তরুর চোখ ছলছল করে ওঠে। আমার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসে। শাড়ির আঁচল খানিক সরে যাওয়ায় ওর দুগ্ধধবল পিঠের অনেকটাই উন্মোচিত হয়ে পড়ে। আহ! যেনবা মেঘ সরে যাওয়া শরৎ আকাশ। ইচ্ছে হয়- আমি ওই আকাশের পাখি হই। ডানা মেলে উড়ি। ইচ্ছে হয়- নখরে চঞ্চুতে আঁচড়ে-আদরে রক্তাক্ত করি। আবার প্রগাঢ় চুম্বনে ওই রক্তক্ষত মুছিয়ে দিই। আমি উঠে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বলি,
কই বললে না, কী তোমার দশা?
তরু হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলে,
আমার হয়েছে মরণদশা। মরণদশা বোঝ?
না তো!
বোঝে না-মরণদশা?
কী আশ্চর্য! আমি জীবিত মানুষ। রক্তে-মাংসে গড়া প্রাণসমৃদ্ধ মানুষ। তোমার ওই মরণদশা আমি বুঝব কী করে!
এই যে তোমার গলায় লটকে পড়ে আমি নিজে মরেছি, আবার তোমাকে মেরেছি।
তুমি মরেছ সে আমি অনেক আগেই জেনেছি, কিন্তু আমাকেও মেরেছ?
নয় তো কী! ছোট বড় যা-ই হোক, চাকরি বলে কথা! আমারই জন্য তুমি সেই চাকরিতে যেতে পারছ না- একেই তো বলে মরণদশা!
তখন আমার খুব হাসতে ইচ্ছে করে। প্রাণ খুলে হেসে উঠি হো হো করে। হাসতে হাসতে পাগলের মতো তরুকে জাপটে ধরি। তরু ছটফট করে। আমি আরও আঁকড়ে ধরি। ওর কপালে প্রগাঢ় মমতার চুম্বন এঁকে দিয়ে বলি,
আমি তো সেই কবেই মরেছি। কলাভবনের করিডোর আলো করে তুমি হাঁটছ। কী আশ্চর্য! হাতে পায়ে কানে নাকে কোথাও কোনো গয়না নেই, কেবল কপালে সূর্যরাঙা টিপ। সামান্য এইটুকু অলংকার, এত আলো ছড়ায়? বাব্বা!
আমার তো দু’চোখে ধাঁধিয়ে অন্ধ হওয়ার জোগাড়।
অন্ধই তো হয়েছিলে, নইলে আমার সাধ্য কী তোমাকে বেঁধে রাখি! কী আছে আমার, বল!
বিশ্বাস কর তরু, তোমার কপালের ওই গোল টিপের মধ্যে আমি আমাকে দেখি, আমার একান্ত নিজস্ব পৃথিবী দেখি।
থামলে কেন, বল বল-আর কী দেখ!
ঠাট্টা করছ তরু?
কী মুশকিল। ঠাট্টা হবে কেন। আমার টিপ পরা নিয়ে তুমি তো কখনো ঠাট্টা করনি!
তবে যে...
তবে যে আবার কী?
সত্যি বলছি তরু, তোমার কপালের টিপ, আমার কাছে জগৎ দেখার আয়না।
আচ্ছা, খুব হয়েছে। কাব্যচর্চা তো ছেড়েই দিয়েছ শুনি, তাহলে এত উপমা টুপমা আসে কোত্থেকে?
আবার আমার হাসি পায়। কিন্তু সেই ইচ্ছেটুকু হজম করে ভাবি- বলে কী মেয়েটা! ‘তুমি যে আমার কবিতা...’ বলে কি এখন গান ধরতে হবে আমাকে! না, আমি গান ধরি না, বরং দুহাত বাড়িয়ে তরুকেই বুকের মধ্যে জাপটে ধরি এবং সারা বিছানায় গড়াগড়ি খাই। এপার থেকে ওপারে। ওপার থেকে এপারে। তরু কৃত্রিম ভয়ে চোখ গোল করে চেঁচিয়ে ওঠে- অ্যাই! এটা কী হচ্ছে!
আমি ওর বুকের খাদে মুখ ডুবিয়ে বলি,
গড়াগড়ি হচ্ছে। জড়াজড়ি হচ্ছে। তারপর ডুবসাঁতার!
উহ! যা অসভ্য না!
সভ্য মানুষেরা এটাকে কী বলে তরুমণি!
জানি না।
জানি না বলেই তরু আমার গলা জড়িয়ে ধরে। তৃপ্তিহীন ক্লান্তিহীন চুম্বনে আমার ঠোঁট ভরিয়ে দেয়। আমার ভেতরে জেগে ওঠে অন্য শরীর। সেই শরীরও চায় ক্ষুধার অন্ন, তৃষ্ণার জল এবং আনন্দ কোলাহল। তরু এই ক্ষুধাতৃষ্ণার কিছুই বোঝে না, তা নয়। খুবই বোঝে। কিন্তু সাধারণত আগ্রাসী নয়। শিল্পিত সুষমা নিয়ে প্রতীক্ষা করতে জানে। আমি এত দিনে বুঝেছি- তরু চায় আমি যেন ওকে জাগিয়ে তুলি, ওর প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের ঘুম ভাঙাই, জেগে ওঠে আড়ামোড়া ভাঙবে ওর শরীর, ক্ষুধা তৃষ্ণায় প্রচন্ড চনমনে হয়ে উঠবে; তারপরই যেন শঙ্খলাগা সাপ, হিস হিস শীৎকারে উত্তাপ ছড়াবে সারা ঘরময়। তখন সিলিং ফ্যানের পাখাগুলো ফুল স্পিডে ঘুরে ঘুরে হয়রান। কিন্তু অতি চেনা এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তরু এ দিন নিজেই অধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে, প্রগলভ হয়ে ওঠে, আমার কানের লতিতে কুটুশ করে কামড়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, ওই নামে আর ডাকো না কেন সোনামণি!
আমারও বেশ মনে পড়ে, কতদিন যেন ডাকা হয়নি ‘তরুমণি’ নামে। সোনামণি নামকরণের পরপরই সেই ছাত্রবেলাতেই ওর নাম হয়ে যায় তরুমণি। তরু বেশ মেনেও নেয়। নিজে থেকেই বিশ্লেষণ করে-বেশ হয়েছে। স্ত্রীর নামের সঙ্গে অনেকেই তো স্বামীর নামের লেজ লাগিয়ে চালিয়ে দেয়। আমারটা সেদিক থেকেও যথার্থ। কিন্তু তরুকে আমি ওই নামে ডেকেছি খুব কম সময়, কম সংখ্যায়। কেবল ওকে আদর করতে গেলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে ওই নাম ‘তরুমণি’।
তবে কি অনেক দিন থেকেই তরুকে আমি আদর করিনি?
নিজের মনেই প্রশ্ন ওঠে, আবার নিজে থেকেই উত্তর খুঁজি। আবারও প্রশ্ন জাগে আদর করা তবে কাকে বলে? শারীরিকভাবে মিলিত হওয়ারও অধিক কিছু? এই যে এতটা দিনে দুজনের শরীর তো ক্ষুধা-তৃষ্ণা নিয়ে উপোস দেয়নি। ষোলো আনার জায়গায় বারো আনা না হোক দশআনা কিংবা আটআনা ঠিকই আদায় করে নিয়েছে। কিন্তু আদর তখন ছিল কোথায়?
আমি যখনই কোথাও চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাই, বাসা থেকে বেরোনোর সময় তরুমণি কত যে নিষ্কাম পবিত্রতা নিয়ে আমার চোখে ছুঁয়ে দেয়, মুখ ছুঁয়ে দেয়, কপালটাকে কাছে নিয়ে চুমু এঁকে দেয় আর মুখে বলে দেখ, এবার ঠিকই হবে, ওর সেই ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক হতে চায় না কিছুতেই (সে হয়তো আমারই দোষে), তবু ইন্টারভিউ কার্ড হাতে এলেই আমার ভেতরে লোভ হয় তরুর হাতের ওই আদর পাওয়ার, অপেক্ষায় থাকি নির্দিষ্ট দিনের সকাল বেলাটির জন্য। এসবের তাহলে মানে কী?
তরুকে আমি কী বলে যে বোঝাই!
নিজেকেই যখন বোঝাতে পারি না তরুকে কী ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে যাব। নিজের দুর্বলতা ঢাকতেই আমি বলে উঠি,
‘তরুমণি’ কি খুব ভালো নাম হলো! ওর চেয়ে তরুলতাই তো ঢের ভালো!
তাই নাকি?
তরুলতা ভালো না-বল?
মানছি ভালো, কিন্তু তাতে কি তরুমণিকে পাওয়া যাবে?
তুমি সাড়া দিলেই হলো!
তুমি তো ডাকোইনি তার কি সাড়া দেব।
এই যে ডাকলাম।
মনে আছে- এক সন্ধ্যায় তুমি আমাকে সন্ধ্যামণি বলে ডেকেছিলে!
হ্যাঁ। সেই সন্ধ্যার আরও অনেক স্মৃতিই মনে আছে।
তরু আমার বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে,
অনেক স্মৃতি না ছাই। সে দিনের সন্ধেটাই মাটি।
কথাটা কি খাঁটি?
পুরো পরিপাটি।
আহ! মাটি হয়ে যাওয়া সেই সন্ধ্যা কি আর কখনো ফিরে আসবে!
তিন
সে দিন সন্ধ্যায় আমাদের দুজনের বেইলি রোডে নাটক দেখতে যাওয়া কথা। না, কথাটা সোজাসুজি এ রকম ছিল না। এ ঘটনার দুদিন কি তিন দিন আগে তরু অফিস থেকে ফিরে প্রস্তাব করে,
অ্যাই। নাটক দেখতে যাবে?
নাটকের কথায় বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। সিনেমা টিনেমা নয়, নাটক দেখার তৃষ্ণা আমার প্রবল। বিয়ের আগে আমরা দুজন বেশ কবার বেইলি রোডে গিয়ে মহিলা সমিতি মঞ্চে নাটক দেখেছি। বিয়ের পর আর হয়ে ওঠেনি। এত দিন পর তরুর মুখে নাটক দেখার প্রস্তাব শুনে আমার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। আমি এক লাফে তরুর মুখোমুখি এসে বলি,
দাঁড়াও, দাঁড়াও, তোমার মুখটা একটু ভালো করে দেখি।
তরু কাপড় বদলাতে বদলাতে কপট মুখ ঝামটা দেয়,
ঢঙ!
সাজতে রাজি সঙ! কিন্তু হঠাৎ নাটকের কথা এলো কোত্থেকে?
ঢঙ ও সঙ শব্দের অনুপ্রাস শুনে তরু খিলখিল করে হাসে। কাচের চুড়ির মতো ঝনঝন করে বাজে সেই হাসির শব্দ। উনুনের তপ্ত বালুতে খই ফোটার মতো খলবলানো সেই হাসি। হাসি থামলে তরু জিগ্যেস করে,
দেবুদাকে মনে আছে তোমার?
নাটকের মধ্যে দেবুদাকে ঢুকতে দেখে আমার মোটেই ভালো লাগে না। তবু তরু যখন তার প্রসঙ্গ তুলেছে, নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। কিন্তু আমি সহসা নিঃসংশয় হতে পারি না,
কোন দেবুদা?
আরে দেবাশীষ রায়। আমাদের ডিপার্টমেন্টের স্কলার। ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। মনে পড়েছে এবার?
হ্যাঁ হ্যাঁ, ডিপার্টমেন্টেই চাকরি হবে হবে করেও হলো না।
হবে কী করে! মালাউন যে!
[চলবে]