জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীদের সন্তানদের চলচ্চিত্রে নাম লেখানো নতুন কিছু নয়। হলিউড-বলিউড সব জায়গাতেই এ চর্চা রয়েছে। কিন্তু ঢাকাই সিনেমার চিত্র ভিন্ন। এখানে অনেক দাপুটে অভিনেতা-অভিনেত্রীর সন্তানরা চলচ্চিত্রবিমুখ হয়েছেন। কিন্তু কেন? সে কথাই জানাচ্ছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চলচ্চিত্র জগৎ বলিউডে জনপ্রিয় তারকাদের সন্তানরাও চলচ্চিত্রে আসেন হরহামেশাই। একইভাবে হলিউড এবং টালিগঞ্জের চলচ্চিত্র তারকা সন্তানদেরও চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটতে দেখা যায়। ব্যতিক্রম শুধু ঢাকাই চলচ্চিত্র। এখানে খুব অল্প সংখ্যক তারকার সন্তানই চলচ্চিত্রে আসেন। এ প্রসঙ্গে ববিতা বলেন, এটি আসলে নির্ভর করে সন্তানদের আগ্রহের ওপর, যেমন আমার ছেলে অনিক অভিনয়ের চেয়ে অন্য পেশায় যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তেমনিভাবে অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটেছে। বাবা-মা চাইলেই সন্তানদের ওপর নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ জোর করে চাপিয়ে দিতে পারেন না। নিজের পেশা নির্বাচনের জন্য সন্তানদের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত বলেই আমি মনে করি। না হলে তাদের ক্যারিয়ার গঠনে বাধাগ্রস্ত হয়। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ বলেন, আসলে আমাদের দেশের মানুষের মন সংকীর্ণ। অনেক তারকা মনে করেন তাদের সন্তান চলচ্চিত্রে এলে তাতে তার প্রেস্টিজ হ্যাম্পার হবে। আরেকটি বিষয় হলো- বর্তমানে চলচ্চিত্র জগতের যে পরিবেশ তাতে তারকারা মনে করে এ পরিবেশে এলে তার সন্তান নষ্ট হবে। তাছাড়া এখনকার চলচ্চিত্রের যে অচলাবস্থা তাতে এখানে আগের মতো পেশা হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিনয়কে গ্রহণ করার মতো ভবিষ্যৎ নেই। তাই এ অনিশ্চিত ভবিষ্যতে তারকারা তাদের সন্তানদের ঠেলে দিতে চান না। এ ছাড়াও আমাদের দেশে একমাত্র নায়করাজ রাজ্জাক ছাড়া অত বড় মাপের আর কোনো তারকা নেই যে তার সন্তানকে অভিনয়ে আনতে পারবে। রাজ্জাক সাহেব তাঁর দুই পুত্র বাপ্পারাজ ও সম্রাটকে চলচ্চিত্রে এনেছেন। এর মধ্যে বাপ্পা বেশ নামও করেছেন। তাছাড়া তার কন্যা ময়নাকে ছোটবেলায় শিশুশিল্পী হিসেবেও অভিনয় করিয়েছেন।
ঢাকাই সিনেমার সোনালি সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন শবনম, ববিতা, সুচরিতা, কবরী, রোজিনা, শাবানা, সুজাতা, অঞ্জনা, নূতন, দিতি, চম্পা এমনকি মৌসুমীর সন্তানরাও চলচ্চিত্রে নেই। অন্যদিকে ফারুক, মান্না, জসীম, ইলিয়াস কাঞ্চন, আলমগীর, জাফর ইকবাল, বুলবুল আহমেদসহ আরও অনেক জনপ্রিয় অভিনেতার সন্তানদেরও রুপালি জগতে দেখা যায়নি। নায়করাজ রাজ্জাকের দুই সন্তান বাপ্পারাজ ও সম্রাটকে অভিনয়ে পাওয়া গেছে। নায়করাজের ছোট মেয়ে ময়নাকেও একসময় ‘জোকার’ চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে দেখা গেছে। বুলবুল আহমেদের মেয়ে ঐন্দ্রিলা আহমেদকে বেশ কয়েক বছর আগে বিনোদন অঙ্গনে দেখা গেলেও বর্তমানে তিনি অনিয়মিত। আলমগীরের মেয়ে আঁখি আলমগীর ‘ভাত দে’ সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছিলেন। এরপর আর অভিনেত্রী হিসেবে দেখা যায়নি। অভিনেত্রী সুচন্দার ছেলে তপু রায়হান একসময় চলচ্চিত্রে অভিনয়ে এলেও তাঁর কোনো কন্যা অভিনয়ে আসেননি। অভিনেতা জসীমের