শনিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

সংকটের শেষ নেই হাসপাতালে

ঠাঁই নেই আইসিইউতে, মিলছে না সাধারণ শয্যা, অক্সিজেন সংকটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে রোগী ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ও মৃত্যু হার বাড়াচ্ছে উদ্বেগ, সেবা পাচ্ছে না অন্য জটিল রোগীরাও

জয়শ্রী ভাদুড়ী

সংকটের শেষ নেই হাসপাতালে

সকাল থেকে চার-পাঁচ হাসপাতাল ঘুরে শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে পেরেছেন উম্মে হানি (৩০)। পাশে স্বামী আবু দাউদ হাত ধরে সাহস জোগাচ্ছেন। গতকাল ছবিটি ঢাকা মেডিকেল থেকে তোলা -জয়ীতা রায়

কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা আমির হোসেনের (৬০) জ্বর, কাশিসহ করোনার বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিলে নমুনা টেস্ট করতে দেন স্বজনরা। ৪ এপ্রিল করোনা পজিটিভ রিপোর্ট এলে স্বজনদের দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। এর মধ্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার। রোগী নিয়ে হাসপাতালের দুয়ারে ঘুরতে থাকেন স্বজনরা। পাঁচটি হাসপাতাল ঘুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেলে একটি শয্যা।

রোগীর স্বজন আল আমিন চৌধুরী বলেন, হাসপাতালে ভর্তির পর ওষুধ, ইনজেকশন শুরু হয়। কিন্তু রোগীর শ্বাসকষ্ট বেড়েই চলছিল। সাধারণ শয্যায় কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা না থাকায় সিলিন্ডারের জন্য ছোটাছুটি শুরু হয়। অনেক খুঁজে বিভিন্ন জায়গায় অনুরোধ করে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার মিললেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে থাকেন রোগী। ভোরের দিকে একজন চিকিৎসক এসে বলেন দ্রুত রোগীকে আইসিইউতে নিতে হবে। কিন্তু রাজধানীর ১০টি সরকারি হাসপাতালে খুঁজে একটি আইসিইউর ব্যবস্থা আমরা  করতে পারিনি। একসময় অক্সিজেনের জন্য ছটফট করতে করতে আমাদের চোখের সামনে রোগী মারা যান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে দায়িত্বরতরা জানিয়েছিলেন কোনো আইসিইউ ফাঁকা নেই। অথচ স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া হয়েছে চারটি আইসিইউ ফাঁকা, গতকালও দেখানো হয়েছে তিনটি ফাঁকা আইসিইউ। কিন্তু রোগী নিয়ে গেলে মিলছে না আইসিইউ।

শুধু এই রোগী নন, কভিড-ননকভিড সব রোগীই পড়েছেন বিপাকে। সিএনজি কিংবা অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন রোগের কঠিন যন্ত্রণা নিয়ে। একটি সিটের জন্য তাদের কাতর অপেক্ষা। গত রাতে একজন প্রবীণ সাংবাদিক ঢাকার চারটি হাসপাতাল ঘুরেছেন একটি বেডের জন্য। রাতভর পুরো ঢাকা শহর ঘুরে অবশেষে পঞ্চম হাসপাতালে গিয়ে মিলেছে একটি বেড। অনেক রোগীর কপালে তাও জুটছে না। হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতেই নিভে আসছে জীবনপ্রদীপ। করোনা রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় এবং সংক্রমণের ভয়ে অন্য জটিল রোগীরাও সেবা পাচ্ছেন না। প্রয়োজনে মিলছে না আইসিইউ। তাই করোনা আক্রান্ত না হলেও অন্য রোগে সেবা না পেয়ে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হন। এরপর বাড়তে থাকে সংক্রমণ। জুন-জুলাইতে সংক্রমণ গতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। জুলাইতে সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু এ রেকর্ড ভেঙে গত বৃহস্পতিবার দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সংক্রমণে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে রেকর্ড। গতকালও মারা গেছেন ৬৩ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬২ জন। এ বিপুল পরিমাণ রোগীর চিকিৎসা দিতে হাসপাতালগুলোয় তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ সংকট। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হওয়ার তিন দিন পার না হতেই অনেক রোগীর শারীরিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফুসফুস। শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে রোগী। প্রয়োজন হচ্ছে হাই ফ্লো অক্সিজেন ও আইসিইউর। কিন্তু শয্যা সংকটে মিলছে না চিকিৎসা। এর মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক চিকিৎসক, নার্স দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে স্বল্প জনবল, স্বল্প শয্যায় বিপুলসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো।

করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের বড় সরকারি সাত হাসপাতাল এবং বেসরকারি সাত হাসপাতালের কোথাও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) শয্যা ফাঁকা নেই। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ১৬, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতলের ১০, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভারের ১৬, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৬, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৯, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ বেডের সব কটিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০ বেডের আইসিইউতে রোগী ভর্তি আছেন ২১ জন। বেডের অতিরিক্ত রোগী ভর্তি সেখানে। কেবল নতুন স্থাপিত শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ফাঁকা রয়েছে মাত্র চারটি। সরকারি ১০ হাসপাতালের মোট ১৩২টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ফাঁকা রয়েছে মাত্র তিনটি, রোগী ভর্তি আছেন ১২৯ জন।

এত দিন বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আইসিইউতে কিছুটা ফাঁকা থাকলেও সেখানেও ফাঁকা বেডের সংখ্যা শূন্য হতে শুরু করেছে। আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২২, আসগর আলী হাসপাতালের ১৮, ইবনে সিনা হাসপাতালের ৭, ইউনাইটেড হাসপাতালের ১৫, ইম্পালস হাসপাতালের ৫২, এ এম জেড হাসপাতালের ১০ ও বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ৯টি বেডের সব কটিতে রোগী ভর্তি আছেন। কেবল স্কয়ার হাসপাতালের ১৯ বেডের মধ্যে চারটি এবং এভারকেয়ার হাসপাতালের ২১টির মধ্যে ১০টি বেড ফাঁকা রয়েছে। হাসপাতালগুলোর ১৭৩টি আইসিইউ বেডে রোগী ভর্তি আছেন ১৫৯ জন এবং বেড ফাঁকা রয়েছে মাত্র ১৪টি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকাভুক্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মোট ৩০৫টি আইসিইউ বেডে রোগী ভর্তি আছেন ২৮৮ জন এবং বেড ফাঁকা রয়েছে মাত্র ১৭টি। ঢাকা ছাড়া এত দিন দেশের অন্য হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ বেড ফাঁকা থাকলেও সেখানে রোগী ভর্তি হতে শুরু করেছে, কমতে শুরু করেছে ফাঁকা বেডের সংখ্যা। সারা দেশের অন্য হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ বেড রয়েছে ৬০০, তাতে রোগী ভর্তি আছেন ৪৪৫ জন এবং বেড ফাঁকা রয়েছে ১৫৫টি। গতকাল সারা দেশের করোনা রোগীদের জন্য শয্যা ছিল ৯ হাজার ৯৯২টি, আইসিইউ ছিল ৬০০। ঢাকার হাসপাতালে শয্যা ছিল ৩ হাজার ৬২২টি, আইসিইউ ছিল ৩০৫টি।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বছরের মার্চে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আমরা রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় আরও ১০০ আইসিইউ শয্যা সংযুক্ত করছি। এর মধ্যেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১০টি করে আইসিইউ শয্যা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া মহাখালী ডিএনসিসি মার্কেট হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর কাজ চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বাড়ানো সমস্যা নয়, সমস্যা দক্ষ জনবলের। আইসিইউ ইউনিট চালানোর জন্য বিশেষ দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও ব্রাদার প্রয়োজন। আমাদের জনবলের সংকট এখনো রয়েছে।’

এ বছর মার্চের শুরু থেকে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। ২৮ ফেব্রুয়ারি রোগী শনাক্তের হার ছিল ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। পর দিন ১ মার্চ শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৩১। গতকাল করোনা সংক্রমণের হার ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ৩১ হাজার ৬৫৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৭ হাজার ৪৬২ জনের শরীরে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। গত তিন দিনে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২১ হাজার ৯৪২ জন। অথচ সারা দেশে সাধারণ শয্যা আছে ৯ হাজার ৯৯২টি। অধিকাংশ করোনা রোগী বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এর মধ্যে যেসব রোগীর হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ছে তারা পড়ছেন বিপাকে। হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে অবস্থার অবনতি হচ্ছে রোগীর। বাড়ছে করোনায় মৃত্যু। গত তিন দিনে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২০০ জন। এ ব্যাপারে কভিড-১৯বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনার সঙ্গে আমাদের লড়াই চলছে। গত বছরও হাসপাতালে আইসিইউ সংকট ছিল, এ বছরও আছে। ২৮টি জেলায় আইসিইউ আছে, ৩৬টি জেলায় নেই। এ জেলার রোগীরা বাঁচার আশায় ঢাকায় আসছেন। ঢাকায় তো সংক্রমণ বেশি, আগে থেকেই সংকট আছে। রোগীরা এত পথ পাড়ি দিয়ে এসে দেখছেন আইসিইউ নেই। আইসিইউ সংকটে, অক্সিজেনের অভাবে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে, বাড়ছে মৃত্যু। সময় গেলেও আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর