রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

বিশ্বজুড়ে বিপজ্জনক পর্যটন স্পট

আবদুল কাদের

বিশ্বজুড়ে বিপজ্জনক পর্যটন স্পট

বেড়াতে যাওয়ার জন্য আপনার কী পছন্দ- পাহাড়, সমুদ্র নাকি জঙ্গল! নাকি তিনটিই ভালো লাগে! কর্মমুখর জীবনে যখনই হাঁপিয়ে ওঠা, তখন সুযোগ পেলেই ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে যান প্রাকৃতিক নৈসর্গের পানে। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ কে হারাতে চায়! কিন্তু কজনইবা জানেন কী ঘটবে সামনে?  আমরা হয়তো ভাবি না। কিন্তু পৃথিবীর আনাচে-কানাচে এমন কিছু পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে যেখানে মানুষের আনন্দে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে বিপদমুখী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।  এমন কিছু পর্যটন কেন্দ্র নিয়ে আজকের রকমারি...

 

>> ক্লিফ অব মোহর, আয়ারল্যান্ড

দ্য ক্লিফ অব মোহর বিশ্বের অন্যতম নান্দনিক ও হৃদয়স্পর্শী পর্যটন কেন্দ্র। এটি আয়ারল্যান্ডে অবস্থিত। মোটামুটি আটলান্টিক মহাসাগরের পাশেই এর অবস্থান। পর্যটন পার্কিং লট ক্লিফ অব মোহর থেকে বেশি দূরে নয়। পাশেই বাঁধানো হাঁটার রাস্তা, প্রাত্যহিক পাথরের ধাপ এমনকি কোমর সমান পাথরের দেয়াল রয়েছে এখানে। তবে পর্যটকদের জন্য দেয়ালে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়। কিন্তু হাঁটার রাস্তাটি চলে গেছে ক্লিফের শেষ উচ্চতায়। যেখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এক কথায় মৃত্যুর পথ এখান থেকেই শুরু। অধিক উচ্চতা, অসহনীয় বাতাসের পরিমাণ, কখনো অধিক উষ্ণতা ও অতিরিক্ত বৃষ্টি ক্লিফের পথকে করে তোলে বিভীষিকাময়। পাথরের সুড়কি আর মসৃণ পাথরের এই হাঁটার পথটি সাধারণ পথের মতো নয়। পার্কটির এই পথে মৃত্যুর হাতছানিই বেশি। ২০০৬ সালে এক মহিলা একা হাঁটছিল। পাহাড়ের ওপরে ওঠার সময় নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই মহিলাটির মৃত্যু হয়। অন্যান্য দুর্ঘটনাগুলো প্রায় একই ধরনের হয়েছিল। ২০০৭ সালের ঘটনা, ২৬ বছর বয়সী এক মা তার চার বছরের সন্তানকে নিয়ে ১৮০ মিটার (প্রায় ৬০০ ফিট) ক্লিফের ওপর থেকে লাফ দেয়। এসব ঘটনার পর থেকে সেখানে পর্যটকদের ভ্রমণের ওপর সতর্কতা জারি করা হয়। তখন থেকেই এই সুন্দর ক্লিফ মোহরকে বিপজ্জনক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। নানাজনের নানা মত, একপ্রকার রহস্যের ধূম্রজাল তৈরি হয় এই ক্লিফ মোহরকে নিয়ে।  এখানে যারা যায় তারা বেশির ভাগই পাহাড় থেকে লাফ দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই যায় বলে ধারণা করা হয়। ২০১০ সালে প্রাকৃতিক বিপজ্জনক এলাকা হিসেবে দ্য ক্লিফ অব মোহরকে সারা বিশ্বের কাছে ফোকাস করা হয়।

 

