৮ আগস্ট, ২০২২ ১৩:২০

জাতির সাহসী ও মমতাময়ী জননী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব

এম নজরুল ইসলাম

জাতির সাহসী ও মমতাময়ী জননী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব

একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ তিনি। নিজস্ব সচেতন বোধ ও চিন্তাচেতনায় তার সময়কে তিনি যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন মাত্রা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে তার সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ওরফে রেনু প্রসঙ্গ। মহীয়সী এই নারীর আত্মত্যাগ শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর প্রতি নয়, দেশের প্রতিও। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু লিখছেন, ''আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখো তোমার জীবনের কাহিনী।''

বললাম, ‘লিখতে যে পারি না; আর এমনকি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।
...হঠাৎ মনে হলো লিখতে ভালো না পারলেও ঘটনা যত দূর মনে আছে লিখে রাখতে আপত্তি কী? সময় তো কিছু কাটবে। ...আমার স্ত্রী, যার ডাকনাম রেনু- আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছে। রেনু আরো একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।
...রেনু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকা-পয়সা জোগাড় করে রাখত, যাতে আমার কষ্ট না হয়।” 

বায়ান্নর উত্তাল দিনগুলোতে কারাগারে দীর্ঘ অনশনের কারণে বঙ্গবন্ধুর শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। এই অবস্থায় মুক্তি দিলে তাঁকে গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। সেই স্মৃতিচারণা : “পাঁচ দিন পর বাড়ি পৌঁছালাম। মাকে তো বোঝানো কষ্টকর। হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, ‘আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে, তাই বলে চলেছে। কামাল আমার কাছে আসল না, তবে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি খুব দুর্বল, বিছানায় শুয়ে পড়লাম। গতকাল রেনু ও মা ঢাকা থেকে বাড়ি এসে আমার প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছিল। এক এক করে সকলে যখন আমার কামরা থেকে বিদায় নিল, তখন রেনু কেঁদে ফেলল এবং বলল, ‘তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়। নাসের ভাই বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা-শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম। আব্বা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাই রওনা করলাম ঢাকায়, সোজা আমাদের বড় নৌকায় তিনজন মাল্লা নিয়ে। কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? এদের কি দয়ামায়া আছে? আমাদের কারো কথাও তোমার মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কি উপায় হতো? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কী করে বাঁচতাম? হাচিনা, কামালের অবস্থা কী হতো? তুমি বলবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হতো না? মানুষ কি শুধু খাওয়া-পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতা?’ আমি তাকে কিছুই বললাম না। তাকে বলতে দিলাম, কারণ মনের কথা প্রকাশ করতে পারলে ব্যথাটা কিছু কমে যায়। রেনু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধ ভেঙে গেছে। শুধু বললাম, ‘উপায় ছিল না।’ বাচ্চা দুইটা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুয়ে পড়লাম। ...” 

জেল-জুলুম-হুলিয়া মাথায় নিয়ে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নভাবেই চলেছে বঙ্গবন্ধুর জীবন। বেগম ফজিলাতুন নেছা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রেনু আমার পাশে না থাকলে এবং আমার সব দুঃখকষ্ট, অভাব-অনটন, বারবার কারাবরণ, ছেলেমেয়ে নিয়ে অনিশ্চিত জীবনযাপন হাসিমুখে মেনে নিতে না পারলে আমি আজ বঙ্গবন্ধু হতে পারতাম না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও যুক্ত থাকতে পারতাম না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় সে আদালতে নিত্য হাজিরা দিয়েছে এবং শুধু আমাকে নয়, মামলায় অভিযুক্ত সবাইকে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছে। আমি জেলে থাকলে নেপথ্যে থেকে আওয়ামী লীগের হালও ধরেছে।’ 
বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছেন,  ‘... সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনদিন আমার স্ত্রী বাধা দেয়নি। এমনও দেখেছি যে অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনদিন মুখ কালা কিংবা আমার ওপর প্রতিবাদ করেনি। তাহলে বোধহয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। এমন সময় আমি দেখেছি যে আমি যখন জেলে চলে গেছি, আমি একআনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারিনি আমার ছেলেমেয়ের কাছে। আমার সংগ্রামে তাঁর দান যথেষ্ট রয়েছে।’ 

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে তার মাকে নিয়ে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি তার মাকে যেন নয়, এক সর্বংসহা মহীয়সী নারীকে তুলে ধরেন। ঐ বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘একটার পর একটা ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। কিন্তু একটা জিনিস আমি বলব যে, আমার মাকে আমি কখনো ভেঙে পড়তে দেখিনি। কখনো, যত কষ্টই হোক আমার বাবাকে বলেননি যে, তুমি রাজনীতি ছেড়ে দাও বা চলে আস বা সংসার করো বা সংসারের খরচ দাও। কখনো না।
...সংসারটা কিভাবে চলবে সম্পূর্ণভাবে তিনি নিজে করতেন। কোনদিন জীবনে কোনো প্রয়োজনে আমার বাবাকে বিরক্ত করেননি। মেয়েদের অনেক আকাঙ্ক্ষা থাকে স্বামীদের কাছ থেকে পাবার। শাড়ি, গহনা, বাড়ি, গাড়ি, কত কিছু!...এত কষ্ট তিনি করেছেন জীবনে; কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেননি। চাননি। ...কখনো অভাব কথাটা মায়ের কাছ থেকে শুনিনি। এমনও দিন গেছে বাজার করতে পারেননি। আমাদের কিন্তু কোনদিন বলেননি, আমার টাকা নেই, বাজার করতে পারলাম না।
লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক সাহিত্যিক আবদুল গাফফার চৌধুরী তার একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘...জাতির সাহসী ও মমতাময়ী জননী হয়ে সেই রক্তের সঙ্গে নিজের রক্ত মিশিয়েছেন বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব। কৃতজ্ঞ জাতির কাছে তিনি তাই বঙ্গমাতা।... এই মহীয়সী নারীর জীবন পরম গৌরবের। একদিকে তিনি জাতির পিতার পত্নী, শহীদ সন্তানদের জননী এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একজন শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেত্রী শেখ হাসিনারও জন্মদাত্রী।

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং 
অস্ট্রিয়া প্রবাসী লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক
[email protected]

বিডি প্রতিদিন/এএ

সর্বশেষ খবর