২ জুলাই, ২০২০ ২১:৫৫

মানবিক শক্তি দিয়ে করোনাভাইরাসের মোকাবেলা করতে হবে

আবু তাহের খোকন

মানবিক শক্তি দিয়ে করোনাভাইরাসের মোকাবেলা করতে হবে

আবু তাহের খোকন

গণতান্ত্রিক দেশে শাসকরা সব কিছু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, সব সময় রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলেন এবং রাজনৈতিক ভাবেই সবকিছুর সমাধান করতে চান। ধীরে ধীরে এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। তবে সেখানে গঠনমূলক সমালোচনা চলে, বিরোধী পক্ষগুলো এবং সাধারণ জনগণের কাছ থেকে সুপরামর্শ এলে সেটাকে আমলে নেওয়া হয়। আমাদের গণতন্ত্র সমস্যার কথা সবাই জানেন। সেখানে সমালোচনা বা পরামর্শ কোনোটাই গ্রহনযোগ্য হয় না। এমনকি যৌক্তিক বক্তব্যগুলোকেও প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সরকার প্রধান কখনো 'না' শব্দ শুনতে চান না। মন্ত্রী মহোদয়রা 'ইয়েস স্যার' আর 'নো স্যার' এর বাইরে কোন কথা বলার সাহস রাখেন না। আমরা প্রস্তুত আছি, সব ঠিক আছে। যা হচ্ছে প্রোপাগান্ডা, গুজব ও অপপ্রচার। অতএব, এইগুলো বন্ধ করতে হবে। মাইর লাগাও, মুখ বন্ধ কর। কিন্তু যেসব বক্তব্য গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সেসব বক্তব্য সত্যও তো হতে পারে। কিন্তু যাচাইবাছাইয়ের সময় নাই কারও। করোনাভাইরাসের বেলাতেও তাই হলো। কোন ব্যতিক্রম নাই। প্রধানমন্ত্রীকে বলা হলে আমরা প্রস্তুত। সব ঠিক আছে। কানাডা-আমেরিকা থেকেও আমাদের প্রস্তুতি ভাল।

দুইদিন পর যখন মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে শুরু করলো। এমন কি মানুষ মারা যাচ্ছে, তখনও এমপি-মন্ত্রীরা বলেছেন এসব প্রোপাগান্ডা, গুজব। সুতরাং, সেসব প্রোপাগান্ডা বন্ধ করার জন্য প্রশাসনকে লাগিয়ে দেওয়া হলো। গ্রেফতার করা হলো সত্য উচ্চারণকারীদের। ডাক্তার, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের দিয়ে প্রচার করা হলো, করোনাভাইরাস আমাদের দেশের জ্বর, সর্দি, কাশির মত একটা অসুখ। ভয় পাবার কিছু নাই। জনগণ সচেতন থাকলেই হবে।

মার্চ মাসে বাংলাদেশে প্রথম প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিন জন রোগী শনাক্ত হল। তাদের মধ্যে দুইজন ইতালি ফেরত বাংলাদেশি। তখনো গুরুত্ব দেওয়া হলো না। প্রতিদিন ইতালি থেকে করোনা রোগী আসছে। বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তাদেরকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখার দরকার ছিল তা করা হয়নি।

‘গুজবের করোনাভাইরাস’ যখন পুরোদমে শুরু হয়ে গেল। সাধারণ মানুষকে সময় না দিয়ে হঠাৎ করেই লকডাউন আরোপিত হলো। অফিস আদালত বন্ধ। মিল-কারখানা বন্ধ। একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা। একদল ছুটলো বাজারে। বাড়ি যাবার জন্য কেউ কাপড়-চোপড় গোছাতে শুরু করলো। বাজার, বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট লোকে লোকারণ্য হলো। নেই করোনাভাইরাসের ভয়। নেই সামাজিক দূরত্ব। দিনমজুর, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষগুলো পড়ে গেলেন বিপদে। রাস্তায় নেমে পড়লো তারা। ফুটে উঠতে লাগলো দেশের মানুষের খাদ্যের ও অর্থনীতির চিত্র। পরবর্তীতে অর্থনীতির চিন্তায় ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে গার্মেন্টস খুলতে সন্মতি দেয় সরকার। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঢাকায় ডাকা হলো। চাকরি বাঁচাতে পেটের টানে করোনাভাইরাসের ভয় বাদ দিয়ে তারা ছুটতে শুরু করলো ঢাকায়। আবার লঞ্চঘাট, ফেরিঘাটে একই দৃশ্য। চারদিক লোকে লোকারণ্য। করোনাভাইরাস ছড়াতে লাগল নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে। আসলে কোথাও তো কোনো প্রতিরোধই ছিল না! এভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে লাগল।  করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যাও সমানতালে বাড়তে থাকলো। পাশাপাশি বাড়তে থাকল সমালোচনা।

করোনাভাইরাস যখন ভয়ানক আকার ধারণ করলো, সরকার তখন অর্থনীতি এবং জীবন দুটো নিয়ে ভাবতে গিয়ে সব তালগোল পাকিয়ে ফেললো। করোনাভাইরাসের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ভাববার সময় পার হয়ে গেল। আমরা ভয়াবহ পরিণতির দারপ্রান্তে পৌঁছে গেলাম। সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই করোনা যুদ্ধে নামিয়ে দিলাম ডাক্তার, পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে।

অর্থনীতি ও জীবন দুটো এক সাথে বাঁচাতে যেয়ে আমরা না পারছি অর্থনীতিকে বাঁচাতে, না পারছি জীবন বাঁচাতে। হারাচ্ছি সাধারণ মানুষের সাথে দেশের বড় সম্পদ 'মানব সম্পদ'। হারিয়েছি মন্ত্রী, এমপি, সচিব, ভাষা সৈনিক, পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীসহ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বগণকে।

করোনাভাইরাসের চিকিৎসা দিতে গিয়ে বাংলাদেশে ৫০ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। এদের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রয়েছেন। যাদের সমমানের ডাক্তার তৈরি করা ভবিষ্যতে সম্ভব হবে কিনা জানি না। ভেঙে পড়েছে দেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, বাড়ছে মৃত্যু। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। কর্মস্থল কমে যাচ্ছে, কর্মহীন হয়ে পড়ছে মানুষ। করোনার সর্বগ্রাসী আঘাতে বাড়ছে হতাশা, দারিদ্র্য আর বেকারত্ব। করোনার কারণে নতুন করে ১৩ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছে দেশে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে শুধু দুই মাসের ক্ষতিই প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। কীভাবে এসব ক্ষতি পোষাবে মানুষ? কীভাবে তারা টিকে থাকবে? বর্তমানের মতোই ভবিষ্যৎ তাদের চরম অনিশ্চয়তায় ভরা। অর্থনীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় মানুষ কেবল অন্ধকারই দেখছে। বাড়ছে হতাশা, একক ভাবে-পারিবারিক বাড়ছে আত্মহত্যা। বাড়ছে চুরি ডাকাতি, হতে পারে আইনশৃঙ্খলার অবনতি। এখন পরিবার নিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ের মতই শহর ছেড়ে গ্রামে পালাচ্ছে মানুষ।

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে বলা হয় কারণ তার মধ্যে মানবিকতা আছে, বোধ-বিবেক আছে, হিতাহিত জ্ঞান আছে, ভালো-মন্দ যাচাই করার সক্ষমতা আছে।করোনাভাইরাস ধনী-গরীব সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

এই অর্থনীতি মন্দা কাটিয়ে উঠা কোন একক দেশের পক্ষে সম্ভব না। বিশ্বকে একসাথে মোকাবিলা করতে হবে। তেমনি মানবজাতি একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হবে বিশেষ করে হতোদরিদ্রদের পাশে, বেকারকর্মহীন মানুষের পাশে। একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া এই সংকট মোকাবেলা সম্ভব না। মানুষকে মানবিক হতে হবে। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে করোনাকালীন বেকারত্ব অভাব-অনটন দুর্ভিক্ষ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। কেননা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না করোনাভাইরাসের শেষ কোথায়।

বিডি-প্রতিদিন/শফিক

সর্বশেষ খবর