শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

গুলশান হামলার অর্থ-অস্ত্রদাতা পরিকল্পনাকারী চিহ্নিত

তদন্ত শেষ পর্যায়ে শিগগির চার্জশিট

সাখাওয়াত কাওসার

গুলশান হামলার অর্থ-অস্ত্রদাতা পরিকল্পনাকারী চিহ্নিত

গুলশানের অভিজাত হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নারকীয় হামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে। হামলায় মদদদাতা, অর্থদাতা ও হামলাকারীদের শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ। কারা কীভাবে অর্থ দিয়েছেন, কারা অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন,

অপারেশনে কারা ছিলেন পুরো ঘটনাই অনেকটা নিশ্চিত গোয়েন্দারা। খুব শিগগিরই বহুল আলোচিত এ মামলার চার্জশিট আদালতে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তদন্ত সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত হলি আর্টিজানের ঘটনায় সাক্ষী হিসেবে আদালতে দেওয়া ১৪ জনের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি এবং তদন্তসংশ্লিষ্টদের কাছে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির ১৬১ ধারায় জবানবন্দি সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে তাদের বক্তব্যে প্রকৌশলী হাসনাত কিংবা তাহমিদের জড়িত থাকার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ চাঞ্চল্যকর ওই মামলায় প্রকৌশলী হাসনাত করিম ও কল্যাণপুর জঙ্গি আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় আটক রাকিবুল হাসান রিগ্যানকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। ইতিমধ্যে রিগ্যানের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করা গেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, নব্যধারার জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পলাতক বাশারুল্লাহ ওরফে চকলেট, নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান, রাজীব গান্ধী ও শিলাকে গ্রেফতার করতে পারলে অনেক রহস্যই খোলাসা হবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তদন্ত অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়েছে। বলা যায়, ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। তবে আরও কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে পারলেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে। জানা গেছে, নব্য জেএমবির প্রধান নিহত তামিম আহমেদ চৌধুরীই ওই হামলার মাস্টারমাইন্ড। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ থাকত নিহত মেজর সাজ্জাদ, আবদুর রহমান, তানভীর কাদেরী, পলাতক খালেদ, রিপন, বোমা মিজানদের। তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই বাস্তবায়ন হয় গুলশান হামলার মতো ঘটনা। প্রভাবশালী সদস্যদের সিদ্ধান্ত অনুসারেই হয় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহের হামলা। তবে পুলিশ ভয়ঙ্কর ওই হামলা রুখে দেয়। গুলশান হামলার অপারেশনের দায়িত্ব ছিল রোহান ইমতিয়াজের ওপর। সম্প্রতি সাভারের একটি আস্তানায় র‌্যাবের অভিযানে নিহত আবদুর রহমান ওরফে সারোয়ার জাহান সর্বশেষ নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতাদের একজন হলেও তিনি পুরনো জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। আবদুর রহমানের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তামিমের। অর্থ সংগ্রাহক ও রক্ষকের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন সারোয়ার জাহান। পুরনো জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমা মিজান নব্য জেএমবিরও সামরিক শাখার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল তার। দেশের বাইরে থাকা নব্য জেএমবির অন্য সদস্য সোহেল মাহফুজের সঙ্গে পরামর্শ করে এসব অস্ত্র-বিস্ফোরক দেশে ঢোকাতেন বোমা মিজান।

যেভাবে অস্ত্র আসে : হলি আর্টিজান হামলার অন্তত ১০ দিন আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আমের ঝুড়িতে ঢাকায় আনা হয় ছোট আগ্নেয়াস্ত্র, গ্রেনেড তৈরির কাঁচামাল ডেটোনেটর ও জেল। এরপর রাজধানীতে হ্যান্ড গ্রেনেড তৈরি করেন নব্য জেএমবির সদস্যরা। আর একে-২২ রাইফেল আসে অনেক আগেই। ছোট মিজান নামে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক পেশাদার চোরাকারবারি ও জেএমবি সদস্য ভারত থেকে এই চালান নিয়ে আসেন। প্রথমে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি আমবাগানে মাটি খুঁড়ে রেখে দেন। পরে সেখান থেকে অস্ত্রের চালান ঢাকায় আনা হয়। সম্প্রতি কাউন্টার টেররিজম ইউনিট রাজধানীর গাবতলী থেকে চার অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতারের পর বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন আবু তাহের, মিজানুর রহমান, সেলিম মিয়া ও তৌফিকুল ইসলাম ওরফে ডা. তৌফিক। তাদের কাছ থেকে একটি নাইন এমএম পিস্তল ও ৭৮৭ পিস ডেটোনেটর উদ্ধার করা হয়।

গ্রেফতার তৌফিক দাঁতের ডাক্তার ছিলেন। জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের হাত ধরে জেএমবিতে যোগ দেন। তিনি ছোট মিজানকে ২০১৪ সালে চোরাকারবারি থেকে জেএমবির জঙ্গিবাদে নিয়ে আসেন। পরে মিজানকে দিয়ে ভারত থেকে ছোট আগ্নেয়াস্ত্র ও ডেটোনেটর নিয়ে আসা হয়। ছোট মিজানকে এ কাজে সহযোগিতা করেন চোরাকারবারি ও জঙ্গি বড় মিজান, জেল্টু, রবিউল ও লাল্টু। সিটি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, ‘উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলো কোথায় তৈরি তা অস্ত্রের গায়ে লেখা নেই। তবে আমরা অস্ত্রের কোয়ালিটি দেখেই বুঝতে পারছি সেগুলো কোথায় তৈরি।’ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা বলছেন, তামিম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন নব্যধারার জেএমবির কাছে ধাপে ধাপে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের চালান আসে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যায়ক্রমে জঙ্গি হামলায় ব্যবহূত হয়। এ অস্ত্র ও বিস্ফোরক চালানের বেশির ভাগই আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে। এসব গ্রেনেড ও অস্ত্র ব্যবহূত হয়েছিল গুলশান, শোলাকিয়া, কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া, রাজধানীর আজিমপুর ও গাজীপুরের জঙ্গি আস্তানায়।

যেভাবে হামলা : চলতি বছরের শুরুর দিকে সিদ্ধান্ত হয় গুলশান, শোলাকিয়া হামলার। সেজন্য ঝিনাইদহের একটি আস্তানায় হয় নিবিড় প্রশিক্ষণ। গুলশান হামলায় নিহত নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজরা ওই প্রশিক্ষণে অংশ নেন। পরে তারা বগুড়া-সিরাজগঞ্জ হয়ে ২৬ জুন ঢাকায় প্রবেশ করেন। প্রথমে অবস্থান নেন শেওড়াপাড়ার একটি বাসায়। দুই দিন পর ভাটারার একটি বাসায় অবস্থান করেন। ওই বাসা থেকেই রোহান ইমতিয়াজের নেতৃত্বে নিবরাস ইসলাম, মীর সামি মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল ও শফিকুল ইসলাম ওরফে জুয়েল অংশ নেন নৃশংস ওই হামলায়। জন্ম নেয় দেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়ের। রাতভর তাদের নারকীয় তাণ্ডবে নিহত হন দুই পুলিশ সদস্যসহ দেশি-বিদেশি ২২ জন নিরীহ মানুষ। ভোররাতে সেনা-নৌবাহিনীর কমান্ডোরা অভিযান চালিয়ে ৩৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করেন। অন্যদিকে ঝিনাইদহ, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের ক্যাম্পে প্রশিক্ষিত আরেকটি জঙ্গি দল অংশ নেয় শোলাকিয়া ঈদগাহে। গুলশান হামলার ঘটনায় নিহত জঙ্গি নিবরাস ইসলাম, মীর সামি মোবাশ্বের, রোহান ইমতিয়াজ, খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল ও শফিকুল ইসলাম ওরফে জুয়েলের দাফন হয় জুরাইন কবরস্থানে। একই সঙ্গে ওই সময় নিহত রেস্তোরাঁর কুক সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের লাশও দাফন করা হয়েছে।

নিহত ২২ জন : হলি আর্টিজানে নিহতরা হলেন বারিধারাভিত্তিক ইতালীয় বায়িং হাউস স্টুডিও টেক্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নাদিয়া বেনেদিত্তো, গুলশান ২ নম্বরের আরেক ইতালীয় বায়িং হাউস ডেকাওয়ার্ল্ড প্রাইভেট লিমিটেডের এমডি ভিনসেনজো দ আলেস্ত্রো, ক্লদিও মারিয়া দান্তোনা, সিমোনা মন্টি, মারিয়া রিবোলি, আডেলে পুগলিসি, ক্লদিও চাপেলি, ক্রিস্টিয়ান রোসিস ও মারকো তোনডাট। অন্যদিকে নিহত সাত জাপানি হলেন তানাকা হিরোশি, ওগাসাওয়ারা, শাকাই ইউকু, কুরুসাকি নুবুহিরি, ওকামুরা মাকাতো, শিমুধুইরা রুই ও হাশিমাতো হিদেইকো। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, নিহত জাপানিদের ছয়জন ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পের সমীক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

আর নিহত ভারতীয় হলেন তারিশা জেইন। এ ছাড়া হামলায় নিহত তিন বাংলাদেশির মধ্যে এলিগেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যানের মেয়ে অবিন্তা কবীর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক বলে জানিয়েছে আইএসপিআর। অবিন্তার নানা সুপার স্টোর ল্যাভেন্ডারের মালিক। অন্য দুজন হলেন ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ হোসেন ও ডেএক্সওয়াই ইন্টারন্যাশনালের মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক ইশরাত আখন্দ। দুই পুলিশ সদস্য হলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন সহকারী কমিশনার রবিউল করিম ও বনানী থানার তৎকালীন কর্তব্যরত ওসি সালাউদ্দীন খান।

অর্থদাতা : হলি আর্টিজান হামলায় বড় অঙ্কের তিন অর্থদাতাকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। তারা হলেন পরিবার নিয়ে সিরিয়ায় পালিয়ে যাওয়া জঙ্গি ডা. রোকনউদ্দিন খন্দকার রোকন, আজিমপুরে নিহত তানভীর কাদরী ও মিরপুরে নিহত মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম জাহিদ। তবে তামিম চৌধুরী বিদেশি অনেক উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। তাকে এ ব্যাপারে সহায়তা করেছেন পলাতক সাইফুল্লাহ ও’জাকি। সম্প্রতি সিটি ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, পরিবার নিয়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমানোর আগে ডা. রোকন নব্য জেএমবির তহবিলে ৮০ লাখ টাকা দিয়ে যান। তবে তিনি যাকে টাকাগুলো জমা দেওয়ার জন্য দিয়েছিলেন ওই ব্যক্তি পুরো টাকা জমা না দিয়ে কিছু মেরে দিয়েছেন। একজনের কাছে ১০ লাখ টাকা দিলে তিনি ৩০ হাজার টাকা জমা দিয়ে বাকিটা নিজেই হাতিয়ে নেন। মিরপুরের রূপনগরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত মেজর জাহিদ তার অবসর ভাতার পুরো টাকা নব্য জেএমবির তহবিলে দিয়েছেন। তবে কী পরিমাণ টাকা দিয়েছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আজিমপুরে নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরীর উত্তরার কোটি টাকার ফ্ল্যাট বিক্রি করে নব্য জেএমবির তহবিলে জমা দিয়েছিলেন। বিদেশে থাকা কোনো কোনো সদস্যের কাছ থেকেও অর্থ এসেছে। এ ছাড়া আরও অর্থদাতা থাকতে পারেন। তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। ৮ অক্টোবর আশুলিয়ায় একটি আস্তানায় র‌্যাবের অভিযানের পর নিহত সারোয়ার জাহানের বাসা থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা, অস্ত্র-গোলাবারুদসহ সাংগঠনিক অনেক নথি উদ্ধার করা হয়। ২০ অক্টোবর রাজধানীর মতিঝিল ও মহাখালী থেকে নব্য জেএমবির নয়ন ও হাসিবুলকে ২৮ লাখ টাকাসহ গ্রেফতার করে র‌্যাব।

২২ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ : গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের মামলায় আগামী ২২ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গতকাল ধার্য তারিখে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না করায় ঢাকা মহানগর হাকিম সাব্বির ইয়াছির আহসান চৌধুরী নতুন করে এ তারিখ ধার্য করেন। গত ১ জুলাই রাতে গুলশান ২ নম্বরের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে দেশি-বিদেশি অন্তত ৩৩ জনকে জিম্মি করে একদল অস্ত্রধারী। পরদিন সকালে কমান্ডো অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনী ওই রেস্তোরাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয়। পরে সেখান থেকে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অভিযানে নিহত হন পাঁচ হামলাকারী। এর আগে রাতে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে জঙ্গিদের ছোড়া বোমায় পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন।

সর্বশেষ খবর