সন্তানদের অভিনয়ে পাওয়া যায়নি, তবে সংগীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন তারা। অবশ্য অভিনয়শিল্পী দম্পতি সুব্রত ও দোয়েলের মেয়ে দীঘি প্রথমে চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী ও পরে নায়িকা হিসেবে কাজ করছেন। অভিনেতা সোহেল রানার ছেলে মাশরুর পারভেজও অভিনেতা নির্মাতা হিসেবে চলচ্চিত্রে এসেছেন। একইভাবে অভিনেতা নির্মাতা কাজী হায়াতের পুত্র কাজী মারুফও চলচ্চিত্র অভিনেতা হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে গত বছর অভিনেত্রী মৌসুমী বলেন, ছেলে সন্তানদের এ নিয়ে বাধা না থাকলেও মেয়ে সন্তানকে নায়িকা হতে দিতে চান না অভিনয়শিল্পীরা। মৌসুমীর ২ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘ছেলে বাচ্চাদের অভিনয়ে আসার ব্যাপারে কারও তেমন কোনো সমস্যা নেই। সব নায়ক-নায়িকাকে দেখি তাদের ছেলেরা যদি সিনেমা করতে চায়, তাদেরকে না করে না; কিন্তু মেয়ে কখনো যদি নায়িকা হতে চায়, সেটা নিয়ে সবাই একটু অমত পোষণ করেন।’ আঁখি আলমগীরের প্রসঙ্গে মৌসুমী বলেন, ‘আঁখি আলমগীর খুব সম্ভাবনাময় ছিল। তাকে কিন্তু ভাইয়া (আলমগীর) কাজ করতে দেননি। ও খুবই সুন্দর মিষ্টি দেখতে ছিল। সে সময় একঝাঁক নতুন মুখ আসছিল। কিন্তু আঁখিকে দেওয়া হয়নি। তাকে পেলে আমরা খুব ভালো একজন নায়িকা পেতাম।’ মৌসুমী আরও বলেন, ‘চম্পা আপার মেয়েও অনেক কিউট। চম্পা আপা তাকে কখনো নায়িকা হতে উৎসাহ দেননি। দেখা যায় যে, আমাদের অনেকেরই মেয়ে বাচ্চা আছে, যাদের আগ্রহ থাকার পরও সিনেমায় আসতে দেওয়া হয়নি। অন্যভাবে বড় করা হয়েছে, অন্য কাজে যেতে উৎসাহিত করেছে। কেন যেন আর্টিস্ট হওয়ার ব্যাপারে সবার বাধা।’ তবে এদিক থেকে মৌসুমীর ব্যতিক্রম মনে হয়েছে অভিনেত্রী দোয়েলকে। দোয়েলের চেষ্টা ছিল তাঁর মেয়ে প্রার্থনা ফারদিন দীঘিকে নায়িকা হিসেবে তৈরি করার। যা নিয়ে দোয়েলের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন মৌসুমী। সেই স্মৃতি তুলে ধরে মৌসুমী বলেন, ‘ব্যতিক্রম ছিলেন দোয়েল আপা, তিনি অনেক সময় দিতেন দীঘিকে। আপা আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার খুব ইচ্ছা দীঘিকে নায়িকা হিসেবে তৈরি করার। আমি নিজে যা মেইনটেইন করতে পারিনি। আমি বড় জায়গায় যেতে পারতাম। এত সাপোর্ট পেয়েও আমি আমার জায়গাটা ধরে রাখতে পারিনি। এটা আমি দীঘির মধ্যে দেখতে চাই।’ সে সময় আপাকে আমি প্রশ্ন করলাম- দীঘির পড়াশোনার ক্ষতি হবে না? তখন বলল, ‘উঠতি বয়সে তাকে একটা ব্রেক দেব, গ্যাপ দেব। তারপর আবার যখন ফিরবে তখন নায়িকা হয়ে ফিরবে। তাকে একদম তৈরি করে ফেরাব’। আমার খুব ভালো লেগেছিল এটা শুনে। একটা মেয়ে বাচ্চাকে নিয়ে যখন এমন প্ল্যান করা হয়, তাকে একদম ছেড়ে না দিয়ে, তার সঙ্গে সাপোর্টিভ হয়ে যদি একটা কিছু করা যায়, অবশ্যই একটা ভালো রেজাল্ট আসে।’ নিজের ছেলে ফারদিন এহসান স্বাধীনকে চলচ্চিত্রে অভিনয়ে উৎসাহিত করেছিলেন বলে জানান মৌসুমী। তবে অভিনয়ের চেয়ে নির্মাণের দিকে বেশি আগ্রহী ফারদিন কয়েকটি টেলিফিল্মও বানিয়েছেন। অন্যদিকে মেয়ে ফাইজার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল না বলে জানান মৌসুমী। যাই হোক, পরিশেষে বলতে হয়, পিতামাতার পথ ধরে সন্তানদের চলচ্চিত্রে না আসার অনেক কারণ থাকলেও এটি যে অবশ্যই এ শিল্পের জন্য ইতিবাচক নয় তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।