একজন ড্রাইভার যখন ১৮ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে ২ কোটি টাকা ব্যয়ে আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করেন, তখন গর্বে আমাদের বুকটা ভরে যায়। কিংবা সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কোটিপতি ড্রাইভার আবেদ আলী যখন মাদারীপুর ডাসার উপজেলার চেয়ারম্যান হওয়ার স্বপ্ন দেখে এলাকায় টাকা ছড়ান, তখন মনে হতে পারে এ দেশের লাখ লাখ ড্রাইভার নিশ্চয়ই বেশ ভালো আছেন। আসলে বাংলাদেশের ড্রাইভাররা খুব একটা ভালো নেই। তাদের অধিকাংশের ভাগ্যে এমন সুযোগ মেলে না। এ দেশের সড়কে যে রকম ঝুঁকি ও ঝঞ্ঝাট মোকাবিলা করে ড্রাইভাররা গাড়ি চালান, তাদের দক্ষতাকে অবশ্যই সমীহ করতে হয়। সে তুলনায় তাদের প্রাপ্তি খুবই কম। তারা গড়ে ১৫ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করেন। সেই টাকায় দুর্মূল্যের বাজারে সংসার চালিয়ে তাদের কোনো সঞ্চয় থাকে না। অধিকাংশই ভাড়া বাড়িতে কাটিয়ে দেন জীবনের বিবর্ণ দিনগুলো। তাদের সন্তানের ভালো লেখাপড়া হয় না। নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আসে না। পরিবারের সদস্যদের সাধ-আহ্লাদ পূরণ হয় না। তারপরও নিজেদের আলোকিত সময় বন্ধক রেখে তারাই বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন সারা বাংলাদেশ। মানিকগঞ্জের সিংগাইরের আতিকুর রহমানের মতো ২ কোটি টাকা দিয়ে ডুপ্লেক্স বাড়ি বানানোর সাধ্য তাদের কারোরই হয় না। কারণ, তারা কেউ তো ওবায়দুল কাদেরের মতো দাপুটে মন্ত্রীর বউয়ের গাড়িচালক নন। সেই ওবায়দুল কাদের এখন জান নিয়ে পালিয়ে আছেন। তার বউয়ের ড্রাইভার ২ কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি বানাচ্ছেন সিংগাইরে।
ড্রাইভাররা কিন্তু পালাতে পারেন না। পালিয়ে যাওয়া কোনো ড্রাইভারের ধর্ম নয়। রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটে গেলে উন্মত্ত জনতার হাত থেকে বাঁচতে কেউ কেউ পালান বটে। তবে অধিকাংশ ড্রাইভারই তার গাড়িটি রক্ষা করেন। মালিককে রক্ষা করেন। এমনকি মালিকের সঙ্গে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেন। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর ড্রাইভার আনসার আলীর জীবনও উৎসর্গ হয়েছে তার মালিকের জন্য। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তার ড্রাইভার আনসার আলীও নিখোঁজ হন। এরপর কেটে গেছে ১৪টি বছর। এত দিন নিখোঁজ ছেলের ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়েছিলেন তাঁর মা নূরজাহান বেগম (৬০)। গত ১৭ জানুয়ারি তিনিও চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
নারায়ণগঞ্জের সেভেন মার্ডারের কথা নিশ্চয়ই পাঠকের মনে আছে। সেই সাত খুনের মধ্যে দুজন নিরপরাধ ড্রাইভার ছিলেন। এই খুনের অপরাধীদের সাজা হলেও সেটি কার্যকর হয়নি গত ১০ বছরেও। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় র্যাবের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের গাড়ি থামান। র্যাব তৎকালীন কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র-২ নজরুল ইসলাম, তাঁর বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলমকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। তিনি অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় তাকে ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমকেও র্যাব তুলে নিয়ে যায়। পরে তাদের সবাইকে হত্যা করে ওই রাতেই পেট কেটে এবং ইটের বস্তা বেঁধে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল তাদের লাশ ভেসে ওঠে। র্যাবের সহায়তায় এই নৃশংস হত্যাকান্ডের হোতা সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট উচ্চ আদালত ১৫ জনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখেন। বাংলাদেশে ড্রাইভারের চাকরি পেশা হিসেবে বড়ই ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক। এ দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার খুবই বেশি। রাস্তায় চলতে গিয়ে ড্রাইভারের প্রাণটা কিন্তু সবার আগে থাকে। ড্রাইভারই বেশি দুর্ঘটনায় পড়েন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দেশে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ৫২৪ জন। এর মধ্যে ৩ হাজার ৬৯৬ জনই ড্রাইভার। যা দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৫৭ শতাংশ। এই মৃত্যুর অধিকাংশই মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলারের ড্রাইভার। তবে বাস-ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক্টর, ট্রলি, প্রাইভেট কারের মতো বাণিজ্যিক যানের চালকও কম নয়।
বিআরটিএর গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৫৭ লাখ যানবাহনের বিপরীতে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার দেওয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে ৫৯ লাখ। বাস্তবে এই হিসাবে বড় গরমিল আছে বলে মনে করেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, মোট গাড়ির তুলনায় ড্রাইভিং লাইসেন্স কয়েক লাখ কম আছে। বিশেষ করে ভারী যানবাহনের ড্রাইভারের চরম সংকট। মোট ভারী যানবাহনের অর্ধেক চালকেরও বৈধ লাইসেন্স নেই। অন্যদিকে নিত্যদিনের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান অনেক ড্রাইভার। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছে দেন। সচল রাখেন জীবিকার স্পন্দন। পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে আমাদের খাদ্য পরিবহন ব্যবস্থাপনা অক্ষুণ্ণ রাখছেন তারা। অথচ তাদের অধিকাংশের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য নেই। অনিশ্চয়তার ঘোরপাকে কাটছে ড্রাইভারদের জীবন। একজন ড্রাইভার যখন স্টিয়ারিং হাতে মহাসড়কে নামেন, তখন মৃত্যুঝুঁকিতে তার মাথাটা থাকে সবার আগে। তিনিই প্রথম বলি হন দুর্ঘটনার। তবুও দেশে বাস-ট্রাক চালানোর মতো ভারী যানবাহনের চালক সংকট রয়েছে প্রায় ২ লাখ। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এক নেতা বলেন, দেশে বাস-ট্রাক ও ট্যাংক-লরি রয়েছে প্রায় পৌনে ৪ লাখ। এর মধ্যে ২ লাখ চালকের সংকট রয়েছে; যাদের ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ফলে চালক সংকটে তারা বিপদে আছেন। দেশের সরকারি যানবাহন এবং ব্যক্তিগত গাড়ির চালক বাদে বাকি বাণিজ্যিক যানবাহন চালকদের নির্ধারিত মাসিক কোনো বেতন নেই। অথচ সড়ক পথের সবচেয়ে দামি গাড়িগুলো বিপুলসংখ্যক জানমালের দায়িত্ব নিয়ে তাদের চালাতে হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি কোম্পানির অধিকাংশ ড্রাইভারের নিয়োগপত্র থাকলেও ব্যক্তিগত গাড়ির চালকদের কোনো নিয়োগপত্র থাকে না। তারা মাস শেষে বেতন, নির্ধারিত উৎসব বোনাস হয়তো পান কিন্তু তাদের ধারাবাহিক চাকরির নিশ্চয়তা সম্পর্কিত কোনো নিয়োগপত্র নেই। অন্যদিকে দেশব্যাপী হাজার হাজার বাস-ট্রাক চালকের তো কোনো নিয়োগপত্রই নেই। মাস শেষে তারা একটি নির্ধারিত অঙ্কের বেতন পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারা এক দিন হয়তো হাজার টাকা আয় করেন, অন্যদিন কোনো কাজই থাকে না। এসব ড্রাইভারের ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা। যেদিন আয় বেশি সেদিন খরচ বেশি হয়ে যায়। আমি মনে করি, প্রত্যেক ড্রাইভারের নিয়োগপত্র থাকতে হবে। চাকরি গেলেও যেন তারা বাড়তি কিছু সুবিধা পান। অন্য একটি চাকরি খুঁজে নেওয়ার সময় পান। একজন ড্রাইভারের কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা বেতন হওয়া উচিত। নইলে তিনি মনোযোগ দেবেন কীভাবে? তার যদি সংসারের চাল-ডালের চিন্তা থাকে, ঘরে স্বাচ্ছন্দ্য না থাকে, তাহলে তিনি নিশ্চিন্তে গাড়ি চালাবেন কীভাবে? একজন গাড়ি চালককে সর্বদা চোখ, কান, মস্তিষ্ক, হাত, পা সক্রিয় রাখতে হয়। একসঙ্গে এতগুলো প্রত্যঙ্গের ব্যবহার করেই তাকে গাড়ি চালাতে হয়। গাড়ি চালনা যে কোনো কায়িক পরিশ্রমের চেয়েও কষ্টকর। গাড়ি চালনা একটি বিশেষ কৌশলের ব্যাপার। কারিগরি দক্ষতার সঙ্গে মানবিক উৎকর্ষতার ব্যাপার। তাই গাড়িচালককে উপেক্ষা-অবজ্ঞার কোনো সুযোগ নেই। আমি মনে করি, সমাজের অপেক্ষাকৃত মেধাবী ও বিচক্ষণ লোকজনই ড্রাইভার হন। তাদের একটু ভালো প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশন দিতে পারলে, আর্থিক নিশ্চয়তা ও সড়ক পরিবেশ দিতে পারলে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। ড্রাইভারদের প্রতি অভিযোগের আঙুল তুলে আমরা দুর্ঘটনা রোধ করতে পারব না। আমি মনে করি, আমাদের ড্রাইভাররা দক্ষতায় বিশ্বসেরা। কিন্তু তাদের চাহিদা খুবই কম। সেই চাহিদাও পূরণ হয় না। তাদের দরকার মমতা ও নিশ্চয়তা। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর সরকারের নিম্নতম মজুরি বোর্ড ব্যক্তিমালিকানাধীন সড়ক পরিবহন সেক্টরে নিযুক্ত সব শ্রেণির শ্রমিকের জন্য নিম্নতম মজুরি হারের খসড়া সুপারিশের গেজেট প্রকাশ করে। এতে পরিবহন খাতের শ্রমিকদের জীবনযাপন ব্যয়, জীবনযাপনের মান, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, কাজের ধরন, ঝুঁকি ও মান বিবেচনায় ভারী গাড়ির ড্রাইভারদের মাসিক মোট বেতন ২০ হাজার ২০০ টাকা, মিডিয়াম লাইসেন্সপ্রাপ্ত দক্ষ-১ শ্রেণির ড্রাইভারদের মোট বেতন ১৬ হাজার ৬০০ টাকা, লাইট গাড়ির লাইসেন্সপ্রাপ্ত ড্রাইভারদের মোট বেতন ১৫ হাজার ৪০০ টাকা সুপারিশ করা হয়। সেই সুপারিশের পর পাঁচ বছর কেটে যাচ্ছে। এর মধ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে অনেক। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত পরিবহন খাতের কর্মীদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ এবং সেটা বাস্তবায়ন করা দরকার। আসলে ড্রাইভারদের কাজের ধরন এবং ঝুঁকি বিবেচনায় বর্তমান বাজারমূল্যে তাদের ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতন হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে তাদের নিয়োগপত্র থাকলে বছর শেষে বেতন বৃদ্ধির সুযোগ থাকে। মালিকের ইচ্ছায় চাকরি গেলে তিন মাসের সমপরিমাণ বেতন পাওয়ার সুযোগ থাকে, যার কোনোটিই বর্তমানে নেই।
আমাদের যোগাযোগ অবকাঠামো এবং সড়ক পরিবহন খাতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে লাখ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ প্রতি বছরই বাড়ছে। কিন্তু দক্ষ ড্রাইভার তৈরিতে রাষ্ট্রের তেমন কোনো বিনিয়োগ নেই। বিদ্যমান ড্রাইভারদের জীবনমান উন্নয়নে কোনো বিনিয়োগ নেই। উপরন্তু বিশৃঙ্খল সড়ক পরিবেশের কারণে, দুর্ঘটনার কারণে প্রতিদিনই যাত্রী-পথচারীর সঙ্গে বিপুলসংখ্যক ড্রাইভারও মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। সেই নিহত ড্রাইভারদের পরিবার পরবর্তীতে কীভাবে বেঁচে থাকে, কীভাবে টিকে থাকে তার খোঁজ কেউ রাখে না। তবুও প্রতি বছর নিজ উদ্যোগে ড্রাইভিং পেশায় নাম লেখান অনেকে। সারা দেশে ব্যক্তি উদ্যোগে ড্রাইভিং স্কুল গড়ে তুলেছে শত শত প্রতিষ্ঠান। তারা ঠিকমতো চলতে পারছে না। অফিস ভাড়া দিতে পারে না। ইন্সট্রাক্টরের বেতন দিতে পারে না। রাস্তার পাশে, ড্রেনের ওপর খুপরি তুলে দক্ষ ড্রাইভার তৈরির লক্ষ্যে ড্রাইভিং স্কুল গড়ে তুলছে। তাদের সরকারি সহায়তা দরকার। দেড় শতাধিক ড্রাইভিং স্কুল বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে। তাদের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়াতে পারে সরকার। কারণ, প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা দক্ষ ড্রাইভার তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। দেশে মানুষ বাড়ছে। গাড়ি বাড়ছে। কিন্তু ড্রাইভার বাড়ছে না। অনেকে ভালো বেতনের চাকরি নিয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছেন। ড্রাইভারদের শূন্যতা পূরণে সরকারি-বেসরকারি কার্যকর উদ্যোগ দরকার। ড্রাইভারদের উপেক্ষা করে আমরা বেশিদূর এগোতে পারব না।
লেখক : সাংবাদিক
ইমেইল : [email protected]