‘অনেকটা মায়ের ডাকেই বাড়িতে এসেছি। বিদেশের মাটিতে পড়ে থাকলেও দেশের জন্য মন কাঁদে। যে দেশটার জন্য যুদ্ধ করেছি, স্বাধীন করেছি, সেই দেশটার ধূলিমাখা পথ হাঁটতে ভালো লাগে। মা আর মাটির টানে বারবার বাংলাদেশে চলে আসতে মন চায়।’
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এ কথাগুলো বলেন আমেরিকায় বসবাসরত চালকবিহীন হেলিকপ্টারের উদ্ভাবক বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. হুমায়ুন কবীর। বাংলাদেশের এ বিজ্ঞানী মনে করেন জীবনে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে। জীবনে অসাধ্য বলে কিছু নেই। বিজ্ঞানী ড. হুমায়ুন কবীর গত ২২ মে স্ত্রী ফরিদা কবীরসহ বাংলাদেশে আসেন। ২৪ মে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিায় আসেন। দীর্ঘ দুই যুগ পর কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার চ-ীপাশা ইউনিয়নের বড় আজলদী গ্রামে নানার বাড়িতে ওঠেন তিনি। পৈতৃক বাড়ি কটিয়াদী উপজেলার নাগেরগ্রাম হলেও নানার বাড়িতেই কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর। পাকুন্দিয়ায় আসার পর স্বজন ও এলাকাবাসী তাঁকে স্বাগত জানান। আগামী ২১ জুন আমেরিকায় ফিরে যাবেন। এ সময়ের মাঝে দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখবেন বলে জানান তিনি। এর আগে ২০০৪ সালের ৫ মার্চ তিনি কিশোরগঞ্জে এসেছিলেন।
হুমায়ুন কবীরের জন্ম ১৯৫৫ সালে কটিয়াদী উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের নাগেরগ্রাম গ্রামে। তাঁর পিতার নাম হেদায়েত হোসেন। নাগেরগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। বনগ্রাম আনন্দ কিশোর উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি এবং ১৯৭৪ সালে এইচএসসি পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু গণিত শাস্ত্র ও গবেষণার প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল বেশি। ১৯৭৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স সম্পন্ন না করেই তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএস করার জন্য ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট আর্লিংটনে। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল মহাশূন্যযান ও রকেট বিজ্ঞান। বিশ্বের প্রথম রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টারের উদ্ভাবক তিনি। বিজ্ঞানী হুমায়ুন কবীর ১৯৮৬ সালে রিমোট নিয়ন্ত্রিত এইচ-৫ হায়েন্স হেলিকপ্টার উদ্ভাবন করেন। ফিলাডেলফিয়ায় অগাস্টা এরোস্পেস করপোরেশনে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিরক্ষা প্রকল্পে নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন তিনি। চালকবিহীন হেলিকপ্টার আবিষ্কারের পর তিনি আবিষ্কার করেন বড় আকারের হেলিকপ্টার ভি-২২ অফপ্রে (ঠরপঃড়ৎ-২২ ঙভঢ়ৎবু)। এটি ৪৬ জন যাত্রীর ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি বড় আকারের হেলিকপ্টার বলে জানান তিনি।
নিজের উদ্ভাবিত আবিষ্কৃত হেলিকপ্টারে কখনো চড়েছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পাইলটবিহীন হেলিকপ্টারটি পাঁচজন বসার মতো আসনযুক্ত হেলিকপ্টারের সমান। এটিতে সাধারণ মানুষ ওঠে না, মিলিটারিরা ব্যবহার করে। আর মানুষ উঠতে পারে এই ভার্সনটাতে আমি উঠেছি এবং নিজে চালিয়েছি।’ এর চেয়ে ছোট যেটাতে দুজন লোক বসতে পারে সেটার কমার্শিয়াল পাইলট তিনি নিজেই এবং এর লাইসেন্সপ্রাপ্ত তিনি। পাঁচজন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হেলিকপ্টারে প্র্যাকটিস করার জন্য চালালেও এটি চালনার জন্য তাঁর লাইসেন্স নেই বলে জানান। পাঁচজন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হেলিকপ্টারটিই পরে চালকবিহীন হেলিকপ্টার হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়। বিজ্ঞানী না হলে কী হতেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞানী না হলে আমার অন্য কিছু হওয়ার ইচ্ছা ছিল না। এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা আমার ছোটবেলা থেকেই। তা যদি হতে না পারতাম, তবে হয়তো জীবনে কিছুই হতাম না।’ বিজ্ঞানী হুমায়ুন কবীরের একমাত্র ছেলে নৌশাদ কবীর আমেরিকায় নৌবাহিনীতে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে কর্মরত বলে জানান তিনি।