সোমবার, ১৩ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

গরমে বেড়েছে এসির চাহিদা

♦ বড় হচ্ছে এসির বাজার ♦ বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোও দেশে কারখানা স্থাপন ও অ্যাসেম্বলিং করছে ♦ বিপুল বিনিয়োগ করেছেন দেশি উদ্যোক্তারাও

শাহেদ আলী ইরশাদ

গরমে বেড়েছে এসির চাহিদা

দেশে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিকস পণ্যের বাজার ক্রমেই বড় হচ্ছে। গত কয়েক বছরে এসি বিক্রির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। টেলিভিশন, ফ্রিজের তুলনায় এয়ারকন্ডিশনের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের সঙ্গে সংগতি রেখে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিকস পণ্য এসির বাজার...

 

তীব্র গরমে হাঁসফাঁস শুরু হয়েছিল মানুষের। ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রচণ্ড গরমের কারণে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এসি বিক্রি বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। দামও বেড়েছে কিছুটা। অসহনীয় গরমে একটু প্রশান্তি এনে দিয়ে মানুষের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে এসি। দেশে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিকস পণ্যের বাজার ক্রমেই বড় হচ্ছে। গত কয়েক বছরে এসি বিক্রির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। টেলিভিশন, ফ্রিজের তুলনায় এয়ারকন্ডিশনের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের সঙ্গে সংগতি রেখে দ্রুতই ঘুরে দাঁড়িয়েছে দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিকস পণ্য এসির বাজার।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের তথ্যানুসারে, বর্তমানে দেশে প্রতি বছর সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ ইউনিট এসি বিক্রি হয়। অফিস আদালতে ৫ টনের এসি বেশি ব্যবহার হলেও বাসাবাড়িতে এক থেকে দুই টনের এসি বেশি ব্যবহার হয়। বর্তমানে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী দেড় টন ক্ষমতার ইনভার্টার এসি বেশি ব্যবহার করছেন মানুষ।

মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও শহুরে মানুষের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার সঙ্গে কনজিউমার ইলেকট্রনিকস বাজারের প্রবৃদ্ধি নির্ভরশীল। গরমের কারণে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের জেলা এবং উপজেলা শহরেও বেড়েছে এসির চাহিদা। বাজারে বর্তমানে দেশে ওয়ালটন, ইলেক্ট্রোমার্ট, ট্রান্সকম, এসকোয়্যার, সিঙ্গার বাংলাদেশ, বাটারফ্লাই, র‌্যাংগস, ইলেকট্রা ইন্টারন্যাশনাল, মিনিস্টার, ভিশন, এলজিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসি উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোও খরচ কমিয়ে বাজার ধরতে দেশে কারখানা স্থাপন করছে। গরমের কারণে এসব কোম্পানি আগে থেকেই এসির উৎপাদন বাড়িয়েছে। ৩০ শতাংশ উৎপাদন বাড়িয়েছে দেশি কোম্পানি ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ। চলতি বছর তারা ২ লাখ ইউনিট এসি উৎপাদন করবে বলে জানা গেছে। এসব এসির ৭০ শতাংশই বিক্রি হবে আগামী জুন মাসের মধ্যে। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাহিদা বাড়ায় ব্র্যান্ডভেদে প্রতিটি কোম্পানির এসির দাম বেড়েছে ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত। তবে অনেক কোম্পানি আবার দাম বাড়ায়নি। কারণ ডলার সংকটের কারণে গত দেড় থেকে দুই বছর ধরে প্রতিটি এসির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশের তথ্যানুসারে, বর্তমানে দেশে প্রতি বছর সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ ইউনিট এসি বিক্রি হয়।  অফিস-আদালতে ৫ টনের এসি বেশি ব্যবহার হলেও বাসাবাড়িতে এক থেকে দুই টনের এসি বেশি ব্যবহার হয়। বর্তমানে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী দেড় টন ক্ষমতার ইনভার্টার এসি বেশি ব্যবহার করছেন মানুষ।

 

এ বিষয়ে ইলেক্ট্রো মার্টের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহম্মদ নুরুল আফছার বলেন, গরমের কারণে এয়ারকন্ডিশনারের চাহিদা বেড়েছে। বাজারের ৬০ শতাংশ অংশীদার গ্রি এয়ারকন্ডিশনারের। ২৫ বছর ধরে বিশ্বমানের পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। আমাদের পণ্যে সব সময় আন্তর্জাতিক মানের এবং সার্টিফায়েড, ফুড গ্রেড যন্ত্রাংশ ব্যবহার করি। যে কারণে আমাদের পণ্য ভোক্তার কাছে বেশ জনপ্রিয়। এয়ারকন্ডিশনারের পাশাপাশি কনকা ফ্রিজ ও টেলিভিশন বেশ জনপ্রিয়। কয়েক মাস আগের তুলনায় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সব পণ্যের বিক্রি বেড়েছে। গত বছর চাহিদা ছিল অল্প সময়ের জন্য। হঠাৎ করে অনেক বেশি গরম পড়ায় সবাই মনে করেছিল চাহিদা অনেক বেশি থাকবে। কিন্তু তা আবার কমে যায়। গত বছরের তুলনায় এ বছর এসি কেনাবেচার বাজার একটু বেশি। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য এসির প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। কর্মজীবী পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ফলে মানুষ কর্মক্ষেত্রে এবং অবসর সময়ে আরামদায়ক ও স্বস্তির পরিবেশ নিশ্চিত করতে চায়। এ ছাড়া রাতে একটু ভালো ঘুম এবং শান্তিতে বিশ্রাম নিতে চায় যাতে কর্মঘণ্টা সময়ে সঠিক মানের আউটপুট নিশ্চিত করা যায়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শতভাগ বিদ্যুতায়িত হওয়াসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসির বাজারও বড় হচ্ছে। এসব বিষয়ের কারণে মানুষ এখন এসির ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। এ ছাড়া এসি এখন আর বিলাসি পণ্যের মধ্যে নেই, বরং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে পরিণত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সময়ে প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে এসি। গ্রাহক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে বাজার বড় হচ্ছে দেশি এসি কোম্পানিগুলোর। এ খাতের উদ্যোক্তাদের মতে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর মার্কেট শেয়ার ছিল ৮০ শতাংশ, সেখানে ২০২৩ সালে চিত্রটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এখন বাজারের মাত্র ২০ শতাংশ শেয়ার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর দখলে। সাশ্রয়ী মূল্য, গুণগত মান, দেশের মানুষের চাহিদা ও আবহাওয়া উপযোগী হওয়ার কারণে গ্রাহক দেশি ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য কিনতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, এক দশক আগেও দেশে এসির বাজার ছিল উচ্চবিত্তকেন্দ্রিক। পরিস্থিতি পাল্টেছে। দেশে এয়ারকন্ডিশনারের (এসি) চাহিদার সঙ্গে বাড়ছে উৎপাদনও। দাম মধ্যবিত্তের নাগালে আসায় বড় হচ্ছে এসির বাজার। অধিকাংশ কোম্পানির এয়ারকন্ডিশনার দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশে এসি উৎপাদনের জন্য কারখানা স্থাপন করেছে। উৎপাদনকারী ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, বছরে ৫ থেকে ৬ লাখ (ইউনিট) এসি বিক্রি হয়। বাজারসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসির বার্ষিক বাজার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। এসির বাজারের প্রবৃদ্ধি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। আগামী দুই থেকে তিন বছরে তা ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে বলে প্রত্যাশা। সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তির ইনভার্টার এসি বাজারে এসেছে। ফলে এসি ব্যবহার করা এখন সাধ্যের মধ্যে।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মার্কেটিং ডিরেক্টর কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘চলতি মৌসুমে আমাদের ভিশন এসির দাম বাড়ানো হয়নি। বরং ক্রেতাদের জন্য মূল্যছাড় ও মানিব্যাক গ্যারান্টিসহ বিভিন্ন সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আগের মাসের তুলনায় এপ্রিলে ১০০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি রয়েছে।’

এ বিষয়ে ওয়ালটন এসির চিফ বিজনেস অফিসার মো. তানভীর রহমান জানান, গ্রাহকদের হাতে বিশ্বের সর্বাধিক ফিচারসমৃদ্ধ সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এসি তুলে দেওয়ার পাশাপাশি সর্বোচ্চ গ্রাহক সুবিধা এবং বিক্রয়োত্তর সেবা নিশ্চিত করেছি। এ বছর গরমের শুরুতেই বিএসটিআই এর ৬-স্টার এনার্জি রেটিং সনদপ্রাপ্ত নতুন মডেলের এসি বাজারজাত করছে ওয়ালটন। আমাদের এসিতে বিশ্বস্বীকৃত সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব আর ৩২ রেফ্রিজারেন্ট কম্প্রেসারে ব্যবহার করা হয়েছে। ওয়ালটন এসির ‘ফোর-ডি এয়ার ফ্লো’ টেকনোলজি রুমের প্রতিটি কোনায় কোনায় বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করে এবং এর টার্বো কুল টেকনোলজি নিমিষেই রুমকে ৪০ শতাংশ দ্রুত ঠান্ডা করে। থ্রি ইন ওয়ান কনভার্টার টেকনোলজির এ এসি গ্রাহকের রুমের আয়তন অনুযায়ী ১.৫ টন থেকে ১ টন এবং পৌনে এক টনে রূপান্তরের সুবিধা রয়েছে।

বাজার গবেষকদের মতে, ডিজিটাল বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এর সহযোগী শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন উৎপাদন কর এবং শুল্কের সরকারি নীতি থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য দেশি এবং বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর দ্বারা তাদের উৎপাদন ধীরে ধীরে স্থানীয়করণের মাধ্যমে আরও বিনিয়োগ বাড়াবে। ফলে এই অভ্যন্তরীণ বাজার বাড়ানোর পাশাপাশি রপ্তানির উদ্দেশ্য ও উৎপাদকদের বিনিয়োগ বাড়বে। সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে টেলিভিশন, ফ্রিজ, এসি, ওয়াশিং মেশিন এবং অন্যান্য হোম অ্যাপ্লায়েন্সের বাজার ২০২৫ সালের মধ্যে বার্ষিক ১০ বিলিয়ন ডলারে পরিণত হবে।

বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের (বিসিজি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ, যা ২০২৫ সালে গিয়ে ৩ কোটি ৪০ লাখে দাঁড়াবে। প্রতি বছর এ শ্রেণিতে গড়ে ১০ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ যোগ হচ্ছে, যা ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের চেয়ে বেশি।  মূলত এ সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনা করেই স্থানীয় বড় ব্যবসায়িক গ্রুপগুলো ইলেকট্রনিকস খাতে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছে। পাশাপাশি বাজার ধরে রাখতে বেশ কিছু বিদেশি ব্র্যান্ডও বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থাপন করেছে। কভিডের পর কনজিউমার ডিউরেবলসের প্রবৃদ্ধি কিছুটা থমকে গেলেও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে গতি ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ খাতেও প্রবৃদ্ধি বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ খবর