নাট্যকর্মীদের আন্দোলনের জন্য বাংলাদেশে মঞ্চনাটকে সফলতা এসেছে। তবে বর্তমানে মঞ্চ প্রদর্শনী নিয়ে নানা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। দর্শক সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য দরকার মহড়াকক্ষ, মিলনায়তন, তরুণ নাট্যকার-নির্দেশক, নাট্যকর্মী এবং মৌলিক পান্ডুলিপি। মঞ্চে বড় দলের প্রভাব ও হল বরাদ্দ নিয়ে জটিলতা থাকলেও পান্ডুলিপির অভাবে দর্শক মঞ্চ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ঢাকার মঞ্চনাট্যাঙ্গনে এই পাণ্ডুলিপি সংকট ও এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজেছেন- পান্থ আফজাল
পান্ডুলিপি নাট্যচর্চার জন্য অন্যতম প্রধান উপাদান। এ ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই আমাদের মঞ্চে বিদেশি নাট্যকারের নাটক অনুবাদ বা রূপান্তর করে পান্ডুলিপি করার একটা ধারা চালু রয়েছে। তবে কোনো বিদেশি নাটক দেশজ আদলে নিয়ে এলে সেখানে নিজস্ব সংস্কৃতিকে কতটা প্রাধান্য দেওয়া হয় তা দেখার বিষয়! সম্প্রতি সে জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে মৌলিক ও বিষয়-বৈচিত্র্যের কিছু পান্ডুলিপি আমাদের মঞ্চাঙ্গনকে উৎসাহিত করলেও এখনো দেশীয় মৌলিক পান্ডুলিপি সংকট রয়েই গেছে। এ বিষয়ে নাট্যজন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘সব মাধ্যমেই পা-ুলিপি সংকট রয়েছে। তা টেলিভিশন নাটক, মঞ্চ বা অন্য যে কোনো মাধ্যম হোক না কেন। মঞ্চনাটক লেখার সংকট আছে। মঞ্চে সৃজনশীল লেখার অভাব রয়েছে।’ এক্ষেত্রে তরুণ নাট্যকার ও নির্দেশকদের যে কোনো কাজে উৎসাহ প্রদান না করাকে দায়ী করে বিশিষ্ট নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম বলেন, ‘আমার মতে এখনকার সময় তরুণ নাট্যকার ও নির্দেশক যারা আছেন সবাই অনেক ভালো করছেন। তাদের কাজ এখন বিশ্বমানের বলা চলে। আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে, তারা যে ভালো ভালো কাজ করছে তার জন্য উৎসাহ দেওয়ার কেউ নেই। তাদের অনুপ্রেরণা আমরা দিতে চাই না। সেজন্য তারা তাদের ঠিকমতো মেলে ধরতে পারছে না।’ মঞ্চনাটক প্রদর্শনীর জন্য যেমন দরকার নির্দেশক, মহড়াকক্ষ বা মিলনায়তন, তেমনি দরকার নিজস্ব ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পান্ডুলিপি। এটির সংকট ইদানীং চরম আকার ধারণ করেছে। এদিকে নতুন নাটক মঞ্চায়নে পান্ডুলিপি সংকটের পর বড় বাধা হিসেবে অনেকে দেখছেন বড় দলের প্রভাবকে। কেউ কেউ বলছেন, ‘ছোট দলগুলোকে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ করতে হলে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হয় বারবার। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্যভুক্ত নাট্যদলগুলোর মধ্যে থিয়েটার মঞ্চে বড় কয়েকটি দলেরই প্রভাব বেশি দেখা যায়। ছোট দলগুলোর প্রতিভা ও সাংগঠনিক সবলতা থাকা সত্ত্বেও ঠিকমতো পাচ্ছে না মঞ্চ আর মহড়াকক্ষ। ঠিকমতো প্রযোজনা মঞ্চস্থ না করতে পারার কারণে নাট্যকর্মীরা হতাশ হয়ে থিয়েটারে নিয়মিত চর্চায় আসতে আগ্রহী হচ্ছে না। নতুন পান্ডুলিপি লিখে বা সংগ্রহ করে এত বাধা পেরিয়ে নাটক প্রদর্শনী করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে সবাই। নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূর ঢাকাই মঞ্চে পান্ডুলিপি সংকটকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন, ‘সব মাধ্যমেই পান্ডুলিপি সংকট রয়েছে। তা টেলিভিশন নাটক, মঞ্চ বা অন্য যে কোনো মাধ্যমেই হোক না কেন। মঞ্চনাটক নিয়ে লেখার সংকট আছে। মঞ্চ তো দেশের বাইরের জায়গা নয়, সমাজের বাইরের জায়গা নয়। ভালো তো সব জায়গায় হয় না, যদি সব স্থান ঠিক থাকে তাহলে অবশ্যই ভালো কিছুই হবে। আমাদের মঞ্চে সৃজনশীল লেখার অভাব রয়েছে। দেশীয় বা মৌলিক পান্ডুলিপি আমরা তেমন করে মঞ্চে পাচ্ছি না।’ বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা মামুনুর রশীদ বলেন, ‘মৌলিক পান্ডুলিপির অভাব তো আছেই। তার পরেও তো হচ্ছে মঞ্চনাটক। আজকাল ভালো নাটকও হচ্ছে। তবে ভালো নাট্যকারের অভাব। আমরা অকালে তিনজন ভালো নাট্যকারকে হারিয়েছি। আবদুল্লাহ আল মামুন, সেলিম আল দীন ও সৈয়দ শামসুল হক মঞ্চের জন্য কিছু পান্ডুলিপি করে গেছেন। সেগুলো নিয়েই কাজ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এখন তো তেমন ভালো নাট্যকার নেই বললেই চলে। তরুণ কিছু নাট্যকার লিখছে, তবে এদের সংখ্যা খুবই কম।’ মঞ্চ অভিনেতা ও নির্দেশক অলোক বসু এই সংকটকে একটু দেখছেন ভিন্নভাবে। তিনি বলেন, ‘আসলে এই সমস্যা মৌলিক পাণ্ডুলিপির ক্ষেত্রে যতটা না তার থেকে আমরা একটু বাড়িয়ে দেখি। গত ৪০ বছরে আমরা মঞ্চনাটকের পান্ডুলিপি পেয়েছি বেশ। সৈয়দ শামসুল হক, সেলিম আল দীনসহ অনেকেই অনেক ভালো ভালো পাণ্ডুলিপি রেখে গেছেন। সৈয়দ শামসুল হকের মঞ্চের ওপর প্রায় ৮-১০টি স্ক্রিপ্ট রয়েছে। মৌলিক নাটক আছে কিন্তু তা নিয়ে তেমন কাজ হচ্ছে না। অনেক প্রতিশ্রুতিশীল লেখক আছে। মান্নান হীরা, মাসুম আজিজ, মাসুম রেজা, রুমা মোদকসহ অনেক ভালো পাণ্ডুলিপি লেখক আছে আমাদের। সংকট আছে কিন্তু তা আবিষ্কারের অভাব।’ তরুণ অভিনেতা, নাট্যকার ও নির্দেশক মুক্তনীল বলেন, ‘আমাদের থিয়েটার যাত্রালগ্ন থেকেই এই মৌলিক পাণ্ডুলিপি সংকটে ছিল। আমরা কিন্তু মঞ্চের জন্য যথেষ্ট পাণ্ডুলিপি পাইনি। অন্যদিকে আমরা অস্বীকার করতে পারব না যে, মঞ্চনাটক নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের সংখ্যা কম। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময় সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল্লাহ আল মামুন ও সেলিম আল দীন স্যারের লেখা ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য পাণ্ডুলিপি আমরা পাইনি। বেশির ভাগই মঞ্চে এসেছে বিদেশি নাটকের অনুবাদ। আমরা এখন মৌলিক পাণ্ডুলিপি হাতড়ে বেড়াচ্ছি। নতুনদের মধ্যে নিজস্বতা তেমন করে পাচ্ছি না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাবনার ভগ্নাংশের অংশবিশেষ একত্রিত করে আমরা কাজ করছি এখন। যা মৌলিক ভাবনার কোনো অংশবিশেষ নয়।’ প্রতিভাবান অভিনেতা রামিজ রাজু বলেন, ‘আমার কাছে খুব বেশি সংকট বলে মনে হয় না। তবে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী আমাদের এই মঞ্চের প্রতি যাদের অবদান ছিল তারা আজ নেই। নতুনদের কাজ তেমন করে আমরা পাচ্ছি না। অনেকেই লিখছে কিন্তু দর্শকদের কাছে তাদের আবেদন খুবই কম। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, দেশীয় মৌলিক নাটকের আবেদন রেখে মঞ্চনাটকের পাণ্ডুলিপিকে আধুনিকায়ন করতে হবে। পাণ্ডুলিপি সংকট তখনই হবে যখন তা নিয়ে কাজ কম হবে।’ অভিনেতা ও নির্দেশক জাহিদ রিপন বলেন, ‘আমাদের দেশের নাট্য আন্দোলন বেগবান করতে হলে অবশ্যই মৌলিক কিছু লাগবে। সেক্ষেত্রে মৌলিক অথচ দেশীয় পা-ুলিপির প্রয়োজন যথেষ্ট। আমাদের দেশে মঞ্চনাটক গতিশীল হচ্ছে। কিন্তু পাণ্ডুলিপি সংকট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।’ নাট্যকার, অভিনেতা ও নির্দেশক আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মনে করি, তেমন মৌলিক পাণ্ডুলিপি সংকট নেই। আমাদের মঞ্চনির্ভর কাজ কম হচ্ছে অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায়। নতুন-পুরনো অনেক পাণ্ডুলিপি আমাদের আছে কিন্তু আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি না। আমাদের কিছু ভালো ভালো লেখক রয়েছেন। তারা সবাই কিন্তু ভালো ভালো মৌলিক নাটক লিখছেন। তবে আমরা মানসম্মত নাটক না পাওয়ায় বিদেশি অনুবাদনির্ভর নাটকের দিকে ঝুঁকছি। আমাদের সবাইকে বসতে হবে। তবেই ভালো পাণ্ডুলিপি মঞ্চে আনতে পারব।’ অভিনেত্রী ও নির্দেশক জয়িতা মহলানবীশ বলেন, ‘আমি মনে করি, দেশীয় মৌলিক পাণ্ডুলিপির অভাব আছে। অনেকেই কিন্তু মৌলিক কিছু পাণ্ডুলিপি লিখে গেছেন। আগের সেই পাণ্ডুলিপি নিয়েই কাজ করছি। এখনকার সময়ে সায়মন জাকারিয়া, আনন জামান, শুভাশিস সিনহা, রুবাইয়াৎ আহমেদ, মুক্তনীল, সাহমান মৈশান, বদরুজ্জামান আলমগীরসহ অনেকেই ভালো লিখছেন। মঞ্চে নতুনদের মৌলিক পাণ্ডুলিপিনির্ভর কাজ তেমন আসছে না। এ জন্য তারা লেখার আগ্রহ হারাচ্ছে। মঞ্চে আসলে নতুন নাট্যকারদের মৌলিক পাণ্ডুলিপির কাজ বেশি বেশি আসা প্রয়োজন। তাহলে এই সংকট কেটে যাবে।’