আমাদের লোকশিল্পের একটি প্রাচীন অনুষঙ্গ ‘হাতপাখা’। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক ও নির্মাণশৈলীতে হাতপাখা তৈরি হলেও চট্টগ্রামের চন্দনাইশের হাতপাখার রয়েছে আলাদা কদর। উপজেলার হারলা জিহস ফকিরপাড়া ও দক্ষিণ সাতবাড়িয়ার কদমপাড়া গ্রামের মানুষের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন হাতপাখা তৈরি। এই দু’গ্রামের পাঁচ শতাধিক হস্তশিল্পী তাদের নিপুণ শিল্পশৈলী দিয়ে এ হাতপাখা তৈরি করে থাকেন। প্রায় দেড়শ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় তারা হয়ে ওঠেন পাখাশিল্পী। বছরের অধিকাংশ সময় তারা পাখা তৈরির কাজে লিপ্ত থাকেন। একটি পাখার ন্যূনতম মূল্য ৭০ টাকা। এ হিসেবে দৈনিক দেড় থেকে দুই লাখ টাকার হাতপাখা উৎপাদন হয় ঐ দুই পাখাপল্লীতে। প্রতিদিন দূর-দূরান্তের হাতপাখা ব্যবসায়ীরা ছুটে আসেন পাখাপল্লীতে। এখান থেকে হাতে বোনা পাখা পাইকারিমূল্যে নিয়ে যান তারা। সম্প্রতি জিহস ফকিরপাড়া ও দক্ষিণ কদমপাড়া গ্রামে সরেজমিনে ঘুরে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, এই দুই গ্রামের মানুষের জীবন-জিবীকা নির্বাহ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সাধ-আহ্লাদ সবকিছু হাতপাখা-কে ঘিরেই আবর্তিত। তালপাতা দিয়ে তৈরি এখানকার এক জোড়া হাতপাখা ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা করে বিক্রি করা হয়। ক্ষেত্রে বিশেষে তা আরও বেশিও হয়ে থাকে। অতীতে এই দুই গ্রামের অনেকে হাতপাখা বিক্রি করে সাবলম্বী হলেও ইদানিং দেশের অধিকাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন হওয়ায় হাতপাখার চাহিদা খানিকটা কমে গেছে বলে জানান পাখাশিল্পীরা। তারপরও বংশগত ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন দুই গ্রামের লোকেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক জব্বার মিয়ার বলীখেলা ও অন্যান্য বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রীষ্ম মৌসুমে অন্তত ৫ লাখ হাতপাখা বিক্রি হয় এই দুই পাখাপল্লী থেকে। আগামী বৃহষ্পতি থেকে শনিবার (২৩ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল) তিনদিন ব্যাপী জব্বার মিয়ার বলীখেলা অনুষ্ঠিত হবে। শতবছর ধরে প্রতি ১০ থেকে ১২ বৈশাখ এই তিনদিন ঐতিহ্যবাহী এই খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বলী খেলার আগে-পরে অন্তত ১০ দিন চন্দনাইশের এই হাতপাখার বেচাবিক্রির ধুম পড়ে। দেশের নানা প্রান্তের লাখো মানুষ এই মেলায় যোগ দেন। যাদের অধিকাংশই অন্তত একটি হলেও হাতপাখা কিনে বাড়ি ফেরেন। খেলায় আগতদের হাতপাখা কেনা একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রামসহ আশ-পাশের জেলার মানুষ সাংবার্ষিকের জন্য ফুলের ঝাড়ু, নারকেলের শলার ঝাঁটার পাশাপাশি নিদেনপক্ষে একজোড়া হাতপাখ ক্রয় করেন এই মেলা থেকে। মেলায় দর্শনার্থীদের চন্দনাইশের তৈরি তালপাতার পাখা হাতে ঘুরে ফিরে সদাই করতে দেখা যায়।
জিহস ফকিরপাড়ার প্রবীণ পাখাশিল্পী আবুল কালাম বলেন, ‘তালপাতার কারুশিল্পে সাফল্য লাভ করায় বাংলাদেশ কারুশিল্প ২০০২ সালে আমাকে ও সহকর্মী বাবুলকে জাতীয় পুরস্কার দিয়েছে। সরকারি সহায়তা পেলে এ শিল্পকে গ্রামীণ কুটিরশিল্পে উন্নীত করে আরও সুনামের সাথে রক্ষা করা যাবে। স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা করে এবং হাতপাখা শিল্পীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের এই লোকশিল্পকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করা যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস।’
সরেজমিন জানা যায়, এই দুই গ্রামের নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরী সবাই দিনের একটি অংশ হাতপাখা তৈরির পিছনে ব্যয় করেন। ৯ তারী, ১১ তারী, ১৩ তারী ও ১৫ তারী মডেলের পাখা তৈরি করেন তারা। তবে ৯ তারী ও ১১ তারী মডেলের পাখার চাহিদা বেশি বলে এই দুই মডেলের পাখাই বেশি তৈরি হয়। একটি পরিবার দৈনিক ২-৩ ডজন করে হাতপাখা তৈরি করে থাকেন। এর মধ্যে কিছু পাখা তৈরি হয় রঙবিহীন তালপাতা দিয়ে, কিছু হয় রঙিন ও নকশাকারে। পরিবারের সব সদস্য মিলে উঠানে না হয় ঘরের দাওয়ায় বসে হাতপাখা তৈরির কাজ করছে। এ গ্রামের প্রায় সবারই বাড়ির আশপাশ ও আঙিনাজুড়ে শোভা পাচ্ছে হাতপাখা তৈরির তালপাতা, বাঁশ, বেতসহ যাবতীয় উপকরণ। পাখাপল্লীর ৯৫ শতাংশ পরিবারের প্রায় সবারই পেশা তালপাতায় হাতপাখা বানানো। তীব্র তাপদাহে তালপাতার হাতপাখার শীতল হাওয়া অন্যের শরীরে ¯^স্তি জোগালেও তীব্র গরমে পাখাশিল্পীরা ঘেমে-নেয়ে ব্যস্ত রয়েছেন পাখা তৈরির কাজে।
জানা গেছে, পরিবারের প্রধান ব্যক্তিটিই পাখা তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করে দেয়। এরপর বাড়ির নারী, পুরুষ ও শিশু সবাই মিলে পাখা তৈরির যাবতীয় কর্মটি সম্পন্ন করে। হাতপাখা তৈরির প্রধান উপকরণ হলো তালপাতা, বাঁশ, বেত ও রঙ। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য জেলাগুলোর বনাঞ্চল থেকে বাঁশ-বেত সংগ্রহ করা গেলেও তালপাতা সংগ্রহ করতে হয় নোয়াখালী ও কুমিল্লার প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। প্রতিটি তালগাছের পাতা কিনতে হয় দুই থেকে তিনশ টাকার বিনিময়ে। তারপরও চন্দনাইশের পাখাপল্লীর হাতপাখার দেশব্যাপী চাহিদা থাকায় চড়াদামে পাতা কিনে পাখা তৈরি করতে হচ্ছে।
জিহস ফকিরপাড়া গ্রামের লায়লা বেগম জানান, চট্টগ্রামের বিয়ে-শাদীতে এখনও কনেপক্ষ বরপক্ষকে অন্তত একজোড়া হাতপাখা উপহার হিসেবে দিয়ে থাকেন। পাখা উপহার দেওয়ার এই রেওয়াজটা এ শিল্প টিকে থাকার ক্ষেত্রে সহায়ক ভ‚মিকা রাখছে। বর্তমানে দেশের চাহিদা ছাড়াও চীন, জাপান, কোরিয়া রপ্তানির জন্য এ হাতপাখার নমুনা পাঠানো হয়েছে বলে কুটির শিল্প সূত্রে জানা গেছে।
তবে ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাঙালিদের জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্বল্পসংখ্যক হাতপাখা রপ্তানি করা হয়ে থাকে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সম্ভাবনাময় হাত পাখাশিল্পকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে তোলা সম্ভব হলে কর্মসংস্থান হবে আরো হাজারো লোকের। দেশীয় পণ্য রপ্তানির তালিকায় স্থান পাবে আরো একটি হস্তশিল্প পণ্য। অর্জিত হবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। আর এজন্য প্রয়োজন হাতপাখা তৈরিতে নিয়োজিতদের ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা, কারিগরি সহায়তা প্রদান এবং সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া। এসব সহযোগিতার পাশাপাশি একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় এনে হাতপাখা শিল্পের বিকাশে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে সম্ভাবনাময় এ শিল্পের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়বে সারাবিশ্বে এমনই প্রত্যাশা পাখাপল্লীর বাসিন্দাদের।
বিডি-প্রতিদিন/ ২১ এপ্রিল, ২০১৫/ রশিদা