আফগান ইতিহাসের একজন সাহসী নারী কবি ও যোদ্ধা ছিলেন নাজো তখি। তিনি আফগানদের কাছে ‘নাজো আনা’ (দাদি নাজো) নামে পরিচিত। তাকে আফগান জাতির মাতাও বলা হয়। তিনি পশতু ভাষায় কবিতা লিখতেন।
আফগান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান ছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন আফগান রাষ্ট্রের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা। নাজো তখি ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের কান্দাহারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সুলতান মালাখাই তখি ছিলেন পশতু তখি গোত্রের একজন প্রভাবশালী নেতা ও গজনি প্রদেশের গভর্নর।
তিনি শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা ও সংস্কৃতিচর্চার অনুকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। পিতার আন্তরিকতার কারণে তিনি ভাষা-সাহিত্য, ধর্মীয় জ্ঞান ও আফগান সংস্কৃতি বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। নাজো তখি সেলিম খান হোতাকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের ঘরে জন্ম নেন আফগানিস্তানের প্রভাবশালী শাসক মির ওয়াইজ হোতাক, যিনি আফগানিস্তানে হোতাক রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। নাজো তখি পশতু রীতিনীতি ও সংস্কৃতি প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
তিনি পশতু সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে আফগান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। নাজো তখি আফগানিস্তানের বিভিন্ন উপজাতির মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। গিলজি (সম্ভবত খিলজি) ও সাদোজাই উপজাতির মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসন করার পর আফগানিস্তানে তার প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। পাশাপাশি তিনি পারস্যের সাফাভিদ শাসকদের বিরুদ্ধে আফগানদের জোট গঠন করেন। নাজো তখি তার কবিতায় পশতু জাতিকে ঐক্য, আনুগত্য ও স্থিতিশীলতার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তার জ্ঞান ও বাগ্মিতা তাকে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিতে পরিণত করে। আফগান জাতির ঐক্য-সংহতি তৈরি এবং আফগান সংস্কৃতিতে অবদান রাখার কারণে তাকে আফগান জাতির মা বলা হয়।
যুদ্ধে নাজো তখির বাবা মারা যান। তখন তার ভাই প্রতিশোধ গ্রহণে অভিযানে বের হন এবং তার হাতে পরিবার ও দুর্গের নিরাপত্তার ভার অর্পণ করেন। পুরুষ যোদ্ধাদের সঙ্গে মিলে তিনি শত্রুর হাত থেকে তার পরিবার, গোত্র ও দুর্গ রক্ষা করেন। পরিবার ও জনগণের প্রতি তার এই দায়িত্ববোধ আফগানিস্তানের ইতিহাসে তাকে অমর বীরের মর্যাদা এনে দিয়েছে।
আফগান কিংবদন্তি অনুসারে, যে রাতে নাজো তখির ছেলে মির ওয়াইজ হোতাক জন্মগ্রহণ করে, সেই রাতে তিনি একটি বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি দেখেন, তিনি পশতু বেত্তানি উপজাতির বুজুর্গ শায়খ বেত নিকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। শায়খ বেত নিকার তাকে উপদেশ দেন তিনি যেন ছেলের প্রতি যত্নবান হন। কেননা সে জনগণের জন্য সৌভাগ্য ও গৌরব বয়ে আনবে। সত্যিই পরবর্তী সময়ে সুলতান মির ওয়াইজ হোতাকি সাফাভিদ শাসকদের পরাজিত করে স্বাধীন সার্বভৌম আফগান রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেছিলেন।
ছেলে মির ওয়াইজ হোতাকির মৃত্যুর দুই বছর পর আনুমানিক ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে নাজো তখি মারা যান। তার মৃত্যুর পর আমির আহমদ শাহ দুররানির মা জারঘুনা আনা তার স্থলাভিষিক্ত হন। আফগানিস্তানের মানুষ এখনো নাজো তখিকে স্মরণে রেখেছে। তারা তার কবিতা আবৃত্তি করে, আফগানিস্তানের শিল্প-সাহিত্যে তিনি এখনো প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন। দেশটির অসংখ্য স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালের নামকরণ হয়েছে নাজো তখির নামে।
নাজো তখির কবিতায় আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ দারুণভাবে মিলিত হয়েছে। যেমন তিনি বলেছেন, ‘ভোরের নার্গিসাস থেকে ঝরে যাওয়া শিশির ফোঁটা যেন বিষণ্ন চোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রু ফোঁটা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে সৌন্দর্য! কে তোমাকে কাঁদায়? সে উত্তর দিল, জীবন আমার জন্য খুবই ছোট। আমার সৌন্দর্য এক মুহূর্তে প্রস্ফুটিত হয় আবার শুকিয়েও যায়, যেমন একটি হাসি আসে এবং চিরতরে বিলীন হয়ে যায়।’
তথ্য সূত্র : পোয়েট্রি পশতু ডটকম, মাশরিক টিভি ডটপিকে ও উইকিপিডিয়া
বিডি প্রতিদিন/কেএ