শুক্রবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
গল্প

হলুদ রঙ

রশিদ হারুন

হলুদ রঙ

প্রায় তিন মাস হলো বাদল নতুন কেনা নিকেতনের এই ফ্ল্যাটে উঠেছে। নয়তলা বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় সে প্রায় ২২০০ স্কয়ার ফিটের এই ফ্ল্যাটে বউ রিতা আর দুই সন্তান নীলা আর নিলয়কে নিয়ে থাকে।

সারা জীবনের সঞ্চয়ের বিনিময়ে এই নতুন ফ্ল্যাট।

নতুন বিল্ডিংয়ের সবার সঙ্গে এখনো ভালোভাবে পরিচয় হয়ে উঠেনি বাদলের।

হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয় লিফটে কারও না কারও সঙ্গে। বাদল আন্দাজ করেছে সবাই বোধহয় ফ্ল্যাটের মালিক না, ভাড়াটিয়াও আছে কয়েকজন, অনেকের সঙ্গে এখনো কোনো কথাই হয়নি, শুধু শুভেচ্ছা হাসি বিনিময় হয়েছে। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে বিল্ডিংয়ের লিফটের সামনে দাঁড়াতেই পাশে এক ভদ্র মহিলাও এসে দাঁড়ালেন লিফটের অপেক্ষায়।

হঠাৎ করেই ভদ্র মহিলা বলে উঠলেন-

‘আচ্ছা আপনি কি কখনো উত্তর যাত্রাবাড়ীতে ছিলেন?’

বাদল খুবই আশ্চর্য হয়ে বললো,

‘জি, ছিলাম, সে তো প্রায়’ বলেই দেখলো হিসাব ভুলে গেছে, একটু হিসাব করা শুরু করলো মনে মনে,

সে একুশ বছর বলার আগেই ভদ্র মহিলা বলে উঠলেন-

‘একুশ বছর হবে।’

বাদল আশ্চর্য হয়ে মহিলার চেহারা এক ঝলক ভালোভাবে দেখে নিলো, কিন্তু কোনো মতোই কারো সঙ্গে মিলাতে পারলো না।

বাদল নিজের স্মৃতি ক্ষমতার ওপর কিছুটা হতাশ হয়েই বললো,

-‘কলেজে পড়তাম তখন, দুই বছর ছিলাম, ওয়াসা গলিতে ছিলাম, বাসার নাম্বারটা মনে নেই, কেন বলুন তো?’

ভদ্র মহিলা কিছুটা আশাহত হয়ে বললো-

‘ঠিক পাশের দোতলা বাড়িটা ছিলো আমাদের, আমাদেরটা ছিলো আশি আর আপনি ছিলেন ঊনাশিতে, সিজারদের বাসায়।’

বাদল এবার সোজাসুজি ভদ্র মহিলার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়, কোনোভাবেই উনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে না তার, তবুও হাসিমুখে বাদল বললো, ‘আমার স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল, ক্ষমা করবেন, আপনার দেখি সব মনে আছে, আসলে বাবার বদলি চাকরি ছিলো, সারা জীবন অনেক জায়গায় থাকতে হয়েছে, কলেজ শেষ করে আমরা সিলেটে চলে গিয়েছিলাম, আর আপনাদের তো নিজেদেরই বাড়ি?’

এইটুকু বলতেই লিফটা আবার নিচে নেমে এলো।

ভদ্র মহিলার লিফটে ওঠার কোনো লক্ষণই বাদল দেখলো না, অগত্যা তাকেও দাঁড়িয়ে পড়তে হলো।

ভদ্র মহিলা বললেন- ‘আমি থাকি ৭/এ তে, আপনি?’

‘আমি ৫/ডি তে থাকি’ বলেই বাদল লিফটের দিকে তাকালো। লিফট আবার ফিরে এসেছে।

‘আপনি প্রায়ই হলুদ শার্ট পরতেন, হলুদ আপনার প্রিয় রঙ, তাই না?’ বলেই মহিলা ওর দিকে তাকালো।

