দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনিয়ম থেমে নেই। সরকারের শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে দেশের ৩৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ১৪৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ২০২১-২২ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তথ্য নিয়ে সম্প্রতি এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। চলতি বছরের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তদন্তকাজ পরিচালনা করেছে এই অধিদপ্তর। প্রতিবেদনে ৬৬টি অনুচ্ছেদকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম (এসএফআই) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে- বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বাস করা সত্ত্বেও শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বেতন-বিল থেকে নির্ধারিত হারের কম বাড়ি ভাড়া কর্তন করায় আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার টাকা। বিভিন্ন সরবরাহকারীর বিল থেকে নির্ধারিত হারে ভ্যাট কর্তন না করায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৮ কোটি ৪৪ লাখ ৮১ হাজার টাকার। বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অগ্রিম বেতন-ভাতা দিয়ে তা সমন্বয় না করার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে ৪৬ কোটি ৫২ লাখ ৬৪ হাজার টাকার। টেস্ট রিপোর্ট ছাড়াই ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়মিত ব্যয় হয়েছে ১৭ কোটি ৬২ লাখ ৭৭ হাজার টাকা। আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আইন লঙ্ঘন করে প্রাধিকারভুক্ত গাড়ি মেরামত বাবদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে ১ কোটি ৮০ লাখ ৯২ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্যাশ বইয়ের হিসাবের সঙ্গে ব্যাংক হিসাবের গরমিল করেছে ২০ কোটি ৮৪ লাখ ১৭ হাজার টাকা। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রাপ্যতার চেয়ে অতিরিক্ত সম্মানী প্রদান করেছে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।
এক খাতের জন্য টাকা ছাড় করে অন্য খাতে ব্যয় করেছে কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আর এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক অসঙ্গতি ও ক্ষতি হয়েছে ২০ কোটি ২৭ লাখ ৬ হাজার টাকা।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে বাস করেও নির্ধারিত হারে বাড়ি ভাড়া দেননি। এক্ষেত্রে চাকরি আদেশ- ২০১৫ লঙ্ঘন করা হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার টাকা। এমন আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৯ কোটি ৫৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকার অনিয়ম হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম হয়েছে ৫ কোটি ৭৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ৭ কোটি ২ লাখ ৫৬ হাজার টাকা, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ কোটি ২২ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে।
শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, আপত্তিকৃত এসব টাকা আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা করতে হবে। একই সঙ্গে এসব আর্থিক অনিয়মের পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন সরবরাহকারীর বিল হতে নির্ধারিত হারে ভ্যাট কর্তন না করায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা। আর্থিক এই অনিয়ম হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ৭ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আপত্তিকৃত এসব টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা করা আবশ্যক বলে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে।
শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেওয়া অগ্রিম অর্থ সমন্বয় না করায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৪৬ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সবথেকে বেশি আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ২০ কোটি ২৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এ ছাড়া যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ কোটি ৭৪ লাখ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক অনিয়ম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, এমন অসঙ্গতির ব্যাপারে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যাখা দেবে। এ ছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা এলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এক খাতের জন্য অর্থ ছাড় করে অন্য খাতে ব্যয় করায় আর্থিক অনিয়ম হয়েছে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, হবিগঞ্জ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এক খাতের জন্য অর্থ ছাড় করে অন্য খাতে ব্যয় করায় নিয়মে সবথেকে এগিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ১৭ কোটি ৮ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম হয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকার।
ক্যাশ বইয়ের হিসাবের সঙ্গে ব্যাংক হিসাবের গরমিল সব থেকে বেশি গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ খাতে আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এ ছাড়া যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, শাহবাগে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ কোটি ২৭ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। আর্থিক অসঙ্গতি থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আপত্তিকৃত টাকার জন্য ব্যাংক রিকন্সিলিয়েশন করে নিরীক্ষা অফিসে প্রমাণক প্রেরণ করতে বলা হয়েছে।