শনিবার, ২৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

‘তুই অধিনায়ক তোর দায়িত্ব অনেক’

কাজী সালাউদ্দিন

‘তুই অধিনায়ক তোর দায়িত্ব অনেক’

ছোটবেলা থেকেই শেখ কামালের সঙ্গে বন্ধুত্ব। দুজন একসঙ্গে শাহীন স্কুলে পড়েছি। তাই বঙ্গবন্ধুর বাসায় আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এত বড় নেতা অথচ বঙ্গবন্ধুর চাল-চলন ছিল সাধারণ মানুষের মতো। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও খেলাধুলার খবর রাখতেন। নিজে ফুটবলার ছিলেন বলেই ফুটবলের প্রতি আলাদা একটা টান ছিল। আমার এখনো মনে পড়ে ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। ফুটবল কীভাবে মাঠে গড়াবে এ নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না। বঙ্গবন্ধু বললেন, অবশ্যই খেলাধুলা হবে। গড়ে ফেললেন ফুটবল, ক্রিকেট, হকি ও কাবাডি ফেডারেশন। সে বছরই ফুটবলে স্বাধীনতা কাপ শুরু হলো। তখনো আমি ঢাকা মোহামেডানে খেলি। সেমিতে বিজেআইসির বিপক্ষে হ্যাটট্রিক আর ফাইনালে ইস্টএন্ডের বিপক্ষে ২ গোল দিই। ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় বঙ্গবন্ধু মোহামেডানকে অভিনন্দন জানান। আর সেই বছরই আমার গোলে ঢাকা একাদশ এক প্রদর্শনী ম্যাচে কলকাতার বিখ্যাত মোহনবাগান ক্লাবকে হারায়। বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন, তোর গোল আমার মনে থাকবে। টিভিতে খেলা দেখলাম। সত্যিই তোরা ভালো খেলেছিস।

১৯৭৪ সালে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে আবাহনী আইএফএ শিল্ডে খেলতে যায়। কোয়ার্টার ফাইনালে জেতার পর শেখ কামাল রুমে এসে বললেন, বাবা ফোন করেছিলেন আমরা যদি চ্যাম্পিয়ন হই বিশেষ প্লেন পাঠিয়ে দেবে। বাবা নিজেই এয়ারপোর্টে আমাদের রিসিভ করবেন। একজন রাষ্ট্রনায়ক খেলাধুলাকে কতটা ভালোবাসেন এ ঘোষণায় আমরা প্রমাণ পেলাম। যদিও আমরা সেমিতে হেরে যাই। ১৯৭৫ সালে মারদেকা কাপে খেলতে যাওয়ার আগে আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি। অধিনায়ক ছিলাম বলে আমাকে ডেকে বললেন, তুই ক্যাপ্টেন দায়িত্ব অনেক। দেখবি কেউ যেন ডিসিপ্লিন না ভাঙে। কষ্ট লাগে সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দেখা।

দেখেন একটা কথা আগেও বলেছি। এখন বলছি, বাংলাদেশের ফুটবলে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা থাকলেও সেভাবে এগোতে পারিনি। কিন্তু শেখ কামাল বেঁচে থাকলে দেশের ফুটবলের চেহারা পাল্টে যেত। সারাক্ষণই তাঁর মাথায় চিন্তা ছিল ফুটবলের উন্নতি কীভাবে করা যায়। আমরা তখন ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য প্লেনে বসে আছি। তখন কামাল প্লেনের ভিতরে এসে সবাইকে বিদায় জানাল। আমাকে বলল, তোরা ফিরে আয়। ফুটবল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। পিন্টু ভাই, টিপু ভাই, প্রতাপদা সিনিয়র ফুটবলারদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সবাই আমার সঙ্গে একমত হয়েছে ফুটবলের জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে হবে।

কামাল তখন বেঁচেছিলেন, কেউ কেউ সমালোচনা করে বলতেন আবাহনীতে যারা খেলে তাদেরই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। অথচ কামাল কখনো শুধু আবাহনীর নিয়ে ভাবেনি।

একদিন বাফুফের সভাপতিকে বললেন, আপনারা ফুটবলের সব। তবে উন্নয়নে অনেকের সহযোগিতা লাগবে। আমি শুধু আপনাদের সহযোগিতা করছি। পিন্টু ভাইরা দেশের অভিজ্ঞ ফুটবলার। ফুটবল উন্নয়নে কী কী করা দরকার তাদের কাছ থেকে পরামর্শ নেব। লিখিত আকারে তা ফুটবল ফেডারেশনের কাছে জমা দেব। যদি শুধু আবাহনীকেই গুরুত্ব দেওয়া হতো তাহলে তিনি পিন্টু ভাই ও প্রতাপদাকে এতটা গুরুত্ব দিতেন? অনেকেই কামালের বিপক্ষে কথা বলেছেন। মৃত্যুর পর ঠিকই বলতে বাধ্য হয়েছেন কী রত্নকে আমরা হারালাম। ১৯৭৫ সালে লিগের প্রথম পর্বে আবাহনী ০-৪ গোলে মোহামেডানের কাছে হেরে গিয়েছিল। ম্যাচের পর ক্লাবে গিয়ে কামাল বললেন জানি আপনারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এতে কষ্ট পাওয়ার কী আছে। মোহামেডান ভালো খেলেছে, জিতে গেছে। আমরাও ভালো খেলে ওদের হারাব।

কামাল বলতেন, হুট করে ওপরে ওঠা যায় না। পরিশ্রম ও মেধা কাজে লাগাতে হবে। দেখবেন আমি হয়তো সেদিন বেঁচে থাকব না। আবাহনী একদিন দেশের সেরায় পরিণত হবে। এ নির্মম সত্যটা ঠিকই বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

 

লেখক : লেখক : ক্রীড়াবিদ।

সর্বশেষ খবর