শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
পর্ব ৫

একুল নেই ওকুল নেই

সমরেশ মজুমদার

একুল নেই ওকুল নেই

[পূর্বে প্রকাশের পর]

‘আর এটা স্বাভাবিক বিয়ে নয়। লাসভেগাসের বাইরে এই বিয়েকে বৈধ বলে ধরা হয় না। লস অ্যাঞ্জেলেস যেহেতু লাসভেগাসের কাছের শহর তাই টেনেটুনে চালিয়ে দেওয়া যায়। তার বাইরে নিউইয়র্ক ওয়াশিংটন দূরের কথা, সানফ্রান্সসিসকো শহরে ওই বিয়ের সার্টিফিকেট বৈধ নয়।’

‘সে কী! একটা জায়গায় বিয়ে হলে অন্য জায়গায় তা মেনে নেয় না?’

‘হ্যাঁ, তা ছাড়া আরও অনেক সুবিধা আছে।’

‘যেমন?’

‘এ বিয়ের জন্য অনেক আগে থেকে নোটিস দিতে হয় না। ওদের অফিসে গিয়ে এক ঘণ্টা আগে জানালেই ব্যবস্থা হয়ে যায়। আবার যদি তুমি ডিভোর্স চাও তাহলে এক ঘণ্টা আগে আবেদন করতে হয়। ডিভোর্সের কাগজ পেয়ে যাবে যদি দুজনই একমত হও। না হলে একটা টোকেন পেনাল্টি দিতে হয়।’

‘সর্বনাশ!’

‘আরে একটুও ঝামেলা নেই। তুমি রাজি হয়ে গেলে দিশাকে কিউবায় যেতে হয় না ভাই।’ শিবকুমার বলল, তা ছাড়া যেহেতু তুমিও অবিবাহিত তাই তোমাকেও কোম্পানি আমেরিকার বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারে।’

চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ল কমল, ‘এ রকম ব্যাপার আমি কখনো শুনিনি। মাথায় কিছু ঢুকছে না। আমি বিপদে পড়ে যাব না তো?’

‘বিপদ! কীসের বিপদ?’ কপালে ভাঁজ পড়ল শিবকুমারের।

চোখ খুলল কমল, ‘দ্যাখ আমি সাধারণ ঘরের ছেলে। আমেরিকায় এসেছি চাকরি পেয়ে। এসেই জানা নেই শোনা নেই একজন মহিলাকে বিয়ে করে ফেললাম এ কথা আমার বাড়ির মানুষ প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারবে না। হ্যাঁ আমাকে কয়েক বছর এখানে থেকে এ দেশের মেমসাহেবদের বিয়ে করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই সে রকম কিছু করার কথা আমি ভাবতেই পারি না। আমার বাবা সহ্য করতে পারবেন না।’

‘কী আশ্চর্য! এসব কথা তোমার বাবা জানবেন কী করে? আর তিনি কেন, আমরা তিনজন ছাড়া পৃথিবীর কারও জানার কথা নয়। সকালে বিয়ে করে তার সার্টিফিকেটের কপি রেখে বিকালে গিয়ে ওখানকার আইনমাফিক বাতিল করে নিলেই হবে।’

‘তারপর?’

‘সেই বিয়েটা একই দিনে ভেঙে না দিয়ে দিন সাতেক অপেক্ষা করে করাই ভালো। ওই সময়ের মধ্যে অফিসে বিয়ের কথা ইনফর্ম করে ওরা আর তোমাদের বিরক্ত করবে না। তখন এখানে আবার এসে বিয়ে ভাঙার সার্টিফিকেট নিয়ে গেলেই চলবে। পৃথিবীর কেউ ব্যাপারটা জানবেই না।’ হাসল শিবকুমার।

চোখ খুলল কমল, ‘দ্যাখ আমি সাধারণ ঘরের ছেলে। আমেরিকায় এসেছি চাকরি পেয়ে। এসেই জানা নেই শোনা নেই একজন মহিলাকে বিয়ে করে ফেললাম এ কথা আমার বাড়ির মানুষ প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারবে না। হ্যাঁ আমাকে কয়েক বছর এখানে থেকে এ দেশের মেমসাহেবদের বিয়ে করে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই সে রকম কিছু করার কথা আমি  ভাবতেই পারি না। আমার বাবা সহ্য করতে পারবেন না।’

সাঁতার না জেনে গভীর জলে পড়লে যা অবস্থা হয় তা-ই হলো কমলের। জলের ওপরে উঠে বাতাস নেওয়ার চেষ্টা করার মতো কমল বলল, ‘দিশা এসব জানে?

‘আশ্চর্য! দিশা না জানলে এত কথা এগোয় কী করে?’

‘উনি রাজি হয়েছেন?’

‘না হলে ওকে অপেক্ষা করতে হয়। কোম্পানি যদি বদলি করে তাহলে চাকরি ছেড়ে ভারতে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। অবশ্য দিশা যদি এবার কোনো ভালো চাকরি পেয়ে যায় তাহলে অন্য কথা।’

একটু চুপ করে থেকে কমল বলল, ‘শিবকুমার, আমি বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত। এ রকম বিয়ের কথা তো কোনো দিন শুনিনি।’

‘আমরা কেউ কি শুনেছি! ভারত কেন, পৃথিবীর কোথাও কি এমন বিয়ে হয়? হয় না। আর কিছু হোক বা না হোক তুমি ভারতীয় হয়ে আর একজন ভারতীয়কে বিপদ থেকে বাঁচাতে সাহায্য করছ।’

‘তুমি যে আমার সঙ্গে কথা বলছ তা কি দিশা জানে?’

‘হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে যে আজ আমি কথা বলব তা দিশা জানে।’ শিবকুমার বলল, ‘একজন মহিলাকে তুমি সাহায্য করছ, এভাবে ব্যাপারটা ভেবে নাও।’

শিবকুমার চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর দিশার টেলিফোন এলো, ‘অনেক ধন্যবাদ। রাখছি।’

শিবকুমারের সঙ্গে বাসে উঠে দেখল দিশা এর মধ্যেই পৌঁছে গেছে। ওদের দেখে মাথা নেড়ে হেসে অন্যদিকে তাকাল। খানিকটা দূরত্বে জায়গা পেয়ে কমলরা বসল। দিশা এদিকে তাকাল না। সে লক্ষ্য করল আজও দিশা অন্য দিনের মতো সাধারণ পোশাক পরে আছে। বিয়ে করতে যাবে সেটাই বোধহয় মনে হচ্ছে না। ব্যাপারটা ভাবা যায়? কলকাতার হলে বিয়ে করানোর অফিসে এ রকম পোশাকে কি যেতে পারত?

মরুভূমির খানিকটা পেরিয়ে জুয়ার শহরে পৌঁছে গেল ওরা। বাস থেকে নেমে দিশা বলল, ‘কমল, আপনার সঙ্গে আমি একটু আলোচনা করে নিতে চাই।’

শিবকুমার হাসল,‘ ম্যাডাম, আপনারা কথা বলুন আমি-।’

তাকে থামিয়ে দিয়ে দিশা বলল, ‘না না। আপনি থাকতে পারেন। আমাদের মধ্যে তো কোনো গোপন কথা বলার মতো সম্পর্ক তৈরি হয়নি।’

মাথা নেড়ে কথাটাকে সমর্থন করে কমল বলল, ‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘আচ্ছা, আপনি আজ এখানে কেন এসেছেন তা নিশ্চয়ই জানেন।’ দিশা জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ জেনেই এসেছি।’

‘কেন? আপনি তো আমাকে ভালোভাবে চেনেন না। অফিসে চাকরি করতে এসে কিছুদিন আমাকে দেখছেন। এর ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়?’

কমল কথা বলার আগে শিবকুমার কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হাত তুলে তাকে থামাল দিশা, ‘প্লিজ, ওকে কথা বলতে দাও।’

‘আমি শুনলাম, কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী অবিবাহিত কর্মচারীদের ওরা যে কোনো জায়গায় বদলি করে দিতে পারে। আমি অবিবাহিত। যেখানে বদলি করা হবে তার খবর পাচ্ছি। সেখানে নিরাপত্তার বেশ অভাব আছে। এককথায় বিবাহিতদের বদলি করা হয় না। শিবকুমার বলল এ ব্যাপারটা আপনাকেও সমস্যায় ফেলেছে। তাই ও প্রস্তাব দিল, একটা উপায় আছে।’ কমল থেমে গেল।

‘বুঝলাম, কিন্তু বিয়ে মানে অন্য কিছু নয়, বিয়েই। এ বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আপনার মনে দুটো প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এক, স্বামী হিসেবে আপনি নিজের অধিকার আদায় করতে চাইতে পারেন। দুই, ডিভোর্স দিতে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে অসুবিধে নেই। সে রকম কি হতে পারে?’ সরাসরি জিজ্ঞাসা করল দিশা।

‘না না। ওসব আমি ভাবছি না।’

‘বিয়ের সার্টিফিকেটটা কাছে রেখে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করবেন না তো?’

