শনিবার, ২৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও জয়নুল আবেদিন

হাশেম খান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও জয়নুল আবেদিন

১৯৭৩ সালের মে মাস। আমার শিক্ষক শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এক সন্ধ্যায় আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, বাংলাদেশের সংবিধান গ্রন্থটি ছেপে বের হচ্ছে। কীভাবে ছাপা হবে, ছবি নকশা কিছু হবে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হবে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগামীকাল সকাল ১১টায় গণভবনে দেখা করতে হচ্ছে। তুমিও আমার সঙ্গে যাবে। পরদিন যথারীতি শিল্পাচার্যের সঙ্গে গণভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে হাজির হলাম। সেখানে আগেই উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। তিনিই সংবিধান গ্রন্থটির শিল্পমান সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য শিল্পাচার্য ও বঙ্গবন্ধুর সেই সভার আয়োজন করেছিলেন। ঘরে ঢুকতেই সফেদ পাঞ্জাবি, পাজামা ও মুজিব কোট পরিহিত শেখ মুজিব উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আবেদিন ভাই, আসুন। তারপর করমর্দনের জন্য দুজনেই হাত বাড়িয়েু দিলেন। আবেদিন স্যার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধু মাঝখানে শিল্পাচার্যকে হাতের ইশরায় থামিয়ে দিয়ে বললেন- আবেদিন ভাই, আপনি বসুন, আমিই ওর পরিচয় দিচ্ছি। ও আমার ছয়দফার মনোগ্রাম, নকশা, পোস্টার করেছিল। ছয়দফা ঘোষণার জন্যে যে মঞ্চ তৈরি হয়েছিল তার ব্যাকসিনটা ও এত সুন্দরভাবে করেছিল আমার এখনো সব মনে আছে। ছয় রং, ছয়টি গঠন ও আকৃতি ইত্যাদি দিয়ে সেদিন ছয়দফার যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল আমি আগে ভাবতেই পরিনি আমার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা ও বাঙালিদের ন্যায্য অধিকারসহ নকশা, ছবি দিয়ে ছয়দফার এত চমৎকার ব্যাখ্যা হয়। সুতরাং আবেদিন ভাই, সংবিধান গ্রন্থে ছবি আঁকার জন্যে আপনি ঠিক লোককেই পছন্দ করেছেন।

আমি বিস্ময়ে অভিভূত। সেই কবে ১৯৬৬ সালের এক বিকালের বিশ মিনিটের এক সাক্ষাৎ হয়েছিল। আমার মতো এক সাধারণ তরুণের কথা ‘ছয়দফা’র মনোগ্রাম ও পোস্টারের। ব্যাখ্যা সব কিছু এতদিন পর তার মনে আছে। গত ছয় বছরে তার ওপর দিয়ে কত ঝড়, ঝঞা বয়ে গেছে। কতবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, আগরতলা মামলা, স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানের জেলে দুর্বিষহ জীবন, ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন, দেশকে গড়ে তোলার এক দুর্জয় স্বপ্ন নিয়ে এগুচ্ছেন। কিন্তু অতি ক্ষুদ্র স্মৃতিও তাঁর কাছে স্নান নয়। সেদিন অনেক কথাই আলোচনা হলো। তবে মূল আলোচনা ছিল সংবিধান গ্রন্থটির ছবি-নকশা ইত্যাদি সমন্বয়ে একটি সুদৃশ্য গ্রন্থ তৈরি করা। বঙ্গবন্ধু শিল্পাচার্যকে বললেন-আবেদিন ভাই, পাকিস্তানীরা সবই তো ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। সব সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। আমার কাছে জাতির অনেক চাওয়া এবং পাওয়া। আমি যে কী দিতে পারবো জানি না। অনেক পরিশ্রম করে আমরা একটা সংবিধান তৈরি করেছি-আট কোটি বাঙালির মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে সরকারের কিছু নিয়ম, আইন ও দলিল। আমি কিছু দিবার না পারলেও আমার পরে যারা আসবে অন্তত এই সংবিধান সামনে রেখে তারা জাতিকে নিশ্চয় কিছু দিবার পারবে। আবেদিন ভাই-সংবিধানের মতো রস-কষহীন একটা বিষয় কতটুকু শৈল্পিকভাবে ও সুন্দরভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরবো সেই পরামর্শ আপনি ছাড়া আর কে দেবার পারবে। আমি কাজ করবার পারি, খাবার পারি কিন্তু তা সুন্দরভাবে করা, কাজকে শৈল্পিক রূপ দেয়া আপনার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। এই সংবিধান গ্রন্থের রূপ কেমন হবে, ছবি, নকশা এসবের প্রয়োজন আছে কী নেই-সুন্দর প্রকাশনার দায়িত্বটুকু আপনার হাতে তুলে দিতে চাই।

শিল্পাচার্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুকে দেখছিলেন, তাঁর কথা শুনলেন এবং বললেন-আপনি যা চাইছেন, তা আমরা শিল্পীরা কতখানি পারবো জানি না, তবে আমরা আপনার সাথে আছি। যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন আপনি  দেখছেন-আজন্ম এই ইচ্ছাকেই তো আমি লালন করে চলেছি। আজ আপনার উৎসাহ ও স্বপ্ন আমাকে এবং শিল্পী সমাজকে অনুপ্রাণিত করছে। এরপর প্রায় চারমাসের অনলস কর্মের ফলে শিল্পাচার্যের নেতৃত্বে ড. কামাল হোসেন ও আমরা পাঁচজন শিল্পীর একটি দল দিনরাত পরিকল্পনা, চিন্তা এবং তারপর পরিকল্পনা অনুযায়ী সংবিধানের প্রতিটি পাতার জন্য নকশা তৈরি করি। যার মধ্যে বাংলাদেশের লোকশিল্প ও লোকাচারের রং রেখার ব্যবহার করে, বাংলার রূপ-বৈচিত্রের এক আবহ সৃষ্টির প্রয়াস করা হয়েছে। সংবিধান গ্রন্থের অন্যান্য শিল্পীরা হলেন জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবুল বারক আলভী ও ক্যালিগ্রাফির জন্য আবদুর রউফ। সংবিধান গ্রন্থটি যেটি বাংলা ভাষায়, সেটিতে মুদ্রণ যন্ত্রের টাইপ ব্যবহার না করে প্রতিটি পৃষ্ঠা হাতে লেখা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা হাতের লেখা ব্যবহার করে পুরো গ্রন্থটি মুদ্রিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষার গ্রন্থটিতে টাইপ ব্যবহার করা হয়েছে। এমন একটি মূল্যবান দলিল-গ্রন্থ ইচ্ছে করলে দেশের বাইরে যে কোনো উন্নত দেশ থেকে সুন্দর পরিপাটি মুদ্রণ ও প্রকাশনার ব্যবস্থা করা যেত। অনেকেই সেই পরামর্শও দিয়েছিলেন। কিন্তু শিল্পাচার্য, বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেন একটি বিষয়ে একমত ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তা হলো- আমাদের যা সম্পদ আছে, যে প্রযুক্তি আছে, যে কর্মী আছে, শিল্পী আছে তা দিয়েই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। যে নিষ্ঠা ও চেতনা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি- দেশ গড়ার কাজেও মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাকে কাজে লাগাতে হবে। নিতান্তই প্রয়োজন না হলে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই সংবিধান গ্রন্থের জন্যে শুধু কিছু উন্নতমানের কাগজ বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। সরকারি মুদ্রণালয়ের অতি পুরনো একটি মুদ্রণযন্ত্রকে সামান্য মেরামত করে গ্রন্থটি মুদ্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দেশ তখন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত হলেও ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি উন্নতমানের মুদ্রণালয় থাকা সত্ত্বেও একটি আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার স্বার্থে ও সরকারি মুদ্রণালয় এবং সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ববোধকে সচেতন করার প্রয়োজনে এমন একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। সত্যি সত্যি সরকারি মুদ্রণালয়ের কর্মচারী ও কর্মকর্তারা সবাই অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটি সমাধা করেছিলেন। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করায় সরকারের প্রতি তাদের সন্তোষ প্রকাশ পায়। সংবিধান গ্রন্থটির মুদ্রণ শেষ হলে সরকারি মুদ্রণালয়ে এক সমাবেশে কর্মচারী ও কর্মকর্তারা তাদের প্রতি সরকারের আস্থা ও দায়িত্ব অর্পণের কারণে বঙ্গবন্ধু, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনকে তাদের আনন্দ, কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। সোনার বাংলা গড়ার কাজে বঙ্গবন্ধুর হাতকে বলিষ্ঠ করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ইচ্ছাকেও প্রকাশ করে। শিল্পাচার্য ও ড. কামাল হোসেন শিল্পকর্মে শোভিত ও পরিপাটিভাবে মুদ্রিত সংবিধান গ্রন্থটি নিয়ে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিলেন। সঙ্গে আমার পাঁচজন শিল্পী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু একটি একটি পাতা তুলে সংবিধানের পৃষ্ঠাগুলো অবাক হয়ে দেখছেন। কিছুক্ষণ দেখার পর মুগ্ধ ও অভিভূত দৃষ্টিতে আমাদের সবার দিকে তাকালেন। বললেন- আবেদিন ভাই, এত সুন্দর কী করে করলেন! আমি যে ভাবতেই পারছি না! কিছুই