত লাভ। শয়তান এ জাতীয় পটেনশিয়াল ব্রেনকে টার্গেট করে। ‘আজকাল তুমি দেখবা অনেক ভালো ছাত্র হঠাৎ মাথা বিগড়ে ভিন্ন পথে হাঁটছে’ বলে রমেন চলে গেল। আদনান সাহেব তখন সচল-সতেজ যুবক। তার কানে কথাগুলো ধরেছিল তখন। কিন্তু এখন? এখন তো আর তিনি ভেঙেচুরে কিছু করতে পারেন না। তার এখন বিপথে যাওয়ার বয়স নাই। সুতরাং এখন তার মাথায় যেসব ভাবনা-চিন্তারা পান-তামাক-বিড়ি খেতে আসছে তা তো তাকে মানসিকভাবে কষ্ট দেওয়া ছাড়া কিছু না। ঘটনাটা মাত্র মাস পাঁচ-ছয় আগের। ঢাকা থেকে বড় ছেলে আহমদ কবীর জানিয়েছেন তার বড় মেয়ে বিপাশা বিদেশে পড়তে গিয়ে আর দেশে ফিরতে চাচ্ছে না। সেখানেই বিয়েশাদি করে থাকতে চায়। অত্যন্ত মেধাবী বিপাশা কবির স্নাতকে শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল। তারপর কিছুকাল এখানে-সেখানে বড় ও মাঝারি চাকরি করে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমায়। তার উচ্চশিক্ষার পেছনে দেশের বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের বৃত্তি কর্মসূচির আওতায় অর্থ জোগানও দেয়। প্রত্যাশা ছিল উচ্চশিক্ষা লাভ করে দেশে ফিরে সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা ও শিক্ষকতা করবে- নতুন দেশের সমৃদ্ধি সাধনে অবদান রাখবে। সবাই দেশ ছেড়ে চলে গেলে চলবে কেন? আদনান সাহেব ভারত বিভাগ এভাবে হবে ভাবেননি। তাকে কলকাতার বাড়ি হুগলির কোম্পানি আর বর্ধমানের বিশাল জমি ফেলে এভাবে পূর্ববঙ্গে আসতে হবে ভাবতে পারেননি। যে মাটিতে বিপাশার নাড়ি পোঁতা যে প্রতিবেশীদের আদর স্নেহ পেয়ে তার বড় হওয়া সেই মাটির টানে সেসব পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধব সহপাঠীদের কাছে ফিরে এসে তাদের তার মেধা ও দক্ষতালব্ধ জ্ঞান বিতরণ করা কর্তব্য নয় কী? আদনান সাহেব মানুষের এই exodus হওয়ার প্রবণতায় দুঃখ পান এবং এসব কে বড় বেশি করে ভাবেন আজকাল। মানুষ অনবরত জায়গা বদল করছে, চলে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, এক জায়গায় থাকতে চাচ্ছে না। শৈলকুপায় যাদের কাছ থেকে জমি বিনিময় করে পেয়েছেন তারা এ এলাকায় যথেষ্ট অবস্থাপন্ন ও বিশেষ প্রভাবশালী ছিলেন; কিন্তু দেশভাগের কারণে তারাও এখন রিফিউজি তার বর্ধমানের জমিতে। আদনান সাহেব এখানে আর তারা সেখানে হয়ে আছেন বাস্তুহারা রিফিউজি। এটা তো গেল রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার ও ভেদ স্বার্থবাদিতার ফলাফল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও এখন এক দেশের মানুষ আরেক দেশে পাড়ি জমাচ্ছে স্রেফ অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে নিরাপত্তা লাভের আশায়। জাহাজ পাড়ি দিতে গিয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। আদনান সাহেবের মন খারাপ সে কারণে।
কলম্বাস সাহেব জাপানে যেতে চেয়েছিলেন। পথ ভুলে পৌঁছালেন নয়া জঙ্গলে, মার্কিন মুলুকে। তিনি সেখানে না পৌঁছালে আমেরিকার অ্যামাজন মিসিসিপি অববাহিকার মানুষেরা এশিয়া-ইউরোপীয় সভ্যতার সোহবত পেত না- জানি না তারা এত দিন কী পর্যায়ে পৌঁছাত! আদনান সাহেবের মাথায় হঠাৎ এ প্রশ্নও জাগে- আচ্ছা ব্রিটিশরা যদি ভারতবর্ষে না আসত তাহলে আজকের ভারতবর্ষ আজকের অবস্থায় পৌঁছাত কিংবা থাকত কি না। পাল, গুপ্ত, সেন সাম্রাজ্যের দিনকাল পাল্টে গেল সমরখন্দ থেকে আসা মুঘলদের মোড়লিপনায়। ভারতবর্ষ এত দিন মুঘলদের শাসনাধীনে থাকলে কী হতো। রাস্তাঘাট রেললাইন স্টিমার ইউনিভার্সিটি কলেজ এসব কি হতো না? থাকত না? শেরশাহের আমলে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড তো হয়েছিল- টোল, মাদরাসা এসব তো ছিল। ইংরেজ আসাতে বিলেতি জিনিস এসেছে, বিদেশি ভাষা ও শিক্ষা এসেছে, বিদেশি বেলাল্লাপনা এসে ঢুকেছে। হুড়মুড় করে নতুন আমলা মুৎসুদ্দি নতুন নগরায়ণ হয়েছে। ভারতবর্ষে ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান যেমন এসেছে, তেমনি ধর্ম-কর্ম, জীবনযাপন এসব ব্যাপারে নতুন নতুন ভাবধারাও এসে ঘাঁটি গেড়েছে এখানে। দোষ-গুণ সহজাত প্রক্রিয়ায় আসে, আত্মশ্লাঘা ও দোষারোপ করে লাভ নেই। এতে প্রকৃতির প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায় এবং একসময় প্রকৃতিই প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হয়। অন্যায় করে একজন আর শাস্তি ভোগ করে শতজন।
লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান