১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দিন। মূলত সেদিনই স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ লক্ষাধিক লোকের সমাবেশে পাকিস্তানি শাসকের হুমকির মুখেও রেসকোর্স ময়দানে ২৩ বছরের বঞ্চিত, অবহেলিত ও শোষিত বাঙালিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেন। তাঁর ১৮ মিনিটের অসামান্য ভাষণে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টির পরিচয় মেলে। সেই দিন বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ নতুন জীবনের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়। মুক্তিকামী বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মপন্থা-কৌশল তুলে ধরেন, দেন সঠিক দিকনির্দেশনা। ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’
প্রায় দুই শ বছর ব্রিটিশ শাসন ও তেইশ বছরের পাকিস্তানি শোষণের শিকার বাঙালি জাতি। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ববাংলায় আধিপত্য বিস্তার করতে নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে নিরলস সংগ্রাম-আন্দোলন করতে থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ থেকে শুরু করে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ, সর্বোপরি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- এই দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে তিনি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অবশ্যম্ভাবী করে তোলেন।
ছয় দফায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে সেই স্বাধিকারের পক্ষে নিরঙ্কুশ রায় দেয় জনগণ। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি আসন। বাকি দুটি আসন পায় পিডিপি ও স্বতন্ত্র সদস্য। নির্বাচনের পর সামরিক জান্তা প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা জেড এ ভুট্টো এবং পাকিস্তান সামরিক চক্র আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে। জনরোষ তুঙ্গে ওঠে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিকাল ২টা ৪৫ মিনিটে ভাষণ শুরু করে ৩টা ৩ মিনিটে শেষ করেন। এই ১৮ মিনিটের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু প্রাণিত করে তোলেন লাখো বাঙালিকে, শানিত করেন বাঙালির সাহস। ২৩ বছরের পটভূমি তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৫ তারিখ অ্যাসেম্বলি ডেকেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই। রক্তে পাড়া দিয়ে, শহীদের উপর পাড়া দিয়ে, অ্যাসেম্বলি খোলা চলবে না।’ বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই। ...আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না।’
তিনি একদিকে পাকিস্তানি জান্তাকে হুঁশিয়ার করেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না।’ একই সঙ্গে নিরস্ত্র বাঙালিকে শিখিয়ে দেন কীভাবে শত্রুর আঘাতে প্রতিঘাত করতে হবে, ‘জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব।’
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন এটা নিয়ে কারও দ্বিমত ছিল না। তবে বঙ্গবন্ধু এক্ষেত্রে কিছুটা কৌশলী ভূমিকা পালন করেন। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন, আর ইয়াহিয়া মুক্তিকামী জনতাকে নির্বিচারে হত্যা করবে, তা তিনি চাননি। ৬ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া দীর্ঘ ফোনালাপে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেন, তিনি যেন এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন, যেখান থেকে ফেরার আর উপায় না থাকে। বঙ্গবন্ধু একবারও উচ্চারণ করলেন না যে এটাই স্বাধীনতার ঘোষণা, অথচ পাকিস্তানি শাসককে থোড়াই কেয়ার করে কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিলেন। বজ্রকণ্ঠে তিনি ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব-এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ পাকিস্তানি শাসকের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, নিরস্ত্র বাঙালি স্বাধীনতার জন্য কেবল গুলি খেতে বুক পেতে দেবে না, তারা পালটা আঘাতের জন্য প্রস্তুত।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করলে সেটা হতো বাঙালির জন্য চরম আত্মঘাতী। তিনি চেয়েছিলেন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো যেন অপ্রস্তুত ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা চালানোর অজুহাত না পায়।
৭ মার্চের ভাষণের আগে নানা মুনির নানা মত উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু তাঁর চিরচেনা ভঙ্গিতে লক্ষ জনতার সামনে যে ইতিহাস খ্যাত দূরদর্শী ও সময়োপযোগী ভাষণ দেন তার প্রেরণা তিনি পান বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছ থেকে। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বড় সাক্ষী। তিনি তাঁর ‘কিছু স্মৃতি কিছু কথা’ বইয়ে লিখেছেন-বাসায় গিজগিজ করছে মানুষ। বেগম মুজিব সবাইকে তাদের ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন। ঘরে তখন বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব আর শেখ হাসিনা। তিনি বললেন তুমি ১০টা মিনিট শুয়ে রেস্ট নাও। শেখ হাসিনার ভাষায়-‘আমি মাথার কাছে, মা মোড়াটা টেনে নিয়ে আব্বার পায়ের কাছে বসলেন। মা বললেন, মনে রেখ তোমার সামনে লক্ষ মানুষ। এই মানুষগুলোর নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তাই তুমি বলবা। কারও কোনো পরামর্শ দরকার নেই। তুমি মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ কর, কাজেই কী বলতে হবে তুমি জান। এত কথা, এত পরামর্শ কারও কথা শুনবার তোমার দরকার নেই। এই মানুষগুলোর জন্য তোমার মনে যেটা আসবে সেটা তুমি বলবা।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সর্বজনীনতা। এই ভাষণ দেশ-কালের গন্ডি ছাড়িয়ে সর্বজনীন হয়েছে। অলিখিত বক্তৃতাটিতে কোনো পুনরুক্তি ছাড়াই একটি জাতির স্বপ্ন, সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এই ভাষণটি একটি জাতির প্রত্যাশার আয়নায় পরিণত হয়েছে। এই ভাষণের এমনই শক্তি যে বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে তোলে মাত্র আঠারো মিনিটে। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধেও এই ভাষণই বাঙালিকে প্রেরণা জুগিয়েছে।
২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবরে ইউনেস্কো জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের অমর এই ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ অর্থাৎ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ভাষণটি মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে সংগৃহীত হয়। বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নেওয়া এই ভাষণ ২৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
এই পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ইতিহাসখ্যাত ভাষণ দিয়ে অমর হয়ে আছেন-আমেরিকার নাগরিক-অধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৩ সালে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অত্যাচার বৈষম্যের অবসান ঘটাতে দাস প্রথার বিরুদ্ধে ভাষণ দেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ১৯৩৩ সালে অভিষেক অনুষ্ঠানে দেশবাসীর প্রতি বক্তৃতা দেন, ১৮৬৩ সালের যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে মৃতদের স্মরণসভায় আব্রাহাম লিংকনের দেওয়া ভাষণটি ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। দ্বিতীয় ভার্জিনিয়া কনভেনশনে প্যাট্রিক হেনরির ভাষণ, রিভোনিয়া ট্রায়ালে বর্ণবাদী সরকারের প্রতি নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষণ। উল্লিখিত কোনো ভাষণ দেওয়ার সময়েই এ প্রতিভাবান মানুষগুলোকে প্রতিপক্ষের ভয়ংকর চাপের মুখে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখতে হয়নি। গণমানুষ তাদের নেতার ওপর বিশেষ কোনো দাবিও চাপিয়ে দেয়নি। এর মধ্যে আব্রাহাম লিঙ্কন ও মার্টিন লুথার কিং-এর ভাষণ ছিল লিখিত। ভাষণের আগে পূর্বপ্রস্তুতিও ছিল। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল তাৎক্ষণিক, উপস্থিত ও অলিখিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বখ্যাত এই ভাষণগুলো একটি বিশেষ গোষ্ঠী বা বিশেষ ধর্ম-বর্ণ-মতের মানুষের উদ্দেশে দেওয়া। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি একটি জাতির উত্থানের পথ খুলে দিয়েছিল, কোটি কোটি মানুষের বাঁচার দাবি নিয়ে এত অসাধারণ ভাষণ পৃথিবীতে আর ধ্বনিত হয়নি। এই ঐতিহাসিক ভাষণকে উপজীব্য করেই জন্ম নেয় ‘বাংলাদেশ’ নামক এক জাতিরাষ্ট্র। তাই পৃথিবীর যে কোনো জাতির সংগ্রামের জন্য, মুক্তির জন্য এবং স্বাধীন-স্বার্বভৌম ভূখন্ডের জন্য জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণই শ্রেষ্ঠতম।
১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মূল অনুপ্রেরণা দেশের বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ৭ মার্চের ভাষণটি। যেখানে তিনি বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।