জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন-মোমেন বলেছেন, ‘একাত্তরের ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’র স্বীকৃতির জন্যে সর্বাত্মক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছে। সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সাথে এ নিয়ে দেন-দরবারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সমর্থন লাভের চেষ্টাও চলছে। ইতিপূর্বে রুয়ান্ডাসহ যে সব দেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মিলেছে, সে সব দেশের অভিজ্ঞতাও আমরা জানছি। সেভাবেই নিউইয়র্কে আমরা যেমন তৎপর রয়েছি, একইভাবে জেনেভাসহ বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রসমূহে কর্মরত বাংলাদেশ কন্স্যুলেট ও দূতাবাসেরও যোগাযোগ বাড়াতে হবে। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে সেটিও চলছে।’
জাতিসংঘে বাংলাদেশের অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক কটূনীতির হাল-হকিকত নিয়ে শুক্রবার নিউইয়র্ক হতে প্রকাশিত এবং উত্তর আমেরিকায় বাংলা ভাষায় প্রাচিনতম ও সর্বাধিক প্রচারিত ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’কে দেওয়া বিশেষ এক সাক্ষাতকারে মাসুদ বিন-মোমেন উল্লেখ করেছেন, ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ের ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও ভূমিকা রয়েছে। তারা যে দেশে অবস্থান করছেন, সেই সব দেশের নীতি-নির্দ্ধারক, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান, সিনেটর অথবা স্টেট ডিপার্টমেন্টের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে এখানকার প্রবাসীরা এ নিয়ে কথা বলতে পারেন। ই-মেইলে অনুরোধ রাখতে পারেন। হোয়াইট হাউজেও ফ্যাক্স অথবা অনলাইনে অনুরোধ রাখতে পারেন। অর্থাৎ সম্মিলিত একটি প্রচেষ্টার দরকার। তাহলে বিষয়টি ত্বরান্বিত হবে এবং এক সময় আমাদের মহান ভাষা দিবস যেভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে, ঠিক একইভাবে গণহত্যা দিবসও স্বীকৃতি লাভ করবে।’
গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘দেখুন, গতমাসেই বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে এ সম্পর্কিত বিল পাশ হয়েছে। এরপরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা জেনেভা এবং নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে সংশ্লিষ্ট পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাত করে বিষয়টি অবহিত করে গেছেন। বিশেষ করে গণহত্যা প্রতিরোধ সম্পর্কিত উর্দ্ধতন কর্মকর্তা এডামা ডিয়াংয়ের সাথেও তারা সাক্ষাৎ করে এ ব্যাপারে তার সহায়তা চেয়েছেন। ইতিমধ্যেই ভারত ও ভূটানের সমর্থন পাওয়া গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ দুটি দেশ সফরকালে তিনি তাদের সমর্থন লাভে সক্ষম হন। এ পর্যায়ে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সম্যক ধারণা রয়েছে এবং সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, সে সব দেশের সাথে কথা বলছি। ইতিমধ্যেই যে সব দেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মিলেছে, সে সব দেশের অভিজ্ঞতা আমরা জানছি। কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে, সে সব তথ্যও অবহিত হচ্ছি।’
রুয়ান্ডার স্থায়ী প্রতিনিধির সাথে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করে অফিসে ফেরার পরই এ সাক্ষাতকার দেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ। তিনি বলেন, ‘কিছুক্ষণ আগেই রুয়ান্ডার পিআরের সাথে কথা বলেছি। তাদেরকে নানা জটিলতা অতিক্রম করতে বেশ কিছু সময় লেগেছে। এটি আমরা সকলেই জানি যে, ১৯৯৫ সালে সংঘটিত রুয়ান্ডার গণহত্যা ছিল অত্যন্ত নৃশংসতায় পূর্ণ। আমাদের তুলনায় সেটি খুব পুরনো নয়।’ তবুও তাদেরকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন স্থায়ী প্রতিনিধি।
‘সিকিউরিটি কাউন্সিলে এ নিয়ে রেজ্যুলেশন পাশের পর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে রেজ্যুলেশনের সময় তাদেরকে দীর্ঘ ৮ বছর চেষ্টা চালাতে হয়েছে। ২০০৩ সালে সেটি পাশ হয়েছে সাধারণ অধিবেশনে। এসব অভিজ্ঞতা বিস্তারিতভাবে আমি জেনে এলাম। তিনিও আমাকে আশা দিয়েছেন সর্বাত্মক সহায়তার। আরমেনিয়ার গণহত্যার তথ্যাবলিও সংগ্রহ করেছি। সবকিছু মিলিয়ে আমরা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে সামনে এগুনোর পথে রয়েছি। তবে এজন্যে আমাদেরও কিছুটা সময় লাগতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এ দাবি আদায়ে শুধুমাত্র সরকার এগিয়ে আসলেই হবে না। প্রবাসীদেরকেও নিজ নিজ দেশের নীতি-নির্দ্ধারকদের সাথে দেন-দরবার চালাতে হবে। আমি যখনই কোন অনুষ্ঠানে যাই, সেখানেই এ আহবান রাখি।’
জাতিসংঘ থেকে আরমেনিয়ার বর্বরতাকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’র স্বীকৃতি আদায়ে কী ধরনের তৎপরতা চলছে সে আলোকে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, ‘২২ এপ্রিল একটি মুভি রিলিজ হয়েছে। তার নাম ‘প্রমিজ’। হলিউডে নির্মিত এই ছবিতে ১৯১৫ সালে ১০ লক্ষাধিক আরমেনিয়ানকে নির্বিচারে হত্যার ঘটনাবলীর ভিত্তিতে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। আরমেনিয়ান মিশন থেকে এ ছবিটি কূটনীতিকদের জন্যে ইতিপূর্বেই প্রদর্শন করা হয়েছে। আরমেনিয়ান-আমেরিকান অস্কার আইজ্যাক ১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এটি তৈরী করেছেন। সেই গণহত্যার কথা মানুষ প্রায় ভুলেই গেছিলেন। এই মুভি যারা দেখবেন তারাই স্পষ্ট একটি ধারণা পাবেন কীভাবে আরমেনিয়ার সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানদের হত্যা করা হয়েছে। ১০০টি সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করেও যা সম্ভব হবে না, এই একটিমাত্র মুভি তার চেয়েও অনেক বেশী অবদান রাখবে ঐ গণহত্যার ভয়াবহতা জনসমক্ষে উপস্থাপনে। হলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এতে অভিনয় করছেন। এই ছবি নির্মাণেও সময় লেগেছে ৫ বছর। আরমেনিয়ান স্থায়ী প্রতিনিধির সাথে বৈঠকের সময় তিনি আমাকে বলেছেন, ১০০ বছর ধরে চেষ্টা করছি, প্রয়োজনে আরো ১০০ বছর চেষ্টা করবো, তবুও আমরা থামবো না।’
রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, ‘আমাদের প্রবাসীরাও এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে সেটি দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে-তা বলা যায় অনায়াসে। বিশেষ করে শিক্ষাবিদদের সাথে শিক্ষাঙ্গনে সভা-সেমিনার করা যেতে পারে। পৃথিবীতে গণহত্যা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, তাদের সাথে কথা বলা যেতে পারে, এ নিয়ে বাংলাদেশে এবং পরবর্তীতে আঞ্চলিক পর্যায়ে সভা-সেমিনার হতে পারে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ২৫ মার্চের বর্বরতার তথ্য ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, গবেষণাতেও সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছেন অনেক প্রবাসী, তাদের মাধমেও ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের তথ্য মূলধারায় ছড়িয়ে দেয়া সহজ হতে পারে। অর্থাৎ যে যেখানেই আছেন, সেখান থেকেই এ ব্যাপারে আন্তরিক অর্থে সোচ্চার হবার অনুরোধ জানাচ্ছি। সকলকে নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগে এ কাজে আমাদের সক্রিয় থাকতে হবে। এটিকে বিবেচনা করতে হবে চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে।’
রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন, ‘আমাদের এই অভিযাত্রায় যারা আন্তরিক অর্থেই সহযাত্রী হতে পারেন বলে মনে করছি, তাদের সাথে কথা বলছি সবকিছুর আগে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ভেটো প্রদানের ক্ষমতা যাদের রয়েছে সেই ৫ রাষ্ট্রকে সাথে রাখতে হবে। কেউ যদি সমর্থন না-ও দেয়, অন্তত: বিরোধিতা যাতে না করে। এটিও স্মরণ রাখা জরুরী। এটিও আমরা সামনে রেখেছি।’
জাতিসংঘ স্বীকৃত ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এ স্বীকৃতি আদায়েও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। এর বিরোধীতাও ছিল প্রবল। তাই চ‚ড়ান্ত রেজ্যুলেশনেও ‘প্রিভেনশন অব জেনোসাইড’ শব্দটি সন্নিবেশিত হয়েছে। অর্থাৎ আর গণহত্যা নয়-এমন একটি সংকল্প সামনে রাখা হয়েছে। কোন দেশে গণহত্যার ভয়াবহতা কতটা-সেদিকে কেউ শেষ পর্যন্ত যায়নি। গণহত্যার মত নিষ্ঠুরতা আর যাতে না ঘটে-সে বিষয়টি সামনে রাখা হয় ঐ রেজ্যুলেশনে।’
২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বিল পাশের পর নিউইয়র্কে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির সাথে কখনো কী আপনার সাক্ষাত ঘটেছে কিংবা এ নিয়ে তারা কি কোন অভিমত পোষণ করেছেন-এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, ‘ঐ পর্যায়ে এখনো আমরা যাইনি। এখন পর্যন্ত আমরা গণহত্যা সংক্রান্ত অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহ করছি। তথ্য সংগ্রহের পর আমরা সে সব বিশ্লেষণ করবো এবং তারপরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সে পর্বেই হয়তো সদস্য রাষ্ট্রের সাথে সরাসরি আলোচনা শুরু করা হবে সমর্থন লাভের জন্যে।’
জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, ‘শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত সংহত। দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশের ট্রুপসের সাহসিকতা, নিষ্ঠার প্রশংসা সর্বত্র। তবে, এই মিশন পরিচালনায় সবচেয়ে বেশী অর্থ প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতিমধ্যেই এ খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছেন। এরফলে মিশনগুলো অব্যাহত রাখা নিয়ে নানা সংকটের আশংকা প্রকাশ করা হচ্ছে। কিছু মিশন বন্ধ হয়েও যেতে পারে। আমরা সচেষ্ট রয়েছি, মিশনগুলো অব্যাহত রাখার জন্যে। শান্তি প্রক্রিয়া যাতে ব্যাহত না হয়-সেভাবে দেন-দরবারও চলছে।’
ইতিমধ্যেই হাইতির মিশন একেবারেই ছোট করার কথা বলা হয়েছে। আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানের মিশন নিয়েও কথা হচ্ছে। হাইতিতে আমাদের শুধুমাত্র মহিলা পুলিশের একটি টিম রয়েছে। আলাদা করে বড় ব্যাটেলিয়ন ছিল না। সেটি পরিচালিত হচ্ছিল রুয়ান্ডার নেতৃতে। কঙ্গোতে রয়েছে বড় একটি মিশন। সেটিও ছোট করা হতে পারে আর্থিক কারণে’-বলেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ।
‘গোলযোগপূর্ণ এলাকার শান্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার স্বার্থে সবকিছু যাতে অটুট রাখা যায়, হঠাৎ করে কোন মিশন বন্ধ করার ফলে যে ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে-তা নিয়ে আমরাও কাজ করছি সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে’-বলেন স্থায়ী প্রতিনিধি।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়র লক্ষ্য তথা এসডিজি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘ইকসকের হাই লেভেল পলিটিক্যাল ফোরামে ৪২টি দেশ স্বেচ্ছায় অঙ্গিকার করেছে যে, তারা নিজ নিজ দেশে এসডিজি বাস্তবায়নের অগ্রগতির ওপর সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবে। মনিটরিংয়ের সেই পদ্ধতি স্থাপনের কাজ চলছে ঢাকায়। জুলাই মাসে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক হবে। সে সময় তা চালু হবে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সমন্বয়কারি আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে এ কাজ চলছে। এর নাম হচ্ছে, ‘এসডিজি ট্র্যাকার।’ এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে চরম দারিদ্র দূরিকরণ, অন্যায় আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই এবং প্রত্যেক দেশের জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুকে কীভাবে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে তা তার ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারির পর অগ্রগতি নির্দিষ্ট করবে এই পদ্ধতি। তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর এই প্রক্রিয়া উন্নয়ন কর্মকান্ড ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় একটি ব্যবস্থায় পরিণত হবে।’
‘এমডিজি সীমাবদ্ধ ছিল উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মধ্যে। লক্ষ্যও ছিল শুধু উন্নয়নের। কিন্তু এসডিজি সকল রাষ্ট্রের জন্যেই নির্দ্ধারিত। আমেরিকার জন্যে যতটুকু প্রযোজ্য, ঠিক ততটুকু বাংলাদেশের জন্যেও। এবং এর লক্ষ্যও বিস্তৃত। ১৭টি মূল এজেন্ডার অধীনে ১৬৯টি টার্গেট রয়েছে। তবে সবদেশের জন্যে সবগুলো লক্ষ্য প্রযোজ্য নয়’ বলেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ।
মাঝেমধ্যেই প্রবাসীদের মধ্য থেকে কোন কোন গ্রুপ জাতিসংঘ মহাসচিব সমীপে স্মারকলিপি দেয়। এসব স্মারকলিপির অধিকাংশই বাংলাদেশের রাজনীতি নির্ভর। স্মারকলিপি গ্রহণের পর কখনো জাসিংঘ সচিবালয় থেকে আপনার সাথে তা নিয়ে কোন কথা বলা হয় কী-এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, ‘না কখনোই এমনটি ঘটেনি। আমি এক বছর চারমাস যাবত দায়িত্ব পালন করছি। তাদের ঢাকায় অফিস রয়েছে, হয়তো সরাসরি তারা সেখান থেকেই খোঁজ-খবর নিয়ে থাকতে পারেন।’
গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট তথা জিএফএমডির অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান কী জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা সভাপতি ছিলাম। সে সময়ে ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের একটি সমাবেশ হয়। এখন সভাপতির দায়িত্ব জার্মানীর। আমাদের চেয়ারম্যানশিপে অর্জন অনেক বেশী। গ্লোবাল কমপেক্ট অব মাইগ্রেশন হতে যাচ্ছে আগামীতে-যা আমাদের উদ্যোগেই সামনে আসে। গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ শীর্ষ সম্মেলনের সময় ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেশন শীর্ষক একটি সমাবেশও হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। ‘নিউইয়র্ক ডিক্লারেশন’ এসেছে সেখান থেকে। তার ফলোআপ হিসেবেই গ্লোবাল কমপেক্ট অব মাইগ্রেশন হতে যাচ্ছে। ২০১৮ সালে এটি রেজুলেশন আকারে গৃহিত হতে যাচ্ছে। তার আগে এ নিয়ে পর্যালোচনা-বিশ্লেষণ চলবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত সোচ্চার। কারণ, বাংলাদেশের বিরাটসংখ্যক মানুষ বিভিন্ন দেশে বাস করছেন। তাদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্যেই আন্তর্জাতিক সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিকল্প নেই। এর ফলে শুধু বাংলাদেশের মত মাইগ্রেন্ট সরবরাহকারি রাষ্ট্রই উপকৃত হবে না, একইসাথে যারা তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন, কাজের সুবিধা দিচ্ছেন, তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক দেবেন, সে সব শ্রমিক-কর্মচারির মানবাধিকার সুরক্ষা করবেন, সে সব দেশও তার রেজাল্ট পাবেন। এটি মূলত: পরস্পরের পরিপূরক। এক্ষেত্রে আমরা সরব রয়েছি সকল ফোরামে।’
‘গত বছর সিরিয়ার পরিস্থিতির কারণে বহু মানুষ দেশান্তরিত হন। ইউরোপ ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রেও আসতে থাকেন। তেমনি সময়ে রিফ্যুজির সাথে সন্ত্রাসীরাও আসছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ উঠে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের আসার পথ বন্ধ করে দেয়। এরফলে প্রাণভয়ে দেশত্যাগী মানুষেরা অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়েছিলেন। সে বিষয়টিও এই সিদ্ধান্তের পথ সুগম করবে বলে মনে করা হচ্ছে।’
বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ দমন ও নির্মূলে চলমান পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, ‘প্রিভেন্টিং ভাযোলেন্স এক্সট্রিমিজম’ এবং ‘কাউন্টারিং ভায়োলেন্স এক্সট্রিমিজম’-এ দুটি দিক রয়েছে। উভয় বিষয়েই জাতিসংঘ এখন বিশেষভাবে তৎপর। সেখানে বাংলাদেশকে বিশেষভাবে দেখার অবকাশ নেই। কারণ, সারাবিশ্বেই এখন এমন ঘটনা ঘটছে। আমরা চেষ্টা করছি, আমাদের দেশের আলোকে বিশেষ করে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গৃহিত পদক্ষেপকে কীভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাজারজাত করা যায়, সে ব্যাপারে আমরা তৎপর। সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে বাংলাদেশ যুব সমাজ, মা, ইমামসহ ধর্মীয় নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষকদের নিয়ে একযোগে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন যে, সন্তানকে সুপথে রাখতে মা’দের আরো সজাগ থাকতে হবে। কদিন আগেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসুদ এসেছিলেন জাতিসংঘে। এলায়েন্স অব সিভিলাইজেশন অফিসের কর্মকর্তাগণের সাথে তার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলাম। জাতিসংঘে একটি সেমিনারেও তিনি চমৎকার একটি ধারণা দিয়েছেন বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের ব্যাপারে। বাংলাদেশ যে কখনোই কোন ধরনের সহিংসতা এবং ধর্মের নামে সন্ত্রাসকে পছন্দ করে না, সরকারীভাবেও এ ধরনের আচরণকে সহ্য করার মানসিকতা নেই বলে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী-এসব কিছুই সংশ্লিষ্ট সকলের গোচরে রয়েছে।’
বিডি প্রতিদিন/২৯ এপ্রিল ২০১৭/হিমেল