নানা ধর্ম আর বর্ণের ১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশ। ৬৮ হাজার গ্রামের এই বাংলায় রয়েছে নানা সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। যুগ যুগ ধরে চলে আশা এইসকল সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে বাঙ্গালীর প্রাণ। প্রকৃতির নিয়মে মানুষ হারিয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি বাঙ্গালীর এই সকল ঐহিত্য। তারই ধারাবাহিকতায় শত শত বছর ধরে টাঙ্গাইলের রসুলপুরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে “জামাই মেলা”।
প্রতিবছর ১২ ও ১৩ ই বৈশাখ টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার রসুলপুরে অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা। মূল মেলা দুইদিনব্যাপী চললেও মেলায় আগত ফার্নিচার মেলা চলে মাসব্যাপী। রসুলপুরের বাছিরন নেছা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আয়োজন করা হয় এই মেলার। রসলপুরসহ আশেপাশের ৩০টি গ্রামের সহ প্রায় কয়েক লাখ লোকের সমাগম ঘটে এই মেলায়। নামে জামাই মেলা হলেও এই মেলায় জামাই বিক্রি করা হয় বলে অনেকে ভুল করতে পারেন। মনে প্রশ্ন জাগতে পারে জামাই মেলা নাম হলো কেন? এর উত্তর রসুলপুরের বৃদ্ধ-বনিতারাও বলতে পারেন না। তবে তাদের বাবা-দাদার মুখে এই মেলার কথা শুনেছেন বলে দাবি তাদের। স্থানীয় মেয়েদের বরদের নিয়ে এই মেলার আয়োজন করা হয় বলেই ঐতিহ্যবাহী এই মেলাটি জামাই মেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে বৈশাখী মেলা হিসেবে শুরু হলেও জামাইদের আপ্যায়ন করা হয় বলে একসময় মেলাটি পরিচিতি পায় জামাই মেলা হিসেবে, এমনটিই বললেন এই এলাকায় জন্ম নেয়া কথা সাহিত্যিক রাশেদ রহমান। তিনি বলেন, এই মেলার উৎপত্তি কবে সেটা কেউ জানে না। যুগ যুগ ধরে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আগে এই মেলায় আশেপাশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে আসতো। কিন্তু এখন যুগের সাথে সাথে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ী আর দর্শনার্থীরা এই মেলা দেখতে আসে। এই এলাকার মুসলমানদের কাছে ঈদ আর হিন্দুদের পূজা পার্বনের থেকেই এই মেলা বেশি উৎসবের।
দুই দিনব্যাপী এই মেলার প্রথম দিনকে বলা হয় জামাই মেলা, আর দ্বিতীয় দিন বউ মেলা। মেলাকে সামনে রেখে রসুলপুর ও এর আশেপাশের বিবাহিত মেয়েরা তাদের বরকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসে। আর মেয়ের জামাইকে মেলা উপলক্ষে বরণ করে নেবার জন্য শাশুড়ীরা কয়েক মাস আগে থেকেই নেয় নানা প্রস্তুতি। মেলার সময় জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দেয় শাশুড়ীরা। আর সেই টাকার সাথে আরও টাকা যোগ করে এলাকার জামাইরা মেলা থেকে মাটির তৈরি বড় কলসি ভরে কেনেন চিড়া, মুড়ি, আকড়ি, মিষ্টি, জিলাপীসহ নানা জিনিস। ঘর সাজানোর নানা তৈজসপত্রও কেনেন মেয়েরা। জামাইয়ের কেনা সেই মিষ্টি বিলি করা হয় আশেপাশের বাড়িতে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা জামাইরা এতে হয় অভিভূত।
সোহাগ নামের স্থানীয় একজন জানান, মেলার সময় রসুলপুরসহ আসেপাশের গ্রামগুলোর বিবাহিত সব মেয়েদের জামাইদের নিমন্ত্রণ করা হয়। সাথে তাদের পরিবারের সদস্যদেরও। মেলার ৭দিন আগে থেকেই জামাইরা আসতে শুরু করে। আর মেলার প্রথম দিন শাশুড়ী জামাইয়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দেন। আর জামাইরা মেলায় গিয়ে সেই টাকার সাথে আরও কিছু টাকা যোগ করে মেলা থেকে শশুর বাড়ির জন্য বাজার করে। সাথে মুড়ি, আকড়ি, মিষ্টি, জিলাপীসহ নানা স্বাদের খাবার কেনে। আমরাও এলাকার জামাইদের যথাসাধ্য আপ্যায়নের চেষ্টা করি। আর মেলার দ্বিতীয় দিন এলাকার সব মেয়েরা মেলায় ঘুরতে আসে। তাই সেদিনকে বলা হয় “বউ মেলা”।
আসাদ নামে এলাকার এক জামাই জানান, মাসখানেক আগে থেকেই শশুর বাড়ি থেকে মেলায় আসার জন্য দাওয়াত দিচ্ছিলো। না আসলে সবাই মন খারাপ করে। তাই বাধ্য হয়েই অফিস ছুটি নিয়ে ঢাকা থেকে এসেছে। তবে এসে ভালোই লাগে। সবার সাথে অনেক আনন্দ করা যায়।
মেলাকে সামনে রেখে ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য আয়োজন করা হয় নানা বিনোদন ব্যবস্থার। মেলায় থাকে কসমেটিকস, খেলনা, খাবারের দোকানের স্টল। আর মেলায় প্রধান আকর্ষণ হিসেবে থাকে হোন্ডা খেলা। শুধু তাই নয়, ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় ব্যাবসা করতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসেন ব্যবসায়ীরা। খুব বেশি লাভের মুখ নানা দেখলেও গ্রাম বাংলার অতীত ঐতিহ্যের সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিতে আসেন তারা।
বগুড়া থেকে মেলায় ফার্নিচার নিয়ে আসা আলম নামের এক ব্যবসায়ী জানান, গত ১৫ বছর ধরে প্রতিবছর এই মেলায় কাঠের তৈরী নানা রকমের আসবাবপত্র বিক্রি করতে আসি। মেলায় বেচাকেনা ভালোই হয়। তবে খুব বেশি লাভ না হলেও এই এলাকার মানুষদের সাথে মেলায় আনন্দ করতে পেরে ভালোই লাগে। মূল মেলা দুদিনে শেষ হয়ে গেলেও আমাদের আসবাবপত্রের বেচাকেনা প্রায় মাসখানেক চলে।
বাপ-দাদার গ্রামীণ ঐহিত্য ধরে রাখতে পেরে খুশী মেলার আয়োজকরা। পূর্বে এই মেলা সপ্তাহব্যাপী হলেও বর্তমানে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হওয়ায় ৭দিনের মেলাকে দুই দিনে নিয়ে আসা হয়েছে বলে জানান মেলার আয়োজক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হাশেম। তিনি বলেন, আগের দিনে এই এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বৈশাখ মাসে এই মেলার আয়োজন করতো। কিন্তু কালক্রমে এই মেলা হিন্দু-মুসলমান সব মতৈক্য ভেঙ্গে এই এলাকার সর্বস্তরের মানুষের প্রাণের মেলা হিসেবে রুপ নিয়েছে। আগে এই মেলা ৭ দিনব্যাপী আয়োজন করা হলেও বর্তমানে রসুলপুর বাছিরন নেছা বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়ায় ৫ দিন কমিয়ে মেলার স্থায়ীত্ব দুই দিনে নিয়ে আসা হয়েছে।
একসময় এই মেলায় পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো থেকে ব্যবসায়ীরা আসলেও বর্তমানে এই টেকনাফ-তেঁতুলিয়া থেকেও এখানে ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে আসে। মেলায় আমাদের নিজস্ব ভলানটিয়ারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সদস্যরাও থাকে। এবারের মেলায় প্রায় শতাধিক আসবাবপত্রের স্টল রয়েছে। পাশাপাশি মিষ্টি, আকরি সহ অন্যান্য খাবার দোকানের স্টল, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় গৃহস্থালী জিনিসপত্রের স্টল, ছোট বাচ্চাদের খেলনার স্টল সহ প্রায় একহাজার স্টল অংশ নিয়েছে। আমরা আশা করি প্রতি বছরের মতো এবারের মেলাতেও প্রায় কোটি টাকার পণ্যের বেচা-কেনা হবে।
ঐতিহ্যবাহী এ মেলা আজ রসুলপুর ও এর আশেপাশের এলাকার মানুষের প্রধান উৎসবে পরিণত হয়েছে। টাঙ্গাইলের গ্রামাঞ্চলের অন্যান্য মেলায় কিশোরী-যুবতী-নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ চোখে না পড়লেও রসুলুপরের জামাই মেলায় নারী-পুরষ সবাই আসেন-কেনেন পছন্দের পন্য। আর তাই দিন দিন এই মেলা হয়ে উঠছে আরও বৈচিত্রময়।
বিডি-প্রতিদিন/ ২৭ এপ্রিল, ২০১৫/ রশিদা