মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ অব্যাহত । তিন মাসের ব্যবধানে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে তিনবার। ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বাড়তে থাকায় নতুন করে বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা জানিয়েছেন, ব্যক্তি খাতে ঋণের সুদহার আরও বাড়বে যা ব্যবসা পরিচালনার খরচ আরও বাড়িয়ে দেবে। শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশেষ নজর দিতে হবে। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদহার বাড়ানোর সুফল পেতে অপেক্ষা করতে হবে আরও ৫-৬ মাস। দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মনে করেন, সুদহার বাড়ালেই মূল্যস্ফীতি কমবে। ব্যবসায়ী হিসেবে আমার কাছে মনে হয় না সুদহার বাড়ালেই মূল্যস্ফীতি কমবে। দেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে। ৭০ শতাংশ মানুষ ব্যাংকেই যায় না। সেখানে সুদহার বাড়ালে কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে। বরং সুদহার বাড়লে জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ে। আমাদের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি, জ্বালানি পুরোটাই আমদানি করতে হয়। নতুন করে কোনো বিনিয়োগ হবে না। দেশে কার্যরত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে সুদহারে ঋণ নিয়ে থাকে তাকে নীতি সুদহার বলা হয়। চলতি অর্থবছরের শুরুর দিকে এই নীতি সুদহার ছিল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। আগস্টে তা বেড়ে ৯ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে বেড়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ হয়। সবশেষ অক্টোবরে নীতি সুদহার বেড়ে ১০ শতাংশ হয়েছে। আগামী মাসে বাড়তে পারে আরও দশমিক ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বিভিন্ন সময় বলেছেন, আগামী বছরের জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে নীতি সুদহার বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্তকে নেতিবাচকভাবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, নীতি সুদহার বাড়লে ব্যক্তি খাতে ঋণের সুদহার বাড়বে। যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। এ বিষয়ে পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন ঋণের সুদহার ১৬ শতাংশের ওপরে। কয়েকদিন আগে নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে ঋণের সুদহার ১৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে। ১৭ বা ১৮ শতাংশ সুদ দিয়ে কোনো ব্যবসায়ী টিকে থাকবে এটা কোনোভাবেই আশা করা যায় না। ফলে শিল্প ধ্বংস হয়েছে, অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা পঙ্গু হবে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নীতি সুদহার বৃদ্ধির ফলে নতুন বিনিয়োগ স্থবির হবে। নতুন করে কোনো কর্মসংস্থানও তৈরি হবে না। তবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তারা। এ বিষয়ে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইনট্র্রিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে একটু সময় দিতে হবে। মূল্যস্ফীতি যদি কমিয়ে আনা যায়। রিজার্ভ যদি আরেকটু বাড়ে, তাহলে সুদহার আবার স্বস্তিদায়ক অবস্থায় চলে আসবে। তখন নতুন বিনিয়োগ আসবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে। আগের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতির এই হার ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আর জুলাই মাসে ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। একইভাবে সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাইয়ে ছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। কাগজে কলমে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাজারে পণ্যের দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। ড. আবদুর রাজ্জাক আরও বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার শক্তভাবে এই নীতিগুলো নেয়নি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকার পর বিশাল আকারের বাজেট দিয়েছে। টাকা ছাপিয়ে মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘি ঢেলেছে। দু-একটি পণ্যের দাম দেখে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বোঝা যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের নীতিগুলো কেমন কাজ করছে সেটা বোঝার জন্য আরও ৫-৬ মাস সময় লাগবে।