মাথা নাড়ল কমল, ‘কখনই না। অফিস রক্ষার জন্য আমি শিবকুমারের কথায় রাজি হয়েছি। আমার পরিবার এ রকম বিয়ের কথা ভাবতেই পারে না।’

‘কিন্তু আপনি যদি কিউবায় না যেতে চান তাহলে চাকরি ছেড়ে দিতে পারেন। কেউ তো আপনাকে বাধ্য করতে পারে না।’

‘না পারি না। এ চাকরিটা আমি ছেড়ে দিতে পারি না।’

‘বুঝলাম। আমাকে আপনার জিজ্ঞাসা করার কিছু আছে?’

মাথা নেড়ে ‘না’ বলল কমল।

দুই পাশে ক্যাসিনোর সাজানো বাড়ি। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। ওরা তিনজন হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা আসার পরে শিবকুমার দাঁড়িয়ে গেল, ‘এই তো, এসে গেছি।’

কমল দেখল দরজা বন্ধ একটা বাড়ির ওপরে যে বোর্ড টাঙানো তাতে লেখা রয়েছে ‘কুইক ম্যারেজ অ্যান্ড আফটার’।

শিবকুমার এগিয়ে গিয়ে দরজার পাশের বেলের বোতাম টিপতেই একজন প্রৌঢ় দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়েস?’

শিবকুমার আঙুল তুলে ওপরের বোর্ড দেখালে প্রৌঢ় একগাল হেসে দরজাটা আরও একটু খুলে এক পাশে সরে গিয়ে বললেন, ‘আসুন আসুন।’

ওরা ভিতরে ঢুকে দেখল মাঝারি সাইজের ঘরের একটা পাশে নম্বর কাউন্টার, কাউন্টারের ওপাশে দুজন মহিলা কাজে ব্যস্ত। এপাশে কয়েকটা চেয়ার পড়ে আছে। প্রৌঢ় সবিনয়ে বললেন, ‘আপনারা অনুগ্রহ করে বসুন।’

মাঝখানে শিবকুমার, দুই পাশে দুজন বসার পর প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলুন, আমরা কী করতে পারি।’

শিবকুমার বলল, ‘আমার এ দুই বন্ধু বিয়ের জন্য এখানে এসেছেন।’

‘সুস্বাগত।’ হাসিমুখে প্রৌঢ় মাথা নাড়লেন। তারপর দুটো ফরম বের করে দুজনের সামনে রেখে বললেন, ‘দয়া করে এই ফরমে যা জানতে চাওয়া হয়েছে সেগুলো লিখে দিন। আপনারা কি আপনাদের ফটো সঙ্গে নিয়ে এসেছেন?’

‘আমার ব্যাগে ওই ছবি সব সময় থাকে।’ দিশা বলল।

প্রৌঢ় কমলের দিকে তাকালেন। কমল মাথা নাড়ল, সে আনেনি।

‘ঠিক আছে, তার জন্য চিন্তা করবেন না। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি আসুন আমার সঙ্গে প্লিজ।’ প্রৌঢ় হাঁটতে শুরু করলে কমল তাকে অনুসরণ করল।

ওপাশের দরজা ঠেলে প্রৌঢ় কমলকে নিয়ে যে ঘরে ঢুকল সেখানে নানান জিনিসপত্র ছড়িয়ে আছে। ঘরের এক পাশের দেয়ালে আটকানো ক্যামেরার সামনে নিয়ে গিয়ে ঠিকঠাক দাঁড়াতে বলে একটু ওপাশে গিয়ে আলো জ্বেলে বললেন, ‘ক্যামেরার দিকে হাসিমুখে তাকান। একটু পরই আপনার ছবি পেয়ে যাব।’

ফ্ল্যাশ হলো। ছবি উঠল।

প্রৌঢ় বললেন, ‘আর কোনো সমস্যা নেই। আপনি আপনার চেয়ারে ফিরে যেতে পারেন। এখন যে ফরম দিয়েছি সেটায় তথ্যগুলো দিয়ে দিন।’

পাশের ঘরে একাই ফিরে এলো কমল। তাকে দেখে শিবকুমার জিজ্ঞাসা করল, ‘ছবি তোলা হয়ে গেল?’

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর