দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। গতকাল ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শেষে ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠকে ১৯ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ ঐকমত্য এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য বা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তা জুলাই জাতীয় সনদে পরিণত করতে হবে। তিনি বলেন, ডিসেন্টসহ যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তা হলো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে অর্থবিল ও আস্থা ভোটের সঙ্গে সংবিধান সংশোধন ও জাতীয় নিরাপত্তা (যুদ্ধপরিস্থিতি) যুক্ত করা, নারী প্রতিনিধিত্ব, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ ও সুপ্রিম কোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ, পিএসসি, দুদক, সিএঅ্যান্ডজি এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে সংযোজন না করে সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা, উচ্চকক্ষ গঠন, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে উত্থাপিত সমন্বিত প্রস্তাবের ৮, ৯, ১১ এবং ১২ ক্রমিক নম্বর, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, সুরক্ষা এবং বাস্তবায়নে সাংবিধানিক ও আইনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, নারীদের আসন বৃদ্ধির প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিষয়ে গণফোরাম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), বাসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নোট অব ডিসেন্ট প্রদানসহ সভা বর্জন করে। এ ছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এ ইস্যুতে ভিন্নমত প্রদান করে। তিনি আরও জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তা বাস্তবায়নের পথ নিয়ে আলোচনা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কমিশনও মনে করে যে কোনো প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পথপদ্ধতি চিহ্নিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, ঐকমত্য কমিশন এ বিষয়ে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে জুলাই সনদ তৈরি করতে শেষ মুহূর্তের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। নোট অব ডিসেন্ট, বিরোধিতা আর বিভেদের মধ্যেই শেষ হয়েছে কমিশনের গতকালের বৈঠক। মৌলিক অনেক বিষয়েই রাজনৈতিক দলগুলো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একমত হতে পারেনি। কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে কমিশন। এ নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না দিলে কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করারও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। প্রয়োজনে আবারও আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বিএনপি দাবি করেছে, সংস্কার প্রস্তাবের আইনি ভিত্তি দেওয়া নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে গতকাল রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ২৩তম দিনের আলোচনার শুরুতে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে কথা বলেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রধান এবং মৌলিক দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতাদের। আমরা বিশ্বাস করি একমত হওয়া বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পথ আপনারা তৈরি করতে পারবেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অনুঘটকের কাজ করবে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রয়োজনে ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসবে। ছয়টি কমিশনের সুপারিশের সারাংশ আপনাদের দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনায় অনেক বিষয়ে একমত হওয়া গেছে। তার একটি তালিকাও আপনাদের সরবরাহ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সনদের টেক্সট নিয়ে ইতোমধ্যে আপনাদের পরিবর্তন, সংশোধনবিষয়ক মতামতগুলো আমরা পেয়েছি এবং তা প্রতিফলনের ভিত্তিতে চূড়ান্ত টেক্সট তৈরি করছি। সনদের দুটি দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে পটভূমিসহ আমরা কী কী বিষয়ে একমত হয়েছি। অন্যটি হচ্ছে ভবিষ্যতে আবার আলোচনায় বসার প্রতিশ্রুতি। আমরা আশা করছি আজকের মধ্যে সব বিষয়ে নিষ্পত্তি করে আলোচনা শেষ করতে পারব। ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো এবং যেসব বিষয়ে ভিন্নমত থাকবে সেগুলোর তালিকা আপনাদের জানানো হবে। সেই ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ দলিল তৈরি করা হবে। সব দলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হবে।’
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার পাশাপাশি সনদ বাস্তবায়নে দুই বছরের সময়সীমা নিয়েও আমরা একমত। যারা বলছেন সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তি দেওয়া যাবে না, তারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। এর আইনি ভিত্তি থাকতে হবে। আগামী সংসদে সেই ভিত্তি দিতে হবে। যদি তা না হয় তবে স্বাক্ষর করা-না করার কোনো পার্থক্য থাকে না। জাতির সঙ্গে তামাশা করার সুযোগ আমরা দেব না।’ তিনি বলেন, ‘সংস্কারের প্রস্তাব হলো দীর্ঘ আলোচনার ফলাফল। সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন জরুরি। এ বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবে বিএনপির দ্বিমত নেই। বিএনপির বিষয়টি হলো আমরা ভালোমানুষ, ভালো দল, আমরা শপথ ভঙ্গ করব না। প্রস্তাব বাস্তবায়নে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।’
