ভোরের আলো ফুটতেই বেজে উঠছে লঞ্চের ভেপু। সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাচ্ছে একের পর এক লঞ্চ। এর মাঝে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে পানি থেকে প্লাস্টিকের বোতল কুড়াচ্ছেন শুক্কুর আলী। নদী পরিষ্কার কিংবা পরিবেশ দূষণ রোধ নয় পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্লাস্টিক কুড়ানোকে। ছোট নৌকা ভর্তি হয়ে গেলে তীরে এসে বস্তায় বোতল ভরছিলেন তিনি। বোতল দিয়ে কি করবেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, এক কেজি দেড় টাকা হিসেবে মহাজনের কাছে বিক্রি করি। সেখান থেকে অনেক কোম্পানি এসব বোতল কিনে নিয়ে গিয়ে আবার পানি ভরে বিক্রি করে।
নগরীতে এরকম বাহারি নতুন ও মৌসুমি পেশাজীবীদের আনাগোনা রয়েছে। মানুষের দৈনন্দিন ছোট্ট চাহিদা পূরণ করে জীবন নির্বাহ করছেন তারা। বাহারি এসব ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা নতুনত্ব নিয়ে নামছেন পেশায়। ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং ব্যবসায় বেশ সফল তারা।
মোহাম্মদপুর এলাকায় ছাই বিক্রি করেন মিজান আলী। তিনি বলেন, টাঙ্গাইল থেকে মাসে একবার চুলার ছাই নিয়ে আসি। প্রতি সপ্তাহে একবার করে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। এই আয়ে আমার তিনজনের সংসার চালাই।
শাহবাগে কাঁচাকলা-বরই ভর্তা বিক্রি করেন সেলিম মোল্লা। তিনি বলেন, আগে বরই, পেয়ারা কাসুন্দি দিয়ে মাখিয়ে বিক্রি করতাম। একসময় ক্রেতারা এসে কাঁচাকলা ভর্তা আছে কি না জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। খোঁজ নিয়ে জানলাম টিএসসিতে কেউ একজন কাঁচাকলা-বরই ভর্তা বিক্রি করে। এরপর থেকে আমিও বিক্রি শুরু করলাম। এই ভর্তার চলে হালে বেশ জনপ্রিয় স্ট্রবেরি ভর্তা। ধানমন্ডি লেক পাড়ে স্ট্রবেরি ভর্তা বিক্রি করেন শফিক আলী। বিকাল হতেই ভিড় জমে তার দোকান ঘিরে। বিভিন্ন বয়সের মানুষ কিনে খাচ্ছে এই ভর্তা। শফিক বলেন, নতুনত্ব না আনলে মানুষ কিনবে কেন? ঝালমুড়ি তো সবাই বিক্রি করে এ জন্য আমি নতুন কিছু করার কথা চিন্তা করছিলাম। বিভিন্ন ধরনের ভর্তা বানাতাম। একবার স্ট্রবেরি ভর্তা বানিয়ে দেখলাম খেতে বেশ স্বাদ লাগছে। এরপর পরীক্ষামূলক লেক পাড়ে বিক্রি শুরু করি। এখন বেশ ভালোই চলছে।
পণ্য কিংবা খাবারে স্বকীয়তা এনে ব্যবসায় লাভবান হচ্ছেন অনেকে। সূর্য ডুবলেই হাতিরঝিল-বাড্ডা লিংক রোড মৌ মৌ করে ভুট্টা-লেবুর সুগন্ধে। ছাদেক হোসেন কয়লার চুলায় ভুট্টা পুড়িয়ে বিক্রি করেন এখানে। ভুট্টা পুড়িয়ে তার ওপর বাতাবি লেবুর রস দিয়ে বিক্রি করেন তিনি। তেজগাঁও এলাকায় পিঠা বিক্রি করেন রওশন আরা। সারা বছরই দোকান নিয়ে বসেন তিনি। তবে শীতের সময় পিঠায় থাকে বৈচিত্র্য। ভাপা, চিতই, তেল পোয়া এর সঙ্গে পাটিসাপ্টা, দুধপুলিও বিক্রি করেন তিনি। রওশন আরা বলেন, আমার এখানে সাধারণত ট্রাক-বাসের ড্রাইভার, হেলপার, মেরামত শ্রুমিকরা বেশি আসেন। অনেক ছাত্রও পিঠা খেতে আসে। অনেকেই পিঠা বিক্রি করেন কিন্তু আমি চেষ্টা করি বিভিন্ন ধরনের পিঠা বিক্রি করার। একই পিঠা প্রতিদিন কেন মানুষ খেতে আসবে?
ফার্মগেটে ৬২ রকমের চা বিক্রি করেন মাকসুদ আলম। চায়ের তালিকায় তেঁতুল, পুদিনা, মরিচ, মাল্টা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিস্কুট দিয়ে মেশানো চা বিক্রি করেন। মাকসুদের স্পেশাল হচ্ছে ‘মাথা ঠান্ডা’ চা। গরম চা খেলে গলার মধ্য দিয়ে একটা আলতো ঠান্ডাভাব জাগে। চায়ের উপাদান জিজ্ঞেস করলে বলেন, ‘পুদিনা পাতার সঙ্গে একটি মসলা দিয়ে আমি এই চা বানাই। এটা আমার গোপন রেসিপি।’ চায়ের দোকান এখন রাজধানীতে জনপ্রিয় ব্যবসাগুলোর মধ্যে একটি। শিক্ষার্থী থেকে অবসরে যাওয়া ব্যক্তিও ছোট্ট দোকান ভাড়া নিয়ে খুলে বসছেন চা, কফির পসরা। স্টল সাজানোতেও থাকছে বৈচিত্র্য। ছোলমাইদে এক কফি শপে দেখা যায় চা কফি খেতে খেতে পড়া যাবে বিভিন্ন ধরনের বই। অর্ডার দিয়ে ক্রেতা কিছু সময় মুখ গুঁজতে পারবেন হঠাৎ পাওয়া কোনো বই কিংবা ম্যাগাজিনে। অনন্যতায় জমজমাট ব্যবসা এই ধারণাকে মুখ্য করে মাঠে নেমেছেন এই পেশাজীবীরা।