তো ছিল না, ভাঙা প্রেস, ভালো কালি নেই তারপরও আপনি অসাধ্য সাধন করলেন। আপনারা শিল্পীরা কত সুন্দর ও পরিপাটি করে বাংলার মানুষের জন্য সংবিধান গ্রন্থ তৈরি করলেন। কিন্তু আমি কী করি? আমি কি পারব আমার বাংলাদেশকে এত সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে? এই যেমন আপনারা পারলেন এই সংবিধান তৈরি করতে! বঙ্গবন্ধু, এই কাজটা তো আপনিই করলেন। আপনার পরিকল্পনা ও চিন্তাকে আমরা একটা রূপ দিলাম। আমরা আপনার মানুষ। হাতিয়ার বলুন, আর কর্মীই বলুন। বাংলার মানুষের দেশ গড়ার সংবিধান-শৈল্পিক রূপ লাভ করুক, সুন্দর একটি চেহারা অর্জন করুক-আপনার স্বপ্ন ও অভিলাষকেই আমরা শিল্পীরা রূপ দিয়েছি। আমাদের শিল্পীদের মতো বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ ও কর্মী আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। যাকে যে কাজে প্রয়োজন আপনি আহ্বান জানালেই তারা ঝাপিয়ে পড়বে। আপনার আহ্বানেই যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পাক সেনাদের মতো অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধবিদ্যা বাংলার মানুষের ছিল না। তবুও তারা যুদ্ধ করেছে। ৩০ লক্ষ মানুষ রক্ত দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন সংবিধান গ্রন্থটি। তারপর বললেন- আবেদিন ভাই, আপনি তো আমার কাজটা করে দিলেন। এখন আমি আপনাদের জন্যে কি করতে পারি বলুন। আমি এবার একটা কাজে হাত দিতে চাই। আপনার সহযোগিতা প্রয়োজন। শিল্পাচার্য বঙ্গবন্ধুকে বলতে লাগলেন- ঢাকার পাশে যে ঐতিহাসিক শহর সোনারগাঁ, সেই সোনারগাঁকে আমি নতুন রূপে গড়ে তুলতে চাই। এই অঞ্চলেই তৈরি হতো সারা বিশ্বে খ্যাত শিল্পকর্ম ‘মসলিন’ যা আজ হারিয়ে গেছে। এমনিভাবে বাংলার অনেক ঐতিহ্য ও লোকশিল্প আজ লুপ্তপ্রায় এবং যে কটি বেঁচে আছে তা কোনো কদর পাচ্ছে না। বাংলার লোক-ঐতিহ্য ও শিল্পকলাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং পুনর্জীবিত করার জন্যে এখনি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সোনারগাঁয়ে একটি লোকশিল্প জাদুঘর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের লোকশিল্পীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের শিল্পকর্মে উৎসাহ প্রদান ও উজ্জীবিত করার প্রয়াসে আমি একটি বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়েছি। আর তা বাস্তবায়নে আপনার সাহায্য ও উৎসাহ প্রয়োজন। সোনারগাঁকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলে আপনার সোনার বাংলা গড়ার কাজ অনেকখানি এগোবে বলে আমি বিশ্বাস করি। বঙ্গবন্ধু একটু অবাক হয়ে শিল্পাচার্যের দিকে তাকালেন। একটু সময় নিলেন। সংবিধানের পাতা উল্টাতে উল্টাতে আনন্দ ও বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, আবেদিন ভাই, আপনি আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী এখুনি কাজে নেমে যান। আমি এবং বাংলাদেশ সরকার আপনাকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা দেয়ার জন্য প্রস্তুত। শুধু আমার ছোট্টো একটা অনুরোধ, সোনার গাঁয়ে মাঝে মাঝে আমি আপনার কাছে গিয়ে থাকবো। আমার জন্য আপনার পাশে একটু জায়গা রাখবেন। সুন্দর কিছু সৃষ্টি করার শক্তি ও প্রেরণা আপনার কাছ থেকে যাতে পেতে পারি ও শিখতে পারি সেই ব্যবস্থা আমাকে করে দেবেন।

সংবিধান এবং সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন-দুটি মানুষের কথোপকথন। আমি সেদিন বিমোহিত। মহামানব দেখতে কেমন হয় এমন কোনো ধারণা আমার নেই। কিন্তু সেদিন এই দুজনকে আমার মনে হয়েছে দুই মহামানবের সম্মুখে আমরা। বিশাল বক্ষ দুজনের। যে বক্ষ ধারণ করে আছে বাংলার আপামর মানুষকে। সোনারগাঁ ও সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে। দুজনের মধ্যেই এক অদ্ভুত মিল। এই দুই মহামানব হারিয়েও গেছেন আমাদের মাঝে থেকে প্রায় একইভাবে। দুজনকেই ছিনিয়ে নিয়ে গেছে মানবজাতির শত্রুরা-দুর্বৃত্ত ও দুর্জনরা। শিল্পাচার্যকে অকস্মাৎ ছিনিয়ে নিল দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগ আর বঙ্গবন্ধুকেও অকস্মাৎ হত্যা করল। যারা বাংলার শত্রু, মানবজাতির শত্রু।

 

লেখক : চিত্রশিল্পী; সাবেক অধ্যাপক, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর