ভূগর্ভস্থ দু'টি টেকটোনিক প্লেটের রেষারেষিতে শনিবার কেঁপে ওঠে নেপালসহ এশিয়ার দেশগুলি। প্রবল ঝাকুনিতে মুহূর্তে ধসে পড়ে বহুতল ভবন, ব্রিজসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ফেটে যায় সড়ক। হাজারো মানুষের মৃত্যু উপত্যাকায় পরিণত হয় হিমালয় পাদদেশের নেপাল নামের দেশটি। ভূমিকম্পে প্রাণহানি হয়েছে ভারত, বাংলাদেশ এমনকি এভারেস্টের চূড়ায়ও। উদ্ধার অভিযানে সামিল হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, সংস্থা। সামিল হয়েছে বাংলাদেশও।
শনিবারের ভূমিকম্পের উৎসস্থল কাঠমান্ডু থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নির্জন পাহাড়ি এলাকায় মাটির ১১ কিলোমিটার গভীরে। ভূগর্ভস্থ যে প্লেটগুলির উপরে অবস্থান করছে মহাদেশ ও মহাসাগরগুলি, তার মধ্যেই দু’টি প্লেটের রেষারেষির ফল এ দিনের ভূমিকম্প। বিজ্ঞানের ভাষায় ভূগর্ভের উত্তপ্ত তরল বা লাভার ওপর ভাসমান কিছু টেকটোনিট প্লেটের ওপর মহাদেশ ও মহাসাগরগুলোর অবস্থান। প্লেটগুলোর চলাচল বা নড়াচড়ার সময় সংঘর্ষ বা ঘর্ষণ হলেই কেঁপে ওঠে ভূপৃষ্ঠ। এটাই ভূমিকম্প। আর এ ভূমিকম্পে কখনো সাগর ফুড়ে জেগে ওঠে ভূপৃষ্ঠ। কখনো মহাদেশও হারিয়ে যেতে পারে সাগরের গভীরে।
ভূমিকম্পের কারণ, উৎপত্তিস্থল ও মাত্রা নির্ণয় সম্পর্কিত আধুনিক সরঞ্জামগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, শনিবার দুপুরে ভারতীয় প্লেটটি পিছলে ঢুকে যায় ইউরেশীয় প্লেটের নীচে। সেই প্রক্রিয়ায় যে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তার জেরেই কেঁপে ওঠে কাঠমান্ডু থেকে দিল্লি। কম্পন কোথাও স্থায়ী হয় এক মিনিট, কোথাও দেড় মিনিট, কোথাও বা দু’মিনিট। আর ধ্বংসলীলার পক্ষে এটুকু সময়ই ছিল যথেষ্ট। কারণ দু’প্লেটের এই স্থান পরিবর্তনে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়েছে, তার কাছে পরমাণু বোমাও নস্যি।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিরোশিমায় যে পরমাণু বোমাটি ফেটেছিল, তার থেকে নির্গত হয়েছিল ২০ হাজার টন টিএনটি-র শক্তি। আর শনিবার রিখটার স্কেলে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে শক্তি বিচ্ছুরণের পরিমাণ তার থেকেও ৫০০ গুণ বেশি। হিসেব অনুযায়ী সেটা এক কোটি টন টিএনটি-র শক্তি।
২০০৪ সালে সুনামির সময়ে ৯.১ মাত্রার ভূমিকম্পে একই পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়েছিল। এ দিনের ভূমিকম্পকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় 'অতি বড়' ভূমিকম্প বলে চিহ্নিত করছেন বিজ্ঞানীরা।
কীভাবে অতি বড় মাপের ভূমিকম্পটি তৈরি হল- এর বিশ্লেষণে ভারতীয় খড়গপুর আইআইটির ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ শঙ্করকুমার নাথ জানান, হিমালয় তৈরি হওয়ার সময় থেকেই ভারতীয় প্লেট এবং ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে কে কার নীচে পিছলে যাবে। এর ফলেই ওই দু’টি প্লেট বরাবর তৈরি হয়েছে কয়েকটি ফাঁটল। কয়েকটি ফাঁটল বেশ বড় মাপের। ভূমিকম্পগুলো তৈরি হয় এই ফাঁটলগুলোতে অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয়ের জন্য।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, দু’টি প্লেটের মধ্যে নিরন্তর ঘর্ষণের ফলে এই ফাঁটলগুলোতে সব সময় শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। স্বভাবতই ফাঁটলগুলোতে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ বেশি। কোনও ফাঁটলে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ যখন সম্পৃক্ত হয়ে যায় তখন আরও শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ওই ফাঁটলে ঝাঁকুনি হয় (চিনি দিয়ে ভর্তি একটি বোতলে অতিরিক্ত চিনি ভরার সময় যেমন ঝাঁকুনির প্রয়োজন হয়, তেমনই)। তখনই একটি প্লেট অন্য একটি প্লেটের নীচে পিছলে যায়। যে খাঁজে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ যত বেশি, ঝাঁকুনির ফলে সেখানে তত বেশি মাত্রার ভূমিকম্প তৈরি হয়। এ রকমই একটি ফাঁটলে ঝাঁকুনির ফলই হল এ দিনের ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প।
ভূ-বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, হিমালয়ে এই ধরনের তিনটি ফাঁটল রয়েছে। প্রধান কেন্দ্রীয় (মেন সেন্ট্রাল), প্রধান প্রান্তীয় (মেন বাউন্ডারি) এবং হিমালয়ের পৃষ্ঠদেশীয় (ফ্রন্টাল)। শঙ্কর কুমার নাথ জানান, শনিবারের ঝাঁকুনিটি হয়েছে প্রধান প্রান্তীয় ফাঁটলে। ওই ঝাঁকুনির ফলে যে বিপুল পরিমাণ শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটেছে, তা-ই নাড়িয়ে দিয়েছে নেপালের পাশাপাশি প্রতিবেশী আরও চারটি দেশকে।
এ দিন আধ ঘণ্টার ব্যবধানে দু’বার জোরে কেঁপেছে নেপাল থেকে পাশের দেশগুলো। তা হলে কি পরপর দু’টি ভূমিকম্প হয়েছে নেপালে?
ভূ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, একটি বড় ভূমিকম্পের পরে অনেকগুলি আফটার শক হয়। অর্থাৎ, ভূমিকম্প শেষ হলেও কয়েকটি ছোট কম্পন রয়ে যায়। সেগুলির জন্য অনেকের মনেই ভুল ধারণা তৈরি হয়। তারা ভাবেন, নতুন করে ভূমিকম্প হল। আসলে যে ভূমিকম্পের শক্তি যত বেশি, তার তৈরি ভূমিকম্পনোত্তর কম্পনও তত বেশি।
শঙ্কর কুমার জানান, এ দিনের ভূমিকম্পের পরে অন্তত ২০টি ভূমিকম্পনোত্তর কম্পন তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে প্রথমটির শক্তি ছিল বেশি।
বিডি-প্রতিদিন/২৬ এপ্রিল ২০১৫/এস আহমেদ