ইভিএমে ভোট যেসব দেশে
ইভিএম বা ইলেকট্রনিক্স ভোটিং মেশিন ব্যবহার করে ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে পারেন। ইভিএম ব্যবহারে বড় দুটি সুবিধার মধ্যে রয়েছে ভোট জালিয়াতি রোধ করা ও অল্প সময়ে ভোট প্রদান, গণনা সম্ভব হয়। ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম প্রথম চালু হয় ইভিএম। তবে বড় পরিসরে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৪ সালে তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৭টি রাজ্যে ইভিএম ব্যবহার করে। এরপর বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে বড় কিংবা ছোট পরিসরে ইভিএমের ব্যবহার বাড়তে থাকে। বর্তমানে আইনগতভাবে ইভিএম প্রযুক্তির মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা দেশের তালিকায় রয়েছে রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান, ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভেনেজুয়েলায়, কাজাখস্তান, পেরু, ফিলিপাইন, রোমানিয়া, এস্তোনিয়া ও আয়ারল্যান্ড।
একনজরে ইভিএম
* একটি মেশিনে প্রায় চার হাজার পর্যন্ত ভোট দেওয়া যায়।
* ধারণ ক্ষমতা অনুসারে সর্বোচ্চ ৩৮৪ জন, সর্বনিম্ন ১২ জন প্রার্থীর তালিকা থাকে। তবে ১২ জনের কম প্রার্থী থাকলে ফাঁকা প্রতীকের সুইচগুলো অকার্যকর থাকে।
* একটি ভোট দিতে সময় লাগে মাত্র ১৪ সেকেন্ড।
* একটি মেশিন চালাতে প্রয়োজন হয় ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারি।
* বাটন চাপ দিয়ে অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যক্তিও ভোট দিতে পারেন।
নিউইয়র্কে সর্বোচ্চ ভোট না পেলে দ্বিতীয় দফায় রানঅফ
নিউইয়র্কে পদমর্যাদা ভিত্তিক ভোটিংয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়ে থাকেন। নিউইয়র্কের মেয়র আসলে এই শহরের সিও বা চিফ এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করেন। নিউইয়র্ক সিটি ছাড়াও ম্যানহাটন, ব্রনক্স, ব্রুকলিন, কুইনস ও স্ট্যাটান আইল্যান্ডের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। নিউইয়র্ক নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট প্রাপ্ত প্রার্থীই বিজয়ী হন। এমনকি নির্বাচনে অনেক প্রার্থী যেখানে অংশগ্রহণ করেন সেখানে বিজয়ী প্রার্থী মোট ভোটের সামান্য একটি অংশও পেতে পারেন। হিসাব দেখে মনে হতে পারে এত কম ভোট পেয়ে কীভাবে তিনি নির্বাচিত হলেন? আসলে মেজরিটি ভোট এখানে গণনায় আনা হয়েছে। এর অর্থ হলো বেশিরভাগ ভোটারই বিজয়ী প্রার্থী ছাড়াও অন্য কাওকে ভোট দিয়েছেন তবে তারা মেজরিটি ভোট পাননি। মেয়র, পাবলিক অ্যাডভোকেট বা কম্পট্রোলারের জন্য প্রাথমিক নির্বাচনে যদি কোনো প্রার্থী ভোটের কমপক্ষে ৪০ শতাংশ ভোট না পেয়ে থাকেন তাহলে রানঅফ নামক একটি অতিরিক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সেরা দুজন প্রার্থীর মধ্যে ভোটের লড়াই হয়। রানঅফ নির্বাচন সচরাচর হয় না তবে পরিচালনা করা ব্যয়বহুল এবং ভোটারদের উপস্থিতি সাধারণত খুব কম থাকে। নিউইয়র্ক সিটির বর্তমান মেয়র বিল দে ব্লাসিও। তিনি ২০১৩ সালে প্রথম মেয়াদে ও ২০১৭ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হয়ে মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন।
চীনে শ্রেণিবদ্ধ নির্বাচন ব্যবস্থা
দেশটির প্রধান প্রধান নগর অঞ্চলের মধ্যে সাংহাই, কুযাংচৌ, বেইজিং, ছোংছিং, শেনচেন, থিযৈনচিন ও হংকং উল্লেখযোগ্য। চীনে নির্বাচনগুলো একটি শ্রেণিবদ্ধ নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। যার মাধ্যমে স্থানীয় পিপলস কংগ্রেস সরাসরি নির্বাচিত হয় এবং জাতীয় আইনসভা জাতীয় গণ কংগ্রেস পর্যন্ত সব উচ্চ স্তরের পিপলস কংগ্রেসকে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত করা হয়। গভর্নর, মেয়র এবং কাউন্সিলের প্রধানগণ, জেলা, জনপদ এবং নগরগুলোর স্থানীয় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। তবে দেশটির কিছু আইন অনুযায়ী যারা রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত হয়েছে তাদের ভোট দেওয়ার এবং নির্বাচনের পক্ষে থাকার অধিকার নেই। প্রতিটি নির্বাচনে একজন ভোটার একটিই ভোট দিতে পারবেন। চীনের প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারপ্রধান, যিনি চারজন ভাইস প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রণালয় ও কমিশন প্রধান দ্বারা গঠিত স্টেট কাউন্সিলের সভায় সভাপতিত্ব করেন। একদলীয় রাষ্ট্র হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার সাধারণ সম্পাদকের হাতেই থাকে প্রকৃত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। প্রতিটি স্থানীয় ব্যুরো অথবা অফিস স্থানীয় নেতার সমান কর্তৃত্বে থাকে। জনগণের কংগ্রেস সদস্য ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। এদের দায়িত্ব হচ্ছে স্থানীয় সরকারকে নজরে রাখা এবং প্রাদেশিক মহাসভার সদস্য নির্বাচন করা। অন্যদিকে প্রাদেশিক জনসভার কংগ্রেসরা জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত করেন, যেটি প্রতিবছর মার্চে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
জাপানে ইভিএমে ভোটের সুযোগ
জাপানের বিশেষায়িত সিটিগুলোতে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সিটি মেয়র নির্বাচিত হন। তারা চার বছরের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসেবে দায়িত্ব পান। জাপানে চাইলে রাজনৈতিক দল থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন এমন কেউ যেমন সিটি নির্বাচনে লড়তে পারেন তেমনি স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তিও নির্বাচনে নামতে পারেন। সিটি মেয়র নির্বাচনের সঙ্গে তাই কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব খাটানোর সুযোগ কম। জাপানের সিটি নির্বাচনে চাইলে বহিরাগত ভোটার অংশগ্রহণ করতে পারেন না। মেয়রের সঙ্গে ভাইস মেয়র থাকেন। জাপানের যে কোনো সিটি মেয়র প্রশাসনিকভাবে কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত থেকে বাজেট, কর্মপরিকল্পনা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। এ ছাড়া প্রতিটি শহরের মেয়র ‘জাপান অ্যাসোসিয়েশন অব সিটি মেয়রস’ এর সদস্য হিসেবে যুক্ত হন। এই অ্যাসোসিয়েশন থাকায় তারা কেন্দ্র সরকারের বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে একই সুতোয় গাঁথা থাকেন। মেয়র পদে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাপানের ইতিহাস বলছে, তারা ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদান থেকে শুরু করে আধুনিক ইভিএমে ভোট- সব ধরনের প্রক্রিয়ায় ভোট প্রদানের সুযোগ রয়েছে। একসময় তারা খালি কাগজে প্রার্থী অথবা প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া দলের নাম লিখে ভোট প্রদান করতেন। এখন সেখানে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোট দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। ২০০২ সালে এ নিয়ে সে দেশে আইনি নির্দেশনা আসে। জাপানের নিমি, ওকায়ামায় প্রথম ইভিএমে ভোট দেওয়ার সুেেযাগ পায় ভোটাররা।
দিল্লির তিন অংশে তিন মেয়র
ভারতের রাজধানী দিল্লিকে তিনটি মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে ভাগ করে এর তিন মেয়র প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ পালন করেন। দিল্লির উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব মোট তিনটি মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন করা হয় ২০১২ সালে। মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন অব দিল্লি ভেঙেই এই তিনটি অঞ্চল ভাগ করা হয়েছে। জনগণ ভোট দিয়ে একটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের নির্বাচিত করেন। কেন্দ্রের সঙ্গে তারা কর্মপরিকল্পনা করেন। নগরবাসীর বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা ও শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষমতা মেয়রদের হাতেই থাকে। তারা কেন্দ্রের সঙ্গে কর্মপরিকল্পনা সমন্বয় করেন।
লন্ডনে দুই প্রার্থীকে পছন্দ-তালিকা করে ভোটের সুযোগ
যুক্তরাজ্যের প্রাণকেন্দ্র লন্ডন। এখানে প্রতি চার বছর পর মেয়র পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০০০ সাল থেকে লন্ডনে আধুনিক মেয়র, আধুনিক শহরের জোয়ার এসেছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে এই জাঁকজমকপূর্ণ শহরে মেয়র পদে ভোটের লড়াই হয়েছিল। লন্ডনের মেয়র নির্বাচন পদ্ধতিতে ‘সাপ্লিমেন্টারি ভোট’ ব্যবহার করা হয়। দুই পর্যায়ে ভোট গণনার সুযোগ রয়েছে এখানে। ভোটাররা এখানে দুজন প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকেন। একজন প্রথম পছন্দ, অন্যজন দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে বাছাই করেন ভোটাররা। সরাসরি প্রথম পছন্দের কেউ সর্বাধিক ভোট পেলে তিনি নির্বাচিত হন। তবে এত বিপুল জনপ্রিয়তা কমই দেখা যায়। সেক্ষেত্রে শীর্ষ দুজন প্রার্থী রেখে বাকি সবার ভোট পুনরায় প্রার্থীদের মাঝে বিতরণের সুযোগ রয়েছে। দ্বিতীয় পছন্দের ভোটটি তখন চূড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচনে কাজে লাগে। লন্ডনের মেয়র পদে লড়তে প্রায় ১০ হাজার ইউরো আমানত রাখতে হয়। মেয়রের অধীনে ছোট ছোট অঞ্চল ভিত্তিক প্রশাসক কাজ করে থাকেন। ২০১৬ সালের সর্বশেষ নির্বাচনে লন্ডনের মেয়র হন সাদিক খান।
রাশিয়ায় দুই পদ্ধতিতে সিটি নির্বাচন
রাশিয়ার স্থানীয় সরকারব্যবস্থা দুই ধরনের হয়ে থাকে। একটি মেয়র-কাউন্সিল সরকার অন্যটি কাউন্সিল-ম্যানেজার সরকার। রাশিয়াতে রাজধানীর বাইরে ৮৫টি শহরের মধ্যে মাত্র নয়টিতে ভোটের মাধ্যমে মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাশিয়ার স্থানীয় জনগণ এখানে সরাসরি এসে ব্যালটে নিজের ভোট প্রদান করে থাকেন। মেয়র-কাউন্সিল সিস্টেমে তারা প্রথমে মেয়র নির্বাচন করে এবং পরবর্তীতে কাউন্সিলর নির্ধারণ করেন। আর অপর সিস্টেম কাউন্সিল-ম্যানেজার পদ্ধতিতেও জনগণ সরাসরি নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তবে এ পদ্ধতিতে কাউন্সিলকে তারা ভোট দিয়ে নির্ধারণ করে। পরবর্তীতে সিটি ডুমা নগর পরিচালনা করার জন্য একজন ম্যানেজার নির্ধারণ করেন। এই ম্যানেজার সর্বদা সিটি ডুমারের কাছে দায়বদ্ধ। আর রুশ ফেডারেশনের সংবিধানে স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রপ্রধান বলা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রবিষয়ক নীতিনির্ধারণ করবেন এবং জাতিকে দেশের ভিতরে ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করবেন। মূল সংবিধানে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর এবং সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেন। তবে বর্তমান সংবিধান রাষ্ট্রপতির ছয় বছর মেয়াদের ফরমান জারি করেছে। তবে মেয়র ইলেকশন রাশিয়ার সব স্থানে অনুষ্ঠিত হয় না। কিছু সংখ্যক শহরে মেয়র ইলেকশন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়র নির্বাচনের সব কার্যক্রম উচ্চ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের ওপর নির্ভরশীল এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে গভর্নর নির্বাচন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে পারেন।