১৯ অক্টোবর, ২০২১ ১০:১১

কী অপরাধ ছিল শেখ রাসেলের?

আবু আববাস ভূঁইয়া

কী অপরাধ ছিল শেখ রাসেলের?

শেখ রাসেল

শুভ জন্মদিন-শেখ রাসেল। শুভ শব্দটা বড়ই মন খারাপের বড় কারণ হয়ে যায় এই দিনে। কী অপরাধ ছিলো- ১০ বছর বয়সী শিশু রাসেলের। পাশের বাড়ির ছেলেদের নিয়ে সাইকেলে পুরো ধানমন্ডি-দাপিয়ে বেড়ানো শিশুটিকে কেনো এভাবে চলে যেতে হলো? 

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের একটা গল্পেই চেনা যায় শিশু রাসেলকে। স্কুলে ক্লাসের বন্ধুদের ছাপিয়ে মধ্যে সেখানে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিলো- দুলাল নামের বাদামবিক্রেতা ছেলেটি। টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের শিশুদের নিয়ে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো দুরন্ত শৈশব এভাবে থামিয়ে দেয়ার কারণটা কি? প্রশ্নের উত্তর জানে না, হয়তো ১৫ আগস্ট ভোরের কবুতরগুলোও। দিনের সূর্য উঠেনি তখনও, বত্রিশ নম্বরের বাড়িটি তখন রক্তপুরী। কী অমানবিক- কী বিভৎসভাবে শিশু রাসেলকে রক্তের ছোপ ছোপ বন্যায় পা ভিজিয়ে হাঁটানো হলো। শ্রাবণের বৃষ্টিধোয়া বাতাস রক্তাক্ত সব স্বজনদের যেনো ছুঁয়ে যাচ্ছে- এমনি সময় একটা গুলি, ছোট্ট রাসেলের বুক ঝাঁঝরা করে দিলো, উড়ে গেলো মাথার খুলি। বাড়ির কবুতরগুলো যেনো চেয়ে চেয়ে দেখলো, উত্তর পেলো কি?

বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, শিশু শেখ রাসেলের বড় বোন ‘হাসু আপা’র প্রশ্ন- 'যাদের সান্নিধ্য স্নেহ-আদরে হেসে খেলে বড় হয়েছে তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কী অবস্থা হযেছিলো- কী কষ্টই না ও পেয়েছিলো- কেন কেন কেন ঘাতকেরা আমার রাসেলকে এত কষ্ট দিয়ে কেড়ে নিল। আমি কি কোনদিন এই কেন’র উত্তর পাব?' (আমাদের ছোট রাসেল সোনা; শেখ হাসিনা। পৃষ্ঠা ৪১)

খুনিদের মন এতটুকু টলেনি- মায়ের কাছে যাব আর্তিটিতে বরং বাবা-মাসহ পুরো পরিবারের নিথর দেহগুলো দেখতে শেখ রাসেল আকুতি জানালেন, আমাকে মেরো না; আমাকে হাসু আপার কাছে নিয়ে যাও। এমন নির্মম ইতিহাসের পর, বাঙালী জাতির লজ্জায় মুষড়ে পড়ার দিন হওয়া উচিত- আঠারো অক্টোবর। আমাদের প্রয়োজন, এদিনে ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের মানবতাবোধ, নেতৃত্বসুলভ আচরণ, পরোপকারী মনোভাবগুলো তুলে ধরে রাসেল হত্যার অমার্জনীয় লজ্জ্বা ঘোচানোর খানিকটা প্রয়াস নেয়ার একটা দিন। এবছর থেকে ১৮ অক্টোবরকে ‘শেখ রাসেল দিবস’ ঘোষণা দিয়েছে। দেশের লাখো কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জানা উচিত- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠপুত্রের মাত্র ১১ বছরের জীবন ছিলো কত বর্ণিল; কতটা মহান।    