>> হাল্ফ ডোম, যুক্তরাষ্ট্র

হাল্ফ ডোম, পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ঙ্কর একটি পর্যটন কেন্দ্র। যেখানে এখন পর্যন্ত মোট ৬০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এটি মূলত একটি পাহাড়-উপত্যকা। পর্যটকরা এখানে পাহাড় বেয়ে ওঠাকে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে। হাল্ফ ডোম পাহাড়টির উচ্চতা এতটাই বেশি যে, এখানে আসা প্রত্যেকের পাহাড়ে চড়তে সারা দিন কেটে যায়। ১৫০০ মি. (প্রায় ৫০০০ ফিট) উচ্চতার এই হাল্ফ ডোমে খাড়া পাহাড় বাইতে হয়। পাহাড়ে চড়ায় কিন্তু সুবিধাও আছে। শরীরের ৪০০০-৯৮০০ ক্যালোরি (মেদ) কমে যায়। পাহাড়টির শেষ ১২০ মি. (প্রায় ৪০০ ফিট) চড়ার জন্য পর্যটকদের জন্য রয়েছে মেটাল ক্যাবল। বিপত্তি শুরু এখান থেকেই। অনেক বেশি উচ্চতা ও মেঘলা পরিবেশ হওয়ার কারণে অনেক আরোহণকারী অনুৎসাহী হয়ে পড়েন। কারণ ক্যাবলটি তখন পিচ্ছিল হয়ে যায়। এতে অনেকেই নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না। এতে মারাত্মক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। মেটাল ক্যাবলের নিচে মৃত্যুপুরী ভার্নাল জলপ্রপাত। এতটাই ভয়ঙ্কর যে, কেউ একবার পড়ে গেলে নির্ঘাত মৃত্যু। ২০১২ সালের ঘটনা, এক ব্যক্তি হাল্ফ ডোমের ক্যাবলে আরোহণ করে দুর্ঘটনায় পড়েন। শত চেষ্টা করেও তিনি পাহাড় আঁকড়ে ধরে রাখতে পারেননি। পরবর্তীতে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০১১ সালে তিনজন আরোহী নিরাপত্তা বেষ্টনী উপেক্ষা করে পার হতে গিয়ে জলপ্রপাতে পড়ে যান। এদের মধ্যে দুজন জলপ্রপাতে ভেসে যান ও অন্য একজন ১৮০ মি. (প্রায় ৬০০ ফিট) ওপর থেকে ছিটকে পড়ে মারা যান। জলপ্রপাতটি শুধু ভয়ঙ্করই নয়, এখানে রেকর্ড পরিমাণ দুর্ঘটনাও ঘটেছে। পাহাড়ের এমন স্থানও রয়েছে যেখানে আলোর ব্যবস্থাও নেই। এজন্য সঙ্গে আলোর ব্যবস্থা করে নিতে হয়। এখানকার ৬০ ভাগ উদ্ধারকর্মীই প্রতিনিয়ত বিপদগ্রস্ত আরোহীদের উদ্ধারে ব্যস্ত থাকেন। হেলিকপ্টারে করে চলে উদ্ধার তৎপরতা, সঙ্গে থাকে প্রাথমিক চিকিৎসার সব ব্যবস্থা। কিন্তু দুর্ভাগ্য যখন পিছু ছাড়ে না তখন উদ্ধারকারী টিমের আর কী করার থাকে!

 

>> ক্যামিনিটো দেল রে, স্পেন

ক্যামিনিটো দেল রে স্প্যানিস রাজা আলফোনসো ১৩-এর সময়ের সুন্দর একটি পর্যটন স্থান ও হাঁটার জায়গা হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই নান্দনিক স্থানটি একটি ভয়ঙ্কর মৃত্যুপুরী। পরবর্তীতে গেনটানিস জর্জ এখানে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেন। এই মানুষটি পাহাড়ের মধ্যে পথটি স্থাপন করেন যার দৈর্ঘ্য মাত্র ১ মিটার (৩ ফিট)। বর্তমানেও একই অবস্থায় আছে অসাধারণ পথটি। পথটি নিছক ক্লিফ- এর মতো লম্বায় ১০০ মিটার (৩০০ ফিট)। এটাকে টেকনিক্যালি জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এখানে পাঁচটি নিহতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু প্রতি বছর আগ্রহী অনেক অভিযাত্রীর জন্য এটাকে বন্ধ করা যায়নি। প্রতি বছরই এখানে পাহাড়ের পথ পার হওয়ার সময় পড়ে গিয়ে ভঙ্গদশা তৈরি হয়। অর্থাৎ কারও হাত ভাঙে, কারও পা, আবার কারও কারও জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করে নিতে হয়। আগ্রহী আরোহণকারীরা তা বুঝতে চান না। দুঃসাহসিকতার জন্য এই ভয়ানক তিন ফিটের রাস্তা পার হতে যান অনেক আরোহণকারী। সরু পথটি ক্যামিনিটো দেল রে-কে কলঙ্কিত করেছে। অনেক বিপজ্জনক হলেও পাহাড়ি পথটি দেখতে সুন্দর, পরিষ্কার কাঠের তৈরি পুলের মতো। অনেকেই মরীচিকার এই পথটিকে সমর্থন করেন আরোহণ করার জন্য। আরোহণকারীদের অন্য কোনো পছন্দ নেই তবে সাবধানে আরোহণ করতে হয়। পথটিতে একজনের বেশি একসঙ্গে চলতে পারবেন না। এমনকি পথটি পাহাড়ের গা ঘেঁষে হওয়ায় পাহাড়ের অনেক গর্ত রয়েছে।  সঙ্গে উচ্চতার ভয় তো আছেই। পথটিতে আরোহণ করার সময় নিচে তাকালে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।

 

>> অ্যালনইউক গার্ডেন, ইংল্যান্ড

‘আমাদের আশেপাশে এমন স্থানও রয়েছে যা সবুজ-শ্যামল হলেও অভিযাত্রীদের জন্য ঝুঁকিমুক্ত বাগানের অভাব প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়’ কথাটি বলেন ইংল্যান্ডের নার্থাম্বারল্যান্ড রাজ্যের ডাচ-পত্নী জেন পার্সি। তিনি নিজেই অ্যালনউইক প্রাসাদের বাগানটি যে বিষাক্ত তা নিশ্চিত করেন। ডাচ রাজার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাগানটিকে পার্সি প্রথমে তুচ্ছভাবে নেন। সত্যিকার অর্থে বাগানের কিছু অংশ যে বিষাক্ত, তা তার চিন্তার বাইরে ছিল। বাগানের জমির কিছু অংশ ব্যক্তিগত চিকিৎসক বা আরোগ্যকারীর সম্পত্তি হিসেবে পরিচিত ছিল। সেখান থেকে মূলত চিকিৎসার জন্য ওষুধ তৈরির গাছগাছালি সংগ্রহ করা হতো। পার্সি বুঝতে পারেন এই বাগান মূলত অবসর সময় কাটানোর জন্য নয়, কারণ এটা বিষক্রিয়ায় পরিপূর্ণ একটি বাগান। অ্যালনউইক প্রাসাদের বাগানের অংশটুকু একটি বিষাক্ত বাগান হিসেবেই পরিচিত। এজন্য এখানে আসা দর্শনার্থীদের সম্পূর্ণ সতর্কীকরণ করে বাগানের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাগান ভ্রমণে আসা দর্শনার্থীদের কাছে এটি তখন আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে। ভ্রমণে আসা দর্শনার্থীরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে বাগানটি পর্যবেক্ষণ করলেও ধারে-কাছে ঘেঁষতে চাইতেন না। বাগান থেকে এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস বের হয় যা কারও নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহে প্রবেশ করলেই জমদূত হাজির। এই অভিশপ্ত স্থানটিতে ভ্রমণ করতে আসা অনেক দর্শনার্থীই জীব-উদ্ভিদের বিষ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে অনেকেই দুর্বল হয়ে পড়েন। ইতিহাসে এমন কিছু অদ্ভুত স্থানের সন্ধান পাওয়া যায় যা কিনা বিধাতার তুরুপের তাস হিসেবে বলা হয়। আজব হলেও সত্য যে, এই বাগানটি বিষক্রিয়া হওয়ার আগে এখানে সারিবদ্ধ অনেক গাছ ছিল। ডাচ-রানীর অন্য জমির মধ্যে এই জমিটি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এখানে নারিকেল ও ক্যানাবিস গাছ রোপণ করা হয়। এর সৌন্দর্যবর্ধনে এখানে খেলার সরজ্ঞাম ও শিক্ষণীয় বস্তু স্থাপন করা হয়। স্কুলের বাচ্চারা খেলা করতে এখানে আসত। কিন্তু অনেকেই বিরক্ত ও অসুস্থ হয়ে যেত।

 

>> ভ্যালি অব ডেথ, রাশিয়া

নামেই রয়েছে ভ্যালি অব ডেথ। কিন্তু রূপ দেখে কে বলবে মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে অপেক্ষা করছে সে! রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপের পূর্বাংশে রয়েছে কেহিন্নাইক আগ্নেয়গিরি। ঠিক তার পাদদেশেই রয়েছে এই মৃত্যুর উপত্যকা। যারা নির্জন স্থান পছন্দ করেন, তাদের জন্য এই জায়গা একেবারে পিকচার পারফেক্ট। কিন্তু সেই সুখ যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না, কারণ কিছুক্ষণ থাকার পর থেকেই শুরু হবে মাথা ঘোরানো, চোখ জ্বালা করবে, শ্বাস আটকে আসবে। ধীরে ধীরে আপনি ঢলে পড়বেন মৃত্যুর কোলে। কারণ এখানকার বিষাক্ত বাতাস! আসলে কেহিন্নাইক আগ্নেয়গিরির বিষাক্ত গ্যাসেই এখানকার বাতাস বিষে ভরে আছে। এই গ্যাসের কারণেই কোনো প্রাণী এখানে বাঁচতে পারে না। একটি গবেষণায় প্রকাশিত, বিষাক্ত গ্যাসের কারণেই এখানে পশুপাখিদেরও মৃত্যু হয়ে থাকে। প্রধানত হাইড্রোজেন সালফাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতো গ্যাসই এখানকার বাতাসে ভরে রয়েছে।

 

>> মাদিদি পার্ক, বলিভিয়া

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া আন্দিজ পর্বতমালার অনেক উঁচুতে অবস্থিত। বলিভিয়াকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর ছাদ। বরফাবৃত পর্বতশ্রেণি, মালভূমি এবং সবুজে ঘেরা বনাঞ্চল- কী নেই সেখানে। প্রকৃতি যেন এখানে সব রূপরস ঢেলে দিয়েছে। আর সেই দেশেরই এক রহস্যময় স্থান মাদিদি ন্যাশনাল পার্ক। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের সবচেয়ে চমৎকার বায়ো ডাইভার্স এলাকার একটি এই বনাঞ্চল। যেতে হবে নৌকায়। বেনি নদী দিয়ে রাড়েনবাক পেরিয়ে জঙ্গলের কর্দমাক্ত ভূমিতে পা রাখতে পারবেন আপনি। আর এরপরই প্রবেশ করবেন জীব ও উদ্ভিদ জগতের মাঝে। মুগ্ধ হতেই হবে। এখানেই শেষ নয়, আন্দিজ থেকে ৭০০০ বর্গমাইল দূরে আমাজনের গহিনে মাদিদি ন্যাশনাল পার্কে রয়েছে বিষাক্ত সব গাছ। সেগুলোর সংস্পর্শে এসেছেন, তো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। কাঁটাজাতীয় কিছুতে হাতে সামান্য ক্ষত হলেও আর রক্ষা নেই। নানা রকম রোগ ও সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।

 

স্কেলিং মিসেল, আয়ারল্যান্ড


স্কেলিং মিসেলের পরিচিতি হয়েছে তেমন খুব বেশি দিন হয়নি। হলিউডের মুভি স্টার ওয়্যারসের মধ্য দিয়ে এই পর্যটন কেন্দ্রটির জন্ম। আইরিশ সভ্যতার সঙ্গে স্কেলিংয়ের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। ধারণা করা হয়, এটি সন্যাসীদের উপনিবেশ ছিল। স্থানটি দুর্লভ ও নিরাপদ ভূখ- হওয়ায় সন্যাসীরা পছন্দ করেছিলেন। প্রায় ষষ্ঠ ও অষ্টম শতাব্দীতে তৈরি হওয়া এই স্কেলিংয়ের আজো কোনো পরিবর্তন নেই। যদিও নাকি বর্তমানে এটি একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। গ্রেটার স্কেলিং ওয়েবসাইটে গেলে কিছু ভিডিও পাওয়া যাবে। যা কিনা এখানে আসা দর্শনার্থীদের জন্য সতর্কতাস্বরূপ। কী করলে বা কীভাবে থাকলে অক্ষত ভ্রমণ করা যাবে তারই নির্দেশনা রয়েছে। স্কেলিং মিসেল পর্বতমালা আরোহণের জন্য ৬০০ বা তার বেশি প্রাচীনতম পদক্ষেপের নির্দেশনা রয়েছে ভিডিওগুলোয়। এটি অবশ্যই দুর্ঘটনার জায়গা যদি পর্যটকরা সতর্ক না থাকেন। পানি ও খাবারের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এমনকি আশ্রয় স্থান বা টয়লেটের ব্যবস্থাও নেই। স্কেলিং দ্বীপের পাহাড়ি পথ ও পাশেই সমুদ্র থাকায় ঘণ্টার বেশি বিরক্তিকর নৌকা ভ্রমণ অনেক সময় পর্যটকদের বিরক্ত করে তোলে। দ্বীপটিতে অবতরণ করাটা কোনো ব্যতিক্রম কিছু নয় কিন্তু উঁচু পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এলাকাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে অনেক শিলা পড়ে। কিন্তু এটাই একমাত্র সমস্যা নয়, হাজার বছরের পুরনো রুক্ষ, অমসৃণ ও আঁকাবাঁকা পাহাড়ি সিঁড়িও এখানকার অন্যতম বড় সমস্যা। ২০০৯ সালে এই দ্বীপে পৃথকভাবে দুটি নিহতের ঘটনা ঘটে।

 

