বৃহস্পতিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

জুয়েলারি শিল্পের বাজার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয়

ড. মাহফুজ কবীর, গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ

জুয়েলারি শিল্পের বাজার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয়

বাংলাদেশে জুয়েলারি ব্যবসার প্রসার ঘটছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নতমানের স্বর্ণালংকারের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে অনেক। এ দেশের স্বর্ণশিল্পের ইতিহাস হাজার বছরের। বহু মানুষের ব্যবসায়, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান জড়িয়ে আছে এ শিল্পের সঙ্গে। পুরুষানুক্রমে স্বর্ণালংকার উৎপাদনের পাশাপাশি এ শিল্পে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে প্রচুর। এ দেশে নিখুঁত ও মানসম্পন্ন স্বর্ণালংকার তৈরি হয়। এ দেশের স্বর্ণালংকার অপেক্ষাকৃত কম ওজনের, যার ফলে অল্প পরিমাণ স্বর্ণ দিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের জন্য ব্যয়সাশ্রয়ী স্বর্ণালংকার তৈরি করা যায়। ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার, উপহার ও পারিবারিক বিনিয়োগ হিসেবে স্বর্ণালংকার একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। বাংলাদেশে ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালের আইন অনুযায়ী স্বর্ণ ব্যবসা চলছিল। দেশে জুয়েলারি শিল্পের বিকাশ, স্বর্ণালংকার রপ্তানি, অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান তৈরি এবং এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্বর্ণ নীতিমালা ২০১৮ সালে প্রণয়ন করা হয় এবং একে ২০২১ সালে সংশোধন করা হয়। কিন্তু এ নীতিমালা বাস্তবায়ন শুরু হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় বিশ্বব্যাপী কভিড মহামারি। বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম হুহু করে বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় অনেক পরিবার তাদের স্বর্ণালংকার জুয়েলারি দোকানে বিক্রি করে দেয়। অন্যদিকে বাজারে চাহিদা হ্রাস ও বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ার কারণে মালিকরা ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে নিরুৎসাহ হয়ে পড়েন। এ বছর গোড়ার দিকে অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেকটা চাপের মধ্যে ফেলে দেয়। মন্দা আসতে শুরু করে। স্বর্ণের বিশ্ববাজার টালমাটাল হয়ে ওঠে, যে পরিস্থিতি এখনো চলছে। বাংলাদেশে বার্ষিক স্বর্ণালংকার ও স্বর্ণপিণ্ড বিক্রির নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া কঠিন। একটি হিসাবমতে, ২০২০ সালে স্বর্ণালংকার, স্বর্ণপিণ্ড ও রৌপ্য বিক্রি ছিল ২৮৫ দশমিক ৪ কোটি মার্কিন ডলারের। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির গড় হার অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ স্বর্ণের এসব মূল্যবান ধাতুর মোট বিক্রি হবে ২,১০৯ দশমিক ৬ কোটি মার্কিন ডলার। স্বর্ণপিণ্ড ২০২০ সালে বিক্রি ছিল ৪২ দশমিক ৮২ কোটি মার্কিন ডলারের এবং ২০৩০-এর মধ্যে এটি ৩৮৭ দশমিক ২৫ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে মনে করা হচ্ছে। আরেকটি হিসাবমতে, এ দেশে প্রতি বছর স্বর্ণের চাহিদা ১৫ থেকে ২০ টন। বার্ষিক স্বর্ণের বাজার ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। স্বর্ণ নীতিমালা (সংশোধিত) ২০২১ অনুযায়ী বছরে স্বর্ণের চাহিদা ২০ থেকে ৪০ টন।

বর্তমানে বিদেশ থেকে আসা স্বর্ণের বার দিয়ে স্বর্ণালংকার প্রস্তুত করা হয়। এ বিশাল আকারের বাজারের চাহিদা পূরণ করার জন্য যে পরিমাণ স্বর্ণ আমদানি হয় তার বিকল্প হিসেবে স্বর্ণ শোধনাগার দেশি বাজারের চাহিদা পূরণ এবং কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বর্তমানে বড় আকারের বিনিয়োগের মাধ্যমে বসুন্ধরা গ্রুপ বাংলাদেশে প্রথম স্বর্ণ শোধনাগার প্লান্ট স্থাপন করছে। স্বর্ণ পরিশোধনাগার চালু হলে দেশের বিপুল পরিমাণ স্বর্ণের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে। স্বর্ণালংকারের পাশাপাশি আগামী দিনগুলোয় স্বর্ণ রপ্তানিতে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। চীন, ভারত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপে স্বর্ণপিণ্ড ও স্বর্ণালংকার রপ্তানিতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ খোদাই করা স্বর্ণের বার দেশের ব্র্যান্ডিংয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এ উদ্যোগ দেশের স্বর্ণ ও জুয়েলারি শিল্পে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে নিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ রিফাইনারি পুরো দেশে স্বর্ণ ও জুয়েলারি শিল্পের খোলনলচে বদলে দেবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দেশি-বিদেশি অনেক উদ্যোক্তাই বিদেশে রপ্তানির জন্য স্বর্ণালংকার প্রস্তুতের কারখানা গড়ে তুলবেন, যা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশে এখন বিশ্বমানের স্বর্ণালংকার তৈরি হচ্ছে। বাঙালি হাতে স্বর্ণালংকার তৈরিতে বিশেষভাবে পারদর্শী এবং এতে তাদের বিশ্বব্যাপী সুনাম রয়েছে। তবে তাদের প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও রাজস্ব নীতির মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে উৎসাহ প্রদান। এতে বাংলাদেশ বিশ্বমানের স্বর্ণালংকার রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। তরুণ উদ্যোক্তা এবং শিক্ষিত ও দক্ষ কারিগর এ শিল্পের চেহারা পাল্টে দিতে পারে। স্বর্ণালংকারে দরকার নতুন ও আকর্ষণীয় ডিজাইন, কম ওজন এবং প্রতিযোগিতামূলক দামে ভালো মানের স্বর্ণ দিয়ে তৈরি অলংকার। মূল্যবান ধাতু দিয়ে তৈরি জুয়েলারি পণ্য যাতে ইমিটেশন গহনার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ভালোভাবে এগিয়ে যেতে পারে, সেজন্যই এ খাতে তারুণ্যের মেধা, উদ্যোগ ও নেতৃত্ব প্রয়োজন। যত বেশি শিক্ষিত তরুণ আসবে ততই এ খাত এগিয়ে যাবে। নতুন নতুন ডিজাইনের এবং বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী সবরকমের ক্রেতার জন্য জুয়েলারি পণ্য তৈরি ও বিপণন বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়নধর্মী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। নিম্নমানের অলংকার জুয়েলারি পণ্য যারা বিক্রি করছেন তাদের ওপর প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি বাড়াতে হবে। তাদের জিরো টলারেন্স নীতির মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

সর্বশেষ খবর