আবাসন খাতে অন্যতম সফল প্রতিষ্ঠান জেসিএক্স গ্রুপ। প্রতিষ্ঠান ও নিজের কর্মজীবন নিয়ে সফলতার গল্প বলেছেন গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী (জুয়েল)। তিনি বলেন, গ্রাহক সন্তুষ্টিই আমাদের প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। জেসিএক্স গ্রুপের সফলতার মূলমন্ত্র হলো অঙ্গীকার। আমরা জাপানি ব্যবস্থাপনা নীতি টোটাল কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট (টিকিউএম) ব্যবহার করে নির্ধারিত সময়ে প্রোডাক্ট গ্রাহকের হাতে তুলে দিয়ে আমাদের অঙ্গীকার রক্ষা করে সফলতা অর্জন করেছি।
মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী (জুয়েল) বলেন, গ্রাহকদের সন্তুষ্টি ও খুশিই আমার কাছে প্রথম। কত টাকায় ফ্ল্যাট বিক্রি করলাম তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভোক্তাদের কতটুকু খুশি করতে পারলাম। আমরা সবসময় চাই সর্বোচ্চটুকু দিয়ে গ্রাহকদের জন্য সেরা মানের ফ্ল্যাট সঠিক সময়ে যেন বুঝিয়ে দিতে পারি। আমাদের কাছে গ্রাহকরাই সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আমরা বাংলাদেশে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে ব্যাপক জাপানি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের সঙ্গে রয়েছে জাপানের স্বনামধন্য ক্রিড গ্রুপ। যারা বাংলাদেশসহ এশিয়ার বহু দেশে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে। কর্ম অভিজ্ঞতা ও ব্যবস্থাপনা নীতিকে পুঁজি করে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ভিতরে জেসিএক্স ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড গ্রাহক আস্থায় এক নম্বর জায়গা ধরে রেখেছে। আমার ইচ্ছা ছিল একটা ব্র্যান্ড তৈরি করা, যার প্রতি মানুষের আস্থা এবং ভালোবাসা থাকবে। এত বছর এই ব্যবসা করছি কিন্তু আমার নামে কোথাও কোনো নেতিবাচক কিছু ঘটেনি। গ্রাহক কখনো আমাদের কাছে ঠকেনি। এই সুনাম নিয়েই কাজ করে যেতে চাই ।
ব্যবসা শুরুর গল্প বলতে গিয়ে তরুণ এই এফবিসিসিআই পরিচালক বলেন, ২০০৫ সালে আবাসন ব্যবসা শুরু করি। সেসময় আমার একটা ছোট কোম্পানি ছিল নেপিয়ার হোমস লিমিটেড নামে। আমি বন্ধুদের সঙ্গে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ঘুরতে এসেছিলাম। এখানে এসে এই এলাকা দেখে আমার খুব ভালো লাগে। এখানে উন্নয়ন কাজের প্রচুর সুযোগ আছে সেটা বুঝতে পারি। গুলশান-বনানী-উত্তরা-বিমানবন্দর-পূর্বাচলের খুব কাছে এই এলাকা হওয়ায় তা আমার কাছে সম্ভাবনাময় মনে হয়েছিল। ২০০৮ সালে জেমস ব্রান্ডের ব্যানারে প্রজেক্ট শুরু করি। এই ব্যানারে আমরা প্রচুর প্রজেক্ট সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছিলাম। আমি ২০১৮ সালে জাপানিদের নিয়ে নতুন একটা প্রতিষ্ঠান জেসিএক্স প্রতিষ্ঠা করি। ইচ্ছা ছিল শুরু থেকেই প্রিমিয়াম কাস্টমারদের নিয়ে উন্নতমানের কাজ করা। জাপানি ক্রিড গ্রুপ আমাদের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করায় আমরা সেটাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছি। কাজের অনুপ্রেরণার বিষয়ে বেঙ্গল ব্যাংকের পরিচালক মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী (জুয়েল) বলেন, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের অনুপ্রেরণায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় জাপানিদের নিয়ে বিনিয়োগ শুরু করি। তিনি সর্বদা বিভিন্নভাবে সার্বিক সহযোগিতা, দিকনির্দেশনা, স্নেহ দিয়ে কৃতজ্ঞ করেছেন। তাঁর স্নেহ ও সান্নিধ্য প্রতিনিয়ত শক্তি জোগায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার। তাঁর সহযোগিতা ছাড়া আমি আজকের এই অবস্থানে আসতে পারতাম না। যখনই তাঁর কাছে কোনো পরামর্শের জন্য গিয়েছি সবসময় তিনি সময় দিয়েছেন। আর বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও বসুন্ধরা আবাসিকে কাজ করতে পেরে খুশি। সব মিলিয়ে জাপানিদের যে ফ্লেভার তা এই বসুন্ধরায় পাবেন; যা অন্য কোথাও পাবেন না।বর্তমানে আবাসন খাতের ব্যবসা পরিস্থিতি বিষয়ে জাপাস্তি কোম্পানির এই পরিচালক বলেন, আবাসন ব্যবসায় খুব চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছি আমরা। প্রতিটি কাঁচামালের দাম বেড়েই চলেছে। রড, সিমেন্ট, ইট, সিরামিকস, গ্লাস সবকিছুর দাম বেশি। ৩৫০ টাকা দামের সিমেন্ট ৫১৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আমরা এখন কীভাবে গ্রাহকের কাছে আগের দামে ফ্ল্যাটগুলো হস্তান্তর করব সেটা চ্যালেঞ্জিং হয়েছে। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউসিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়ে একটি চিঠি ইস্যু করেছে। তারা গ্রাহকদের সঙ্গে দাম সমন্বয়ের কথা বলেছে। তারা বলেছে, আমরা যেন গ্রাহকদের সঙ্গে বসে এই বাড়তি বাজারমূল্য পূর্বনির্ধারিত দামের সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন একটা দাম নির্ধারণ করি। এ উদ্যোগ কতটুকু কার্যকর হয় সেটা এখন দেখার বিষয়। সময়টা খুবই কঠিন। এটা চ্যালেঞ্জিং কারণ গ্রাহকরা তাদের বাজেট অনুযায়ী ফ্ল্যাট কিনেছেন। এখন বাড়তি আরও অর্থ দিতে বললে তাদের জন্য হয়তো মুশকিল হবে। আসলে এ পরিস্থিতি গ্রাহক এবং ব্যবসায়ী উভয়কেই চাপে ফেলেছে।
আমরা ২০১২ সাল থেকে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করছি। প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আমরা এনেছি। বিদেশি বিনিয়োগ আনা সহজ। কিন্তু আবাসন খাতে বিদেশি কোনো ঋণ আনা যায় না। আমরা চেষ্টা করেছিলাম। এ খাতে ঋণ আনার সুযোগ থাকলে ২ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বিদেশ থেকে ঋণ আনা যেত। বাংলাদেশ ব্যাংকের বাধা আছে এখানে।
একটা প্রজেক্টে আমরা ডলারের দাম ৮০ টাকায় বিনিয়োগ করেছিলাম। প্রজেক্ট শেষে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যখন ফিরে যাচ্ছে তখন ডলারের দাম ১১০ টাকা চলছে। এত লাভ তো এই প্রতিষ্ঠান করেইনি। তাই বিদেশি বিনিয়োগ এ ক্ষেত্রে বিমুখ হয়ে পড়ছে।
যখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ শেষে তাদের অর্থ ফেরত নিয়ে যাবে সে প্রক্রিয়া খুবই জটিল। হাই কোর্ট পর্যন্ত গিয়ে একটা প্রতিষ্ঠানকে সার্বিক কাজ শেষ করে টাকা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হয়। সরকার বিনিয়োগ আনতে যদি উৎসাহিত করে তাহলে প্রজেক্ট শেষে সে প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ এবং মূলধন ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াও সহজ করতে হবে। একটা কোম্পানির মূলধন ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ শেষ করতে দেড় বছর লেগেছিল, এই টাকাটা ব্যাংকে পড়েছিল। তাতে আমাদেরও লাভ হয়নি, ওই প্রতিষ্ঠানেরও লাভ হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চান না এভাবে তাদের টাকা পড়ে থাকুক। এ প্রক্রিয়া বিডার মাধ্যমে ওয়ানস্টপ সার্ভিস করলে অনেক সহজ হতো। আমাদের ১১টি প্রতিষ্ঠানের কাছে কাগজ নিয়ে ছুটতে হয়। এক প্রতিষ্ঠানের কাছে কাজ শেষ হলে তবেই অন্য প্রতিষ্ঠানে আবেদন করা যায়। একসঙ্গে ১১ প্রতিষ্ঠানে আবেদনের সুযোগ নেই। এই জটিলতার কারণে ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে এবং বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
আবাসন খাতে সরকারের পলিসিগত কারণে ঋণ নেওয়া খুব কঠিন। দু-একটা বড় প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ পায় না। আবাসন কোম্পানিগুলোকে একটা বরাদ্দ দিয়ে ঋণ দেওয়া হলে ব্যবসা আরও বিকশিত হতো। আবাসনের জন্য গ্রাহকদের ঋণ সুবিধা আছে, কিন্তু ব্যবসায়ীদের নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার ঋণ নীতিমালা করলে এ খাত আরও সমৃদ্ধ হবে।
আবাসন ব্যবসার অঞ্চলভিত্তিক সম্ভাবনার বিষয়ে মো. ইকবাল হোসেন চৌধুরী (জুয়েল) বলেন, আমাদের জেলা শহরগুলোতেও আবাসন ব্যবসা ছড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। বড় আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা, চট্টগ্রামের বাইরে যায়নি এখনো। আর এর বাইরে গ্রাহক চাহিদাও গড়ে ওঠেনি। জেলা শহরগুলোতে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু ডেভেলপার নিজ উদ্যোগে কাজ করছে। এ খাতে সম্ভাবনা বাড়ছে। অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনায় ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে গ্রাহক, বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ী সবার কথা বিবেচনা করে সুষ্ঠু আবাসন নীতিমালার জোর দাবি জানিয়েছেন এ ব্যবসায়ী। আবাসন ছাড়াও এই গ্রুপের সফল পদচারণা রয়েছে পর্যটন, আর্থিক খাত (ব্যাংক-বীমা), অটো, খাদ্য ও রেস্টুরেন্ট এবং এনার্জি খাতে।