>> হাওয়াই ভলকানো, যুক্তরাষ্ট্র

যদি চিন্তা করেন এই ভ্যাকেশনে কোথাও থেকে ঘুরে আসবেন তাহলে ভলকানোর মতো পর্যটন কেন্দ্র খুঁজে পাবেন না। হাওয়াইয়ের ভলকানো পর্যটন স্থানটি অনেক সুন্দর ও ভ্রমণ প্রমোদ স্থান। মূলত হাওয়াই ভলকানো হচ্ছে একটি আগ্নেয়গিরির পাশে অবস্থিত পার্ক। যদিও নাকি ভলকানোর ট্র্যাক রেকর্ডে মৃত্যুর ছায়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এ ছাড়া ভলকানো ন্যাশনাল পার্কটি অস্থায়ী বাইসাইকেল ভ্রমণের স্থান। ২০০৭ সালে উদ্বোধনের পর থেকে তিনটি নিহত ও রেকর্ড সংখ্যক আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এখানে পর্যটকরা বাইসাইকেল চালানোর জন্য আসেন। রাস্তাগুলো অনেকটা সরু খাড়া-নিচু প্রকৃতির। মৃত্যু তখনই হাতছানি দেয় যখন বাইসাইকেল নিচু রাস্তার দিকে ধাবিত হয়। অনেকেই তখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। এটাই যে একমাত্র বাধা তা কিন্তু নয়! ১৯৯২ থেকে ২০০২, এই ১০ বছরে পার্কের রেকর্ড রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৪০টি নিহত ও ৫০টিরও বেশি গুরুতর আহত হয়। ভলকানো মূলত কিলাওয়োর দ্বীপের সঙ্গে সংযুক্ত। ১৯৩৮ সালের শেষ দিকে এর উদ্ভাবন। এটি অনেক ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে মূল আকর্ষণ। এটাকে জিওট্যুরিজম বলা হয়। এটা একটি আগ্নেয়গিরি। এই আগ্নেয়গিরির লাভায় দুর্ঘটনার সম্ভাব্যতা বেশি থাকে। অনেকে কাছে থেকে দেখার জন্য যান আর এতেই ঘটে যায় জীবনের সমাপ্তি। এই লাভার গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পরিবেশও দূষণ করে। আগ্নেয়গিরির ধোঁয়া মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এক কথায় বলা যায় এর আশপাশে যাওয়া মানে জমদূতের সাক্ষাৎ করা। লাভার ধোঁয়ায় রয়েছে ক্ষতিকর বাষ্পীয় মেঘ। এটি কার্বন ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের সমন্বয়ে একটি ক্ষতিকর গ্যাস। এই গ্যাস মানবদেহের অস্থি ও হৃৎপিন্ডের ক্ষতি করে। এখানে ভ্রমণে আসা অনেকে পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে আসতে পারেন না বলে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে থাকেন। এ ছাড়া এখানে বিশুদ্ধ পানির অভাব। তাই সম্ভাব্য মৃত্যুর হাতছানি এখানে প্রতিনিয়তই।

 

>> কোকোডা ট্রাইল পাপুয়া নিউগিনি

কোকোডা ট্রাইলের পাশে ১০০ কিলোমিটার (৬০ মিটার) পর্যন্ত এলাকা গরম, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ। পাপুয়া নিউগিনির দক্ষিণ উপকূলের এই কোকোডার চারপাশে ভয়ানক বিপদে পরিপূর্ণ। সবুজে ঘেরা এই কোকোডাতে রয়েছে চিকিৎসার হরেক রকম গাছগাছালিতে ভরা। কোকোডা রেইনফরেস্টে রয়েছে বহিরাগত পশুপাখি, বন্যপ্রাণী, পরিষ্কার পানি এবং স্থানীয় জনসাধারণ যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম থেকে বসবাস করে আসছেন। এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জনপ্রিয় স্থান যেখানে অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সৈন্যরা অবস্থান করতেন। প্রতি বছরই হাজারেরও বেশি পর্যটক এখানে ভ্রমণে আসেন। এর মধ্যে বিপজ্জনক কিছু পরিখা রয়েছে যেখানে পা রাখলেই মৃত্যু। এই বনের মধ্যে হাঁটার ব্যবস্থা, পাহাড়ে আরোহণের ব্যবস্থা, এমনকি নদীতে সাঁতারের ব্যবস্থাও রয়েছে। হাঁটার সময় অনেকেই খেয়াল করেন না যে গর্ত থাকতে পারে। পর্যটকরা এখানে আসার জন্য যা যা দরকার সবই নিয়ে আসেন। পাহাড়গুলো দেখতে কয়েক মাইল লম্বা মনে হয়। আশপাশে পড়ে থাকা যুদ্ধের সরঞ্জামগুলো দেখার জন্য অনেক পর্যটকই আগ্রহভরে এখানে আসেন। অনেক সময় ভ্রমণে আসা পর্যটকরা মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। পর্যটকদের পর্যটন গাইড অনুসরণ করতে হয়। অনেক স্থানে যুদ্ধের অনেক পরিত্যক্ত সরঞ্জামের দেখা মিলবে। এখানকার সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে- পরিখায় পড়ে অনেকেই হাড় ভাঙেন, অনেকের পা ভাঙে আবার অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে এখানে একটি পর্যটক দল বেড়াতে এসে স্থানীয় দস্যুদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হন।