১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক বাড়িটিতে শিশু রাসেল যখন জন্মগ্রহণ করেন, সময়টা ছিল রীতিমতো উত্তেজনাপূর্ণ। নিরন্তর অনিশ্চয়তা চারিপাশে; অমানিশার অন্ধকার; এরিমাঝেও বঙ্গ-বদ্বীপের মানুষ যখন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে, ঠিক তখনই জন্ম। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রান্ড রাসেল। প্রায়ই বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেসাকে বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক সাহিত্যে নোবেলজয়ী বার্ট্রান্ড রাসেলের বই বাংলায় ব্যাখ্যা করে শোনাতেন। বাট্রান্ড রাসেলের ফিলোসফি শুনে এতই ভক্ত হয়েছিলেন বঙ্গমাতা; তাই তাঁর নামের সঙ্গে মিলিয়ে পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম রাখলেন রাসেল, শেখ রাসেল। শিশু রাসেল বেঁচে থাকলে আজকের ৫৭ বছরের মানুষটিও হতেন অনন্য গুণাবলির ব্যক্তিত্ব।  

শেখ রাসেলের জন্মের পরপরই কারাগারে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ছোট্ট রাসেলের বাবার সান্নিধ্য খুব কমই পাওয়া হয়েছে। রাসেলের সবটুকু সময়জুড়েই ছিলেন তাঁর প্রিয় হাসুপা’ (শেখ হাসিনা)। রাসেলের হাঁটা শুরু হয়েছে হাসুপা’র হাত ধরে, তাও আবার একদিনেই। যা আসলেই বিরল ঘটনা। বস্তুত শেখ রাসেলের সবকিছুই একটু ব্যতিক্রম ছিল, আর থাকবে নাই বা কেনো? সে যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র। সেই ছোট্ট বয়স থেকেই রাসেলের ছিল অসাধারণ নেতৃত্বসুলভ আচরণ। ঢাকায় তাঁর তেমন কোনো খেলার সঙ্গী ছিল না, তবে যখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে টুঙ্গিপাড়ায় বেড়াতে যেতেন, সেখানে খেলার সাথীর অভাব হতো না। ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় তাদের জন্য জামা-কাপড় কিনে নিয়ে যেতেন। সেখানে গিয়ে সবাইকে ডাকতেন। খেলনা বন্দুক বানাতেন; সঙ্গীদের প্যারেড করাতেন। শেষে থাকতো সবার জন্য খাবার ব্যবস্থা। আর বড় হয়ে তুমি কী হবে- এমন প্রশ্ন কেউ করলে তখন বলতেন ‘আর্মি অফিসার হবো’। আহা কী নিদারুণ কষ্ট- অসীম শোকগাঁথার ইতিহাস রচিত হলো ১৫ আগস্ট ভোরে। দেশীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে খুনী জিয়ার চক্রান্তে বিপথগামী আর্মি অফিসারদের হাতেই থেমে গেলো একটি দশবছর বয়সী মানবিক জীবন।

মহৎ মানুষ হিসেবে বড় হয়ে ওঠার পেছনে পরিবারের ভূমিকা একটি বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। রাসেল বাবাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করতেন। বঙ্গবন্ধু যেদিন প্রিন্স স্যুট পরতেন সেদিন রাসেলও পরতেন। কাপড়চোপড়-সহ সব ব্যাপারেই ছোটবেলা থেকেই নিজের পছন্দকে অনেক প্রাধান্য দিতেন। ধারণ করতেন আলাদা ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন মত নিয়ে চলতে চাইতেন। ১৯৭৫ সালের আগস্টের প্রথম দিকের কথা- বড় ভাই শেখ কামালের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। বাসায় ছবি তোলা হচ্ছে, একপর্যায়ে আবাহনীর কয়েকজন কর্মকর্তা দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধুর পাশে; রাসেলও ছিলেন তাদের সাথে। এমন সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, তোরা তো সব আবাহনী, আমিই একমাত্র ওয়ান্ডারার্স। শেখ রাসেল এ কথা শুনে খানিক অভিমানে দূরে সরে যেতে যেতে বলে, আমি ওয়ান্ডারার্সের সমর্থকদের সঙ্গে ছবি তুলবো না।

ছোট মানুষটার চরিত্রের দৃঢ়তা ছিলো অবাক করার মতন। চলাফেরায় থাকতেন বেশ সাবধানি; কিন্তু সাহসী। একদিন কালো বড় পিঁপড়া ধরতে গিয়ে কামড়ে আঙ্গুল ফুলে যাওয়ার পর, আর ধরতে যেতেন না। এরপর নিজে থেকেই ওই পিঁপড়ার নাম দিয়ে দেন- ভুট্টো।
রাসেলের জন্মের প্রথম দিন থেকেই তাঁর অনেক ছবি তোলা হতো। আলাদা ফটো অ্যালবাম ছিলো। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লুট করে নেয় অনেক দুর্লভ ছবির সেই অ্যালবামটি। এ’কথা নিঃসন্দেহে বলাই যায়, শেখ রাসেলের মাত্র একদশকের সেই ছবিগুলি আজ হয়ে উঠতো এই দেশের তরুণ প্রজন্মের অদম্য আত্মবিশ্বাসের রসদ।

বাড়ির কাজের মানুষের সঙ্গে খেতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করা; গৃহশিক্ষিকাকে বাড়তি মিষ্টি খাওয়ার আবদার রাখা এমনো অহমহীন সুন্দর শৈশব থামিয়ে দিলো কী অপরাধে ঘাতকেরা? অথচ এই শিশুকেই ১৯৭১ সালে বন্দিখানায় খাবারের কষ্টে ভূগতে হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে প্রায়ই পাকিস্তান বাহিনী এসে বাসা সার্চ করতো। নানাভাবে উত্যক্ত করতো, বিষময় বাতাস যেনো ভাসতো বন্দিদিনের অহোরাত্রগুলোয়। বড় বোন প্রিয় হাসুপা’ অন্তঃসত্বা, দুই ভাই যুদ্ধে, বাবা আছেন কিনা জানেন না; প্রায়ই আড়ালে গিয়ে কাঁদতেন- কেউ দেখে ফেললে বলতেন, চোখে ময়লা। এ কেমন নোনাজল ভেজা চোখ লুকানো, কাউকে বুঝতে না দিয়ে! এরই মাঝে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মে খানিক আনন্দের পরশ লাগে শিশু রাসেলের অবর্ণনীয় কষ্টের এই সময়ে। সারাক্ষণ জয়ের সঙ্গে খেলা করতো। এয়ার রেইডের সময় দৌড়ে এসে কানে গুঁজে দিতেন তুলা, সবসময় পকেটে রাখতেন তুলা। মাত্র ৬ বছর বয়স তখন শেখ রাসেলের। এমন অনিন্দ্য শিশু রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাগারের রোজনামচা বইয়ে লিখেছিলেন, বাচ্চারা দেখতে চায় কোথায় থাকি আমি। বললাম, বড় হও, মানুষ হও, দেখতে পারবা।
শেখ রাসেলের আর বড় হওয়া হয়ে উঠেনি; এমন বেদনাবিধূর ইতিহাস আর রচিত না হোক বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বাংলাদেশে।  

রাসেল- যে শিশু বাড়ির সবার সঙ্গে খাবার টেবিলে বসে কখনো কবুতর খেতেন না, পাখি হত্যা হবে বলে। সেই শিশুকে এভাবে হত্যা করলো আত্মস্বীকৃত খুনিরা। ইতিহাসের কলংক এই খুনিরা শুধু জাতির পিতাকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাঁর রক্তের উত্তরাধিকার চিহ্নটুকুও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। জন্মদিনে লজ্জ্বায় অবনত অতল শ্রদ্ধা- শেখ রাসেল। (তথ্যসূত্র: আমাদের ছোট রাসেল সোনা, শেখ হাসিনা; রাসেলের গল্প, বেবী মওদুদ)

লেখক : সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।

বিডি প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন

সর্বশেষ খবর