২২ জানুয়ারি, ২০২১ ১৪:২৭

মানুষকে চিনতে পারাটাই একটা জয়, একটা নতুন আবিষ্কার

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

মানুষকে চিনতে পারাটাই একটা জয়, একটা নতুন আবিষ্কার

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

মানুষকে চিনতে পারাটাও একটা জয়, একটা অভিজ্ঞতা, একটা নতুন আবিষ্কার। কথাটা খুব সাধাসিধা মনে হলেও এর গভীরতা অনেক বেশি। এতটা  গভীর যা মহাসমুদ্রের গভীরতাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। গভীর অরণ্যের গভীরতাকেও হার মানাতে পারে। টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি তৈরি করতে গিয়ে এর ফিলামেন্ট মেটেরিয়াল কি হবে তা নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন। একটার পর একটা করে ২০০০ মেটেরিয়াল ফিলামেন্ট হিসেবে ব্যবহার করার পরও আলো তেমন একটা পেলেন না। এডিসনের সহযোগী বিজ্ঞানীরা খুব মুষড়ে পড়লেন। অনেকটা ভেঙে পড়া নদীর মতো। অনেকটা কঠিন শীতে ভেঙে পড়া অসহায় মানুষের মতো। একটা বিষন্ন মন নিয়ে তারা বললেন এডিসন আমরা গবেষণায় ব্যর্থ হয়েছি। এডিসন কথাটি শুনে হাসলেন। হতাশায় ক্লান্ত মুখগুলোকে তিনি নতুন করে চিনলেন। বুঝলেন ওদের আত্মবিশ্বাস আর চিন্তায় অনেক নেতিবাচক প্রাচীর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এডিসন সেই সহযোগী বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণায় ভাটা পড়া স্বপ্নগুলোকে ইতিবাচক ভাবে চিনতে চাইলেন। তিনি তাদের বললেন, কি বলছো তোমরা। আমরা তো আমাদের গবেষণায় সফল হয়েছি। বিজ্ঞানের অসাধ্যকে জয় করার পথে আরো একধাপ এগিয়ে গেছি। সহযোগী বিজ্ঞানীরা যেন নতুন করে চিনছেন এডিসনকে। একি কথা বলছে মানুষটা। তবে কি সে পাগল হয়ে গেলো। অনেকটা সংকোচিত হয়ে সহযোগী গবেষকরা বললেন, এডিসন তুমি কি করে বলছো আমরা গবেষণায় সফল হয়েছি। যেখানে আমরা দেখছি আমাদের গবেষণা ব্যর্থ হয়েছে। এডিসন কপালে মৃদু ভাঁজ টেনে বললেন, আরে তোমরা কি দেখতে পারছোনা আমরা কি অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। আমরা ২০০০ মেটেরিয়াল পরীক্ষা করে দেখেছি তা ভালো আলো দেয় না। এর মানেটা বুঝো। এর মানে হচ্ছে আগামীদিনের বিজ্ঞানীদের আমরা একটা বার্তা দিতে পারবো তা হলো তোমরা এই ২০০০ মেটেরিয়াল ব্যবহার করে সময় নষ্ট করো না। বরং এই ২০০০ মেটেরিয়াল বাদ দিয়ে তোমরা এমন কোনো মেটেরিয়াল আবিষ্কার করো যা অনেক বেশি আলো দিবে। সহযোগী বিজ্ঞানীরা চিনলো এক নতুন এডিসনকে। যে পরাজয়কে জয়ে পরিবর্তন করতে পারে। যে ব্যর্থতার অভিজ্ঞতাকে সফলতার রং মাখাতে পারে। সহযোগী বিজ্ঞানীরা যেটাকে পণ্ডশ্রম ভেবেছিলো এডিসন সেখানে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো সেটাও একটা নতুন আবিষ্কার হতে পারে।  বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের তখন শিশুকাল। একদিন এডিসন ঘরে এসে তার মাকে একটি খামবন্দি চিঠি  দিলেন। তিনি তাকে বললেন, ‘আমার শিক্ষক আমাকে কাগজটি দিয়েছেন এবং শুধু তোমাকেই দিতে বলেছেন।’ মা চিঠিটি জোরে পড়া শুরু করলেন এবং তাঁর চোখ ভর্তি পানি, ‘আপনার পুত্র মেধাবী। এই স্কুলটি তার জন্য অনেক ছোট এবং এখানে তাকে শেখানোর মতো যথেষ্ট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই।

দয়া করে আপনি নিজেই তার শিক্ষার ব্যবস্থা করুন।’ তার মা মারা যাওয়ার অনেক বছর পরের কথা। এডিসন তখন শতাব্দীর সেরা আবিষ্কারক। এক দিন তাঁর পারিবারিক পুরনো জিনিসপত্র দেখছিলেন। একটি ডেস্কের ড্রয়ারের কোনায় হঠাৎ তিনি একটি ভাঁজ করা কাগজ পেলেন। তিনি সেটি খুললেন। কাগজে লেখা ছিল—‘আপনার সন্তান খুব বোকা আর অমেধাবী। আমরা তাকে আমাদের স্কুলে আর আসতে দিতে পারি না।’ এডিসন কয়েক ঘণ্টা ধরে কাঁদলেন। কারণ এডিসন বুঝতে পারলেন তার মা সেদিন বড় কিছু ভাবেননি। বরং এডিসনকে তার মা নিজের প্রাণের আকুতি দিয়ে চিনেছেন। একটা পরাজয়ের জায়গা থেকে চিনেছেন। মা তার নাড়ি ছেঁড়া ধনকে নতুন করে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। নিজের একটু একটু অভিজ্ঞতা দিয়ে কাদামাটির নরম দোলাকে গড়ার লড়াইটা নিজের মতো করে লড়েছেন। তিনি টমাস আলভা এডিসনকে গড়ার আগেই ভেঙে দেননি বরং তার মধ্যে এমন ধারণা সৃষ্টি করেছিলেন যে তার  মতো মেধাবী যেন আর পৃথিবীতে কেউ নেই। সন্তানের পরাজিত মুখটাকে ঢেকে রেখে ক'টা  ইতিবাচক শব্দের নিষ্পাপ উচ্চারণে মা সেদিন এডিসনের জীবন বদলানোর ইতিহাসটা চিঠির মতো করেই লিখেছিলেন। এডিসনের মা মানুষ এডিসনের ভিতরের ঘুমন্ত শক্তিকে শিক্ষকের মতো করে চিনতে পারলেও স্কুলের শিক্ষকদের কাছে সে চেনাটা অচেনায় থেকে গিয়েছিলো। সবাই মানুষকে চিনতে পারে না, কেউ কেউ পারে। 

রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে যখন প্রথম যোগাযোগ ঘটল তখন রবীন্দ্রনাথ সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে আসার পর সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘এইমাত্র আপনি একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বললেন, আপনার প্রতিক্রিয়া কী?’ রবীন্দ্রনাথ উত্তর দিলেন, ‘আমি তো একজন বিশ্বখ্যাত কবির সঙ্গে কথা বললাম।’ 

এরপর সাংবাদিকরা আইনস্টাইনের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে বললেন, ‘আপনি একজন বিশ্বকবির সঙ্গে কথা বললেন, আপনার প্রতিক্রিয়া কী?’ আইনস্টাইন উত্তর দিলেন, ‘আমি কবির সঙ্গে কথা বলিনি, আমি একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেছি।’ এ যেন আলোর সাথে আলোর মেলবন্ধন যেখানে কোনো বিরোধ নেই। আছে একজন আরেকজনকে অন্যভাবে চেনার অলৌকিক আনন্দ। 

আইনেস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেন, পৃথিবীর অভূতপূর্ব ঘটে যাওয়া ঐশ্বরিক সম্পর্ককে আপনি কিভাবে দেখেন। রবীন্দ্রনাথ সেখানে বিজ্ঞানকে টেনে আনেন। তিনি মানুষকে প্রোটন এবং ইলেকট্রনের সাথে তুলনা করেন। প্রোটন ও ইলেকট্রনের মধ্যে যে ফাঁকটুকু থাকে সেখানে তিনি মানুষের বিশুদ্ধ সত্তাকে দেখতে পান। সে সত্তা কখনো অমিতশক্তি নিয়ে একা দাঁড়িয়ে যায়। পৃথিবী বদলে দেয়। আবার কখনো সেখানে মানুষের সাথে মানুষের আন্তসম্পর্ক গড়ে উঠে। সেটা মানুষকে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়, পুলকিত করে। সে জায়গা থেকেই হয়তো মানুষ অদেখা পৃথিবীকে চিনতে পারে। সে চেনাটা বিজ্ঞানকে সাহিত্য, কখনো সাহিত্যকে বিজ্ঞান বানিয়ে দেয়। সেখানে বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন ও মনস্তত্ব একসাথে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলে কোনো অচেনাকে চেনার পরশপাথর মুখে বুলিয়ে।

আলোচনা শেষে আইনস্টাইন বেহালা বাজিয়ে কবিগুরুকে শোনান। বেহালার জাদুকরী সুর রবীন্দ্রনাথকে মোহিত করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ দেখেন এক বিস্ময়কর কবিকে যিনি বেহালার সুর থেকে কবিতার ছন্দপতন ঘটাতে পারেন। একটা চেনার জয়, একটা অভিজ্ঞতার মুগ্ধতা আর নতুন সৃষ্টির আবিষ্কার যেন দুটো প্রাণকে একসুতোয় বেঁধে আকাশের নীল থেকে নীলিমায় হারিয়ে যায়। 

রবীন্দ্রনাথ তার সাহিত্যের এক অংশে বলেছেন, "গেটে উদ্ভিদ্তত্ত্ব সম্বন্ধে বই লিখেছেন। তাতে উদ্ভিদরহস্য প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু গেটের কিছুই প্রকাশ পায়নি অথবা সামান্য এক অংশ প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু গেটে যে-সমস্ত সাহিত্য রচনা করেছেন তার মধ্যে মূল মানবটি প্রকাশ পেয়েছেন।" গেটেকে রবীন্দ্রনাথ চিনেছেন এভাবেই। তবে সম্রাট নেপোলিয়ান গেটেকে চিনেছেন ফরাসি ভাষার জাদুকরী শক্তিতে এভাবেই "ভুজেত আঁনম!" যার বাংলা ভাবানুবাদ, "হে মহামানব, আপনি তাহলে মানুষ!" যার বাংলা অনুবাদ অনেকটা "হে মহামানব, আপনিও তবে কি মানুষ"। মানুষ যে তার কর্মের মাধ্যমে মানব থেকে মহামানব হয়ে উঠতে পারে তার একটা নিবিড় দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ এখানে রয়েছে। মানুষের চোখে একেকটা মানুষ একেকরকম। যে মানুষটা অন্যের কাছে নিজের ভিন্নতটা চেনাতে পারে সে মানুষটা সব সময় সফল হয়। যেটা তাকে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম করে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। একটা চেনা সময়ের আয়না ভেঙে পড়া অচেনা শহরকে ডেকে বলে বিজ্ঞান বানায় "পর্যবেক্ষণকারী' মানুষ। দর্শন বানায় 'চিন্তাশীল' মানুষ। সঙ্গীত ও সাহিত্য বানায় 'সমগ্র' মানুষ।"

মানুষ চেনাটা যতটা ইতিবাচক ততটাই নেতিবাচক। এমন একটা চেনা বোধের চেতনাটা কোথায় যেন পুকুরে পড়ে থাকা কচুরিপানায় গড়াগড়ি খায়। যেমন চেনা মুখটা যখন বিশ্বাসঘাতক হয় তখন বুকটা কম্পিত হয়। যখন সেটা সুবিধাবাদী হয় তখন ছেঁড়া কাঁথার কষ্টগুলো কাব্য হয়ে যায়। সেটা বাস্তব না নাটক বোঝাটা খুব কঠিন হয়ে যায়। সেই নষ্ট মানুষেরা নিজেদের কপালে অদৃশ্য কলংক একে নাকানি-চুবানি খায়। সব যেন নিস্তন্ধ হয়ে যায়।যেমন নিস্তব্ধ হয় চেনা চেনা মুখ, অচেনা সময়। 

জীবনানন্দের অদ্ভুত আঁধার এক কবিতাটির কথা মনে পড়ে গেলো। তিনি বলেছেন, 
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

এটা কোনো কবিতা নয়।  মায়াহীন পৃথিবীতে মানুষ নামের অসংখ্য কীটপতঙ্গের খুব চেনা মানুষের মুখ। মুখোশ। 

একটা লেখায় পেলাম :
"বাইবেলের ‘দ্য লাস্ট সাপার’ অংশটুকুর একটি মুহূর্ত। যিশুখ্রিষ্ট তাঁর বারোজন শিষ্যকে নিয়ে মৃত্যুর আগে যে শেষ নৈশভোজ সারেন তাই দ্য লাস্ট সাপার নামে এই ভোজে যিশু তাঁর বারোজন শিষ্যকে নিয়ে রুটি ভাগ করে খান আর পান করেন সোমরস। নৈশভোজে যিশু ঘোষণা করেন এই শিষ্যদেরই একজন তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। তাঁকে ধরিয়ে দেবে। এই ঘোষণার মুহূর্তে যিশু আর তার সঙ্গীদের অভিব্যক্তির আবহই ফুটিয়ে তুলেছেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি তাঁর ‘দ্য লাস্ট সাপার’ চিত্রকর্মে। কারো মুখে বিস্ময়, উদ্বেগ, কারো মুখে ভয়, কারো মুখে ছিলো বেদনা আর কারো মুখে সন্দেহ।"

খুব মর্মস্পর্শী। খুব নির্মমতা। মানুষের চারপাশেই এমন অনেক বিশ্বাসঘাতক চেনামুখ থাকে। খুব কাছের, খুবই কাছের সেটা বোঝা যায়। সে বোঝাটা  বোঝা হয়। তবে সে বোঝার বোধটা প্রকাশ করা যায় না। বুকের কোনো একটা আবেগের জায়গায় তা বুলেটবিদ্ধ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে যায়।

বিডি প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

সর্বশেষ খবর