বিএনপির বক্তব্য প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘তারা বলছেন সংসদে আইনের ভিত্তি দেবেন; তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য তার দৃষ্টান্ত আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি। গত ৫৪ বছরে কোনো সরকারই শপথের মর্যাদা রাখেনি। তাই আমরা বলব, এখনই যদি আইন না হয়, তাহলে আমাদের এত দিনের আসা-যাওয়া ও সময় ব্যয় হওয়া সবই জিরো। আমরা এত কষ্ট করলাম, আপনারা কাভার করলেন; কিন্তু বাস্তবায়ন না হলে এসবের কোনো মূল্য থাকবে না। বাস্তবায়ন না হলে শপথ করারও কোনো মূল্য থাকে না। আমরা বলেছি প্রয়োজনে আরও আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হতে।’
তিনি বলেন, আইনি ভিত্তি না দিলে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না তাঁর দল। কারণ নির্বাচিত সরকার এসে এটি আইনে রূপ দেবে, তার নিশ্চয়তা নেই। তাই যা করার এখনই করতে হবে।
জামায়াত সনদে স্বাক্ষর না করলে সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো সংকট হবে কি না-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, লিগ্যাল স্বীকৃতি না থাকলে স্বাক্ষর করলেই কী আর না করলেই কী? সংকট হবেই। তিনি প্রশ্ন রাখেন-আইনি স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়? যারা বলেন, এর কোনো সুযোগ নেই তারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি কেবল প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করলে হবে না। আইনি ভিত্তি না থাকলে এ চার্টার মূল্যহীন হয়ে পড়বে। সেজন্য আমরা কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে কমপেনসেট মামলা করব। আইনি ভিত্তি ছাড়া এ চার্টার জিরো হবে। আমরা পরিষ্কার বলেছি, আইনগত ভিত্তি ছাড়া সই করব না। এ সরকারের মেয়াদেই এটি কার্যকর করতে হবে। কাল থেকেই এটা সম্ভব।’ এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট। এটি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের আবারও বসতে হবে। দুই বছরের মধ্যে হলে আমরা প্রত্যাখ্যান করব। দ্রুত এটি কার্যকর করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আইনি ভিত্তি না দিলে আমরা সই করব না। কারণ পরবর্তী সরকার এর স্বীকৃতি দেবে, এমন কথা ফাঁকিবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও মৌলিক অধিকার : রাষ্ট্র পরিচালনায় সংবিধানের চার মূলনীতি নিয়ে আলোচনার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়। ঐকমত্য ছাড়াই ওই আলোচনা শেষ হয়েছে। কমিশন এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
সংলাপ শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সংসদে একটি মধ্যবর্তী বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কমিশন এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত দেবে। মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত আলোচনায় আমরা বলেছি, বিদ্যমান মৌলিক অধিকারের সঙ্গে আধুনিক সময়ের আলোকে কিছু অধিকার যেমন ইন্টারনেটের অধিকার যুক্ত করা যায় কি না। তবে মৌলিক অধিকার একবার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের।’
সংবিধানের চার মূলনীতি বাতিল প্রশ্নে সংলাপ বর্জন চার বাম দলের : বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি বাদ দেওয়া প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ বর্জন করেছে চার বাম দল। তাদের মতে এটি মুক্তিযুদ্ধের সনদ। এর বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার করা। মূলত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলো তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই এ বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। তাই তারা সভা বর্জন করেছেন বলে জানান। সভা বর্জনকারী দলগুলো হলো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ।
গতকাল রাতে সংলাপ থেকে বেরিয়ে এ ঘোষণা দেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাসদ সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, বাসদ (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, বাংলাদেশ জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. মুশতাক আহমেদ ও সিপিবির সাজেদুল হক রুবেল।
তাঁরা বলেন, ‘এটি জাতি গঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি বিষয়। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে এখানে সমাধান করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। এটি জনগণের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আমরা এ সিদ্ধান্তের বৈধতা দিতে পারি না। তাই আমরা এ আলোচনা বর্জন করলাম।’ জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে তাঁরা স্ব স্ব দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি।
বামপন্থি দলগুলো বিদ্যমান মূলনীতির সঙ্গে কমিশন প্রস্তাবিত নতুন মূলনীতি যোগ করার পক্ষে, কোনো কিছু বাদ দেওয়ার পক্ষে তারা নয়। বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এর বদলে পাঁচটি মূলনীতি সুপারিশ করছে। সেগুলো হলো সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে পঞ্চম সংশোধনের মাধ্যমে যুক্ত হওয়া ‘আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ রাখার কথা বলে আসছিল। তবে কমিশন এখন যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে তাদের আপত্তি নেই। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলেছে, কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে তারা একমত।
গত রবিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের উনবিংশতম দিনে রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকের এক পর্যায়ে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে আলোচনা স্থগিত রাখা হয়।