সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
বন্ধ হয়ে গেছে ৯৮ ভাগ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান

পথে বসেছেন চলচ্চিত্র প্রযোজকরা

আলাউদ্দীন মাজিদ

পথে বসেছেন চলচ্চিত্র প্রযোজকরা

পর্যাপ্ত ও মানসম্মত সিনেমা হল ও দর্শকের অভাবে লোকসান গুনে বন্ধ হয়ে গেছে ৯৮ ভাগ চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা ও পাইরেসির দাপট শুরু হলে মধ্য ও উচ্চমধ্য এবং উচ্চবিত্তের দর্শকরা সিনেমা হলে যাওয়া ছেড়ে দেয়। এতে সিনেমা হল মালিক এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক উভয়েই চরম ক্ষতির মুখে পড়ে। দুপক্ষই লোকসানের কবলে পড়লে একই সঙ্গে সিনেমা হল ও প্রযোজনা সংস্থাগুলো বন্ধ হতে শুরু করে। বর্তমান সময়ে চলচ্চিত্র শিল্পের অস্তিত্ব বিপন্নের পথে এসে দাঁড়িয়েছে। চলচ্চিত্র শিল্পের এ দৈন্যদশা উপলব্ধি করে সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেকের বৈঠকে সিনেমা হলের জন্য ঋণ প্রদানের কথা ঘোষণা করেছেন। এতে চলচ্চিত্র জগতে অনেকটা স্বস্তি ফিরে এলেও সিনেমা হল মালিকরা নতুন করে উদ্বেগে পড়েছেন। মধুমিতা সিনেমা হল ও মধুমিতা মুভিজের কর্ণধার ইফতেখারউদ্দীন নওশাদ বলছেন, ঋণ নিয়ে সিনেমা হল সংস্কার করব ঠিক আছে কিন্তু সেই ঋণ পরিশোধ করতে নিয়মিত পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি প্রয়োজন। যা দীর্ঘদিন ধরে নেই। প্রতি সপ্তাহে চালানোর মতো ছবি যদি পাওয়া না যায় তাহলে এ ঋণ শোধ করব কীভাবে। এ কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার অনুরোধ, সিনেমা হলের পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে লোকসান গুনে পথে বসা প্রযোজকরা আবার চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অর্থ কোথায় পাবেন। এ বন্ধ্যত্ব কাটাতে প্রধানমন্ত্রীর সদয় সহযোগিতা কামনা করছি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক টিওটি ফিল্মসের কর্ণধার, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, চলচ্চিত্র শিল্পের দৈন্যদশার কারণে বিশাল অঙ্কের লোকসান গুনে ২০১৬ সালের পর আমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে আর ছবি নির্মাণ করতে পারছি না। ছবি নির্মাণ না করলেও নিয়মিত অফিস ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, স্টাফদের বেতনসহ সমুদয় খরচ বহন করে যেতে হচ্ছে। এতে অবস্থা নাভিশ্বাসে উঠেছে। এ অবস্থা শুধু আমার একার নয়, সব প্রযোজকের। আমরা প্রযোজকরা আগে বলতাম ‘প্রযোজক বাঁচলে সিনেমা হল বাঁচবে’, এখন বলছি ‘সিনেমা হল বাঁচলে প্রযোজক বাঁচবে’। সরকারের কাছে বিষয়টি একধিকবার উত্থাপন করার পর সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিনেমা হল বাঁচাতে ঋণ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। এখন প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, প্রযোজকদের যদি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা হয়, তাহলে প্রযোজকরাও নিয়মিত মানসম্মত ছবি নির্মাণ করতে পারবেন এবং সিনেমা হলগুলোও পর্যাপ্ত ছবি পেয়ে তাদের ঋণ শোধ করতে পারবে। মানে নির্মাণ ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য ফিরবে। ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রযোজকরা তাদের টোটাল ডিজিটাল রাইটস ব্যাংকের কাছে মর্টগেজ রাখবে। পরবর্তীতে কোনো প্রযোজক যদি ঋণ শোধ করতে না পারে ব্যাংক তখন ওই প্রযোজকের ডিজিটাল রাইটস থেকে সহজেই ঋণের টাকা তুলে নিতে পারবে। সরকার যদি ঋণ দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সহযোগিতা না করে তাহলে ছবির অভাবে আবার সিনেমা হল বন্ধ হবে এবং দেশে চলচ্চিত্র শিল্প বলে আর কিছুই থাকবে না। এসকে ফিল্মসের কর্ণধার শীর্ষ অভিনেতা ও প্রযোজক শাকিব খান বলেন, ‘চলচ্চিত্র প্রযোজকরা দীর্ঘদিন ধরে করুণ অবস্থা পার করছেন। পাইরেসি ও দর্শক খরা প্রযোজকদের পথে বসিয়ে ছেড়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে সদা তৎপর। এ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের জন্য নানা যুগান্তকারী পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি তিনি সিনেমা হলের উন্নয়নে ঋণ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। এখন সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে ও বন্ধ সিনেমা হলগুলো পুনরায় চালু করতে দরকার পর্যাপ্ত মানসম্মত ছবি। আর এর জন্য কমপক্ষে গত ৫ বছর যেসব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সক্রিয় ছিল তাদের যদি বছরে কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা করে দুবছরে ২০০ কোটি টাকার স্বল্প সুদ ও সহজ কিস্তিতে ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবে চলচ্চিত্র শিল্পের সুদিন ফিরবে। চলচ্চিত্রের মানুষ ও দর্শক স্বস্তি পাবে এবং দেশের প্রধান গণমাধ্যম চলচ্চিত্র শিল্প আবার বিদেশ থেকে বাংলাদেশের জন্য সুনাম বয়ে আনবে। সরকারের কাছে আবেদন প্রণোদনা বা অনুদান নয়, চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচাতে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ঋণ দিন।

দেশ স্বাধীনের আগেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত হয় চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার অফিস। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, তোপখানা রোড, নয়াপল্টন, কাকরাইল, গ্রিন রোড, সিদ্দিকবাজার, নওয়াবপুর, ওয়াইজঘাট, ইসলামপুর, গুলিস্তান, দিলকুশা, মতিঝিল, বিজয়নগর, ওয়ারী, পুরানা পল্টন, গুলশান, ধানমন্ডি, আরামবাগ, ফকিরাপুলসহ নানা স্থান প্রযোজনা সংস্থার অফিসে মুখর ছিল। ১৯৫৬ সালে এ দেশে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণ হলে স্থাপিত হয় প্রযোজনা সংস্থার অফিস। ইকবাল ফিল্মসের ব্যানারে ছবিটি নির্মাণ করেন আবদুল জব্বার খান। তখন এ সংস্থার অফিস স্থাপিত হয় ভিক্টোরিয়া পার্কে অবস্থিত প্রভেনশিয়াল বুক ডিপো ভবনের দ্বিতীয় তলায়। দেশ স্বাধীনের পর গুলিস্তানে গুলিস্তান সিনেমা হল ভবনে প্রযোজনা সংস্থার অফিসগুলো একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে ফিল্মপাড়া। দুই হাজার সালের প্রথমদিকে গুলিস্তান সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হলে প্রযোজনা সংস্থাগুলো কাকরাইলে চলে আসে। এখানে রাজমণি ভবন, ভূঁইয়া ম্যানশন, ফরিদপুর ম্যানশন, যমুনা ভবন, ইস্টার্ন কমার্শিয়াল ভবনে খোলা হয় প্রযোজনা সংস্থার অফিস। তখন থেকেই চলচ্চিত্রপাড়া হিসেবে খ্যাতি লাভ করে কাকরাইল। এ ফিল্মপাড়ায় শতাধিক চলচ্চিত্র প্রযোজনার অফিস এ শিল্পটিকে সরব করে রেখেছিল। ২০০৭ সালের পর থেকে নানা কারণে চলচ্চিত্র ব্যবসায় মন্দাভাব শুরু হলে ধীরে ধীরে প্রযোজনা সংস্থাগুলো বন্ধ করে দিয়ে অফিস গুটিয়ে নিতে শুরু করে প্রযোজকরা। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ কুমার দাস উদ্বেগের সঙ্গে জানান, এ ফিল্মপাড়ায় বর্তমানে প্রযোজনা সংস্থার অফিস নেই বললেই চলে। কারণ চলচ্চিত্র নির্মাণই যদি না থাকে তাহলে অফিস ভাড়া, স্টাফ খরচসহ অন্যান্য লোকসান গুনে কীভাবে টিকিয়ে রাখা যাবে। যেগুলো আছে তাতে চলচ্চিত্রের কোনো কাজ নেই। বাধ্য হয়ে অন্য ব্যবসায় অফিসগুলো ব্যবহার করছেন সংশ্লিষ্ট প্রযোজকরা। সুদীপ কুমার দাসের ক্ষোভ, কাকরাইল ফিল্মপাড়ায় বর্তমানে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে- আশীর্বাদ চলচ্চিত্র, এন এন ফিল্মস, বেনানা ফিল্মস, মালঞ্চ কথাচিত্র, জননী কথাচিত্র, টিওটি ফিল্মস, শাপলা মিডিয়া, কৃতাঞ্জলি চলচ্চিত্র এবং হার্টবিট প্রোডাকশন প্রভৃতি। এসব সংস্থা থেকেও অনেকদিন ধরে নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় না। কাকরাইলের বাইরে বিভিন্ন স্থানে হাতেগোনা কয়েকটি প্রযোজনা সংস্থার অফিস রয়েছে। যেমন- জাজ মাল্টিমিডিয়া, এসকে ফিল্মস, লাইভ টেকনোলজি ইত্যাদি। এগুলো থেকেও এখন আর নিয়মিত ছবি পাওয়া যায় না।

দীর্ঘদিন ধরে প্রযোজনায় অনিয়মিত রয়েছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়া। হার্টবিট প্রোডাকশন হাউসের কর্ণধার তাপসী ফারুক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সিনেমা হলে পরিবেশের অভাব, সিনেমা হল হ্রাস, অপর্যাপ্ত সিনেপ্লেক্স এবং দর্শকগ্রহণযোগ্য নায়ক-নায়িকার অভাবে ছবি এখন আর ব্যবসাসফল হয় না। একমাত্র শাকিব খানকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করলে সেই ছবি ব্যবসার মুখ দেখে। কিন্তু এ শীর্ষ অভিনেতাকে নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে গেলে কমপক্ষে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা দরকার। সিনেমা হলের সংখ্যা এখন একশরও নিচে নেমে আসায় এ অর্থ ফেরত আনা সম্ভব নয়। আর কলকাতার ছবি এখানে একসঙ্গে মুক্তি দিতে না পারায় দর্শক তা দেখে না। ফলে কর্মহীন প্রযোজনা সংস্থার অফিস চালু রাখতে গেলে স্টাফদের বেতনসহ নানা ব্যয় নির্বাহ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। এতে প্রযোজনা সংস্থাগুলো এখন চরম অশনি সংকেতের কবলে পড়েছে। এ অচলাবস্থার উত্তরণে সরকারের কাছে প্রণোদনা বা অনুদান নয়, সহজ শর্তে ঋণ চাই। তাহলে ফের চলচ্চিত্র শিল্প চাঙ্গা হবে।

সর্বশেষ খবর