 

প্রাইয়া ডি ভোয়া ভিয়েজিম ব্রাজিল

স্নিগ্ধ বাতাস, নান্দনিক সৈকত, হৃদয়স্পর্শী সূর্যাস্ত, শহর থেকে কাছাকাছি, উষ্ণতায় পরিপূর্ণ একটি বিচ, পরিষ্কার পানির ঢেউ আর চারদিকে বিভিন্ন পাখির কলতান- এমনটিই হয়তো ভাবছেন। এমন একটি সুন্দর সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ কার না ভালো লাগে। যদি সেখানে হাঙ্গর না থাকে। প্রাইয়া ডি ভোয়া ভিয়েজিম ব্রাজিলের সবচেয়ে লম্বা সমুদ্রসৈকত হিসেবে সারা বিশ্বেই পরিচিত ছিল, যা তৈরি হয় ১৯৯২ সালে কিন্তু হাঙ্গরের আক্রমণের জন্য পরে তা ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। ১৯৯২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ৫৬ বার হাঙ্গরের আক্রমণের শিকার হন পর্যটকরা। হয়তো ভাবছেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় অনেক কম’। কিন্তু তা নয়, প্রাইয়া ডি ভোয়া ভিয়েজিম সৈকতে মানুষের হাঁটাচলার সুযোগ ছাড়া অন্য কিছু নেই। অস্ট্রেলিয়ার হাঙ্গরের আক্রমণের এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো, হাঙ্গরের আক্রমণ কেন? কারণটি হলো সমুদ্রের গভীরতা কম। আর হাঙ্গরগুলো সমুদ্রের কূলেই বেশি অবস্থান করে থাকে। এতে আক্রমণের শিকার হন সমুদ্রকূলে গোসল করা ও সাঁতার কাটা পর্যটকরা। ১৯৮৪ সালে যখন বিচটি খোলা হয়, তখন বিভিন্ন মোহনা থেকে আসা স্ত্রী হাঙ্গরের জন্য বিচটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল। কিন্তু টাইগার হাঙ্গরগুলো এখানে এসে সমস্যার সৃষ্টি করে অর্থাৎ প্রজনন বাড়ায়। এরা বিভিন্ন কারণে আক্রমণ করে থাকে। হাঙ্গরের মূল পছন্দই হলো উপকূল এলাকা। কিন্তু সেই এলাকাগুলোয় অধিক পরিমাণে জাহাজ যাতায়াত করার কারণে তারা সেখানে থাকতে পারে না। যখন তারা পর্যটকদের সমুদ্র এলাকায় প্রবেশ করে, এমনকি তারা অনেক সময় ভালো খাবারের জন্যও উপকূলে আসে। বিচের নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বিপদ যখন আসে নিরাপত্তাকর্মীরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারেন না। এতে যা ক্ষতি হওয়ার তা হরহামেশাই হয়ে থাকে।

কোলোরাডো নদী, যুক্তরাষ্ট্র

ভেলায় চড়া যে কোনো পর্যটকের জন্যই মজার। কিন্তু তা যে অনেক সময় বিপদ হতে পারে কজনই বা ভাবেন। কোলোরাডো নদীর প্রবহমান পদ্ধতি ভিন্ন রকম। এটা অনেকটা বিপজ্জনক। ২০১৪ সালে নদীটির বড় সমস্যা ধরা পড়ে। কোলোরাডো হিমালয় পর্বতের ওপর বৈশ্বিক পরিবর্তনের জন্য পর্বতসমান পরিসর থেকে বরফ গলে পানির প্রবহমান পানির প্রকৃতি অনেক বেড়ে যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এর সবচেয়ে বড় কারণ বলে ধারণা করা হয়। আসলে তা আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। কোলোরাডো পার্ক ও বন্যপ্রাণী বিভাগের হিসাব অনুযায়ী- এটি বিরাট সমস্যা, অতিরিক্ত পরিমাণে বরফ গলে কোলোরাডো হিমালয় পর্বত থেকে পানির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের চিন্তার বাইরে। ২০০৭ সালে ১২ জন পর্যটক নিহত ও ১৭৬ জন গুরুতর আহত হন। কোলোরাডো শহরের বিভাগীয় অধিদফতর তা থেকে জানানো হয়। এর মূল সমস্যা হচ্ছে যারা এখানে বেড়াতে আসেন তারা অনেক সময় পরিপূর্ণ নিরাপত্তার সরঞ্জাম নিয়ে আসেন না। যার জন্য এই দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। কিন্তু অনেকেই একা যাওয়ার মনোভাব ও বায়ুমন্ডলের অবস্থা বিবেচনা না করার কারণে অনেক বেশি সমস্যা হয়। অনেক পর্যটক মদ্যপ অবস্থায় নদীতে ভ্রমণে আসেন। যার জন্য দুর্ঘটনাও ঘটে। এই নদীপ্রপাত স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক দ্রুত প্রবহমান এমনকি অতি উচ্চ পরিমাণে পানির ঢেউ প্রবাহ হয়ে থাকে। ২০১৪ সালে দুর্ঘটনার পরিমাণ প্রায় বেড়ে যায়, এমনকি নদীর প্রবহমান গতি আরও বেড়ে যায়। ২০১৪ সালের প্রথম ৬ মাসে ১৫ জন নিহত ও প্রায় অর্ধশত গুরুতর আহতের ঘটনা ঘটেছে।

 

অ্যাকাপুল্কো সৈকত মেক্সিকো

অ্যাকাপুল্কো নামটির সমার্থক শব্দ হয়তো শান্তিময়। আমেরিকানদের জন্য এই সমুদ্র সৈকতটি বিলাসবহুল অবকাশের স্থান। দারুণ সৈকত, সুন্দর আবহাওয়া, অনেক বড় শহরের পাশের এই সৈকতটি পর্যটকদের জন্য অনেক আরামদায়ক বিলাসবহুল অবকাশ যাপনের স্থান। কিন্তু দুর্ভাগ্য, পর্যটকরা এখানে মোটেও নিরাপদ নন। আমেরিকান অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মতে, ৩০টিরও বেশি বৃহত্তর অপরাধ ঘটে গেছে এই সমুদ্রসৈকতে। যার ভুক্তভোগী এখানে আসা পর্যটকরা। সম্প্রতি ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী লাখে ১৪২টি হত্যার ঘটনা ঘটে এখানে। এমনকি এখানকার নাগরিক ও গুটিকয়েক চিহ্নিত অপরাধী প্রচুর পরিমাণে মাদকাসক্ত। যার দরুন অপরাধের পরিমাণও তর তর করে বেড়ে ওঠে। ২০১৩ সালের ট্র্যাক রেকর্ড অনুযায়ী জানুয়ারি ও ফেব্র“য়ারি মাসে প্রায় ২০০ হত্যার ঘটনা ঘটে। বেসরকারি হিসাব মতে, সম্পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও এখানে এসব অপরাধ হয়ে থাকে। এসব ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হয় এমনকি এই অন্ধকার জগতের ঘটনাগুলো পত্রপত্রিকা, টিভি নিউজে ব্যাপক চাঞ্চলের সৃষ্টি করে। আরও দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই ঘটেছে দৃষ্টিনন্দন সৈকতের সামনেই। এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছে ভ্রমণে আসা পর্যটকদের ধর্ষণের ঘটনা। যদি কেউ অ্যাকাপুল্কো সৈকত ভ্রমণের সুপারিশ করে তাহলে তাকে বিশেষভাবে নিরাপত্তা দেওয়া এলাকায় থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। সাবধানে চলাফেরা করা এমনকি পর্যটকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা করে তারপর তাকে ভ্রমণের অনুমতি দেয় সরকার।

সর্বশেষ খবর