বাদল এতই আশ্চর্য হলো যে, আবারও লিফট এসে কখন যে চলে গেলো সে বলতেই পারবে না।

বাদলের মনে পড়ে গেলো সেই হলুদ শার্টের কথা, তার বাবাকে কে যেনো হলুদ কাপড়ের একটা থান দিয়েছিলো। বাদলের ধারণা কোনো কাজের ঘুষ হিসাবে এই কাপড় দিয়েছিলো কেউ তার কেরানি বাবাকে। বিনেপয়সার কাপড় পেয়ে তার বাবা একসাথে তিনটা হলুদ শার্ট বানিয়ে দিয়েছিলো বাদলকে। কলেজের দুই বছর তাকে এই হলুদ রঙের শার্ট পরেই কাটাতে হয়েছিলো। সে তখন প্রায়ই মা’র সাথে অনেক ঝগড়া করতো হলুদ শার্ট নিয়ে, বাবাকে কিছু বলার সাহসই ছিলো না তার কখনো।

বাদল বললো, ‘আপনার স্মৃতিশক্তি সত্যিই বলার মতো।’

ভদ্র মহিলা চেহারায় কিছুটা প্রসন্ন ভাব নিয়ে বললো-‘আমার একটাই ছেলে, কলেজে পড়ে, আর স্বামী ব্যবসায়ী, আমি গৃহিণী, আপনার?’

একথা বলেই বাদলের দিকে উত্তরের আশায় তাকালেন মহিলা-

‘আমার এক ছেলে, এক মেয়ে, বউ ডাক্তার,

আমিও ব্যবসা করি’ বলেই বাদল সাথে সাথে বললো

‘আজ আসি’।

ভদ্র মহিলা খুবই মনঃক্ষুণœ হয়ে বললো,

‘আমার নামটাও জানতে চাইলেন না? আমার নাম ‘রুমা’

বাদল খুবই অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

‘আমার নাম...’

উনি বাদলকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

‘থাক আর বলতে হবে না, আমি জানি আপনার নাম।’

বলেই রুমা লিফটের বদলে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলেন, বাদল খুবই অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে থাকলো শুধু।

বাদলের আর দেখা হয়নি কয়েক দিন রুমার সাথে, এক দিন আবার লিফটেই মধ্যেই দেখা দুজনের। রুমার সাথে কিশোর বয়সের একটি ছেলে, বাদল রুমার দিকে তাকিয়ে পরিচিত মানুষের মতো সৌজন্য হাসি দিলো।

রুমা বাদলের দিকে তাকালোই না, দেখে মনে হচ্ছে এই জীবনে বাদলের সাথে রুমার দেখা হয়নি।

কিশোরটির পরনে হলুদ রঙের একটি শার্ট। কিশোরটি কিছুটা বিরক্ত প্রকাশ করে নিচু স্বরে রুমাকে বললো,

‘মা’ হলুদ রং আমার একটুও পছন্দ না, তুমি সব সময় আমাকে জোর করে হলুদ রঙের কাপড় পরাও, আমি এখন বড় হয়েছি, কলেজে পড়ি, বন্ধুরা সবাই হাসাহাসি করে,

মা, আমার নিজের পছন্দ বলে তো কিছু আছে।’

বাদল কিশোরটির দিকে তাকিয়ে দেখলো হলুদ রঙের সার্ট পরাতে তাকে ভালোই মানিয়েছে।

লিফটে রুমা কিছুই বললেন না তার ছেলেকে। লিফট থেকে নামার সময় শুধু বাদলের দিকে নির্লিপ্তভাবে একবার তাকালো, ছেলেকে বললো,

এমনভাবে বলল যেনো বাদলও শুনতে পায়

-‘হলুদ রঙ আমারও পছন্দ না,

তুই বাসায় গিয়ে শার্টটা বদলিয়ে আয়,

হলুদ রঙে চোখে আজ কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছে, দেখলেই শরীর গুলিয়ে উঠছে, আর কোনো দিন আমার সামনে হলুদ রঙের কাপড় পরবি না, মনে হচ্ছে এখনি বমি করে দিবো।’

বাদল খুবই আশ্চর্য হয়ে রুমার দিকে তাকালো, বুঝতেই পারলো না রুমা হঠাৎ এসব কেন বলছে।

বাদল রুমাকে বললো, ‘আপনার শরীর কি খারাপ লাগছে?’

রুমা মুখে একটু ম্লান হাসি এনে বললো, ‘ইদানীং হলুদ রঙ দেখলেই শরীর গুলিয়ে উঠে, মনে হয় ডাক্তার দেখাতে হবে।’

বাদল আর কোনো কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসলো অফিসের জন্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর