ভূমি সেবা নিয়ে মানুষের দুর্ভোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু সীতাকুণ্ডের মানুষের সেই দুর্ভোগ কমেছে। সেখানকার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলমের নানামুখী জনবান্ধব পদক্ষেপে বদলে গেছে ভূমি সেবা।
গত বুধবার, তখন দুপুর ১২টা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গেই লাগোয়া সীতাকুণ্ড উপজেলা ভূমি অফিস। মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা যায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম নিজ অফিস রুমের বাইরে খোলা আকাশের নিচে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে আছেন। তাকে ঘিরে রয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অর্ধশতাধিক সেবাপ্রার্থী। সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিজেই প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলছেন। দিচ্ছেন সমাধান।
এরকম কয়েকজন সেবাপ্রার্থীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। প্রেমদাস নামে ভাটিয়ারীর এক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি ৯ বছর ধরে ঘুরেছেন কিন্তু সমাধান পাননি। এরপর সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলমের সঙ্গে দেখা করেন। নিজের সমস্যার কথা বলেন। এতে তাৎক্ষণিকভাবে প্রেমদাসকে সমস্যার সমাধান করে দেন তিনি।
প্রেমদাস সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কথা বলতেই খুশিতে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। আরেকজন সেবা প্রার্থী রুপম দাস, তিনি তার বিধবা ফুফুর জীবনস্বত্বের নামজারীর জন্য দীর্ঘদিন ধরে ঘুরেফিরে ব্যর্থ হন। পরে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সঙ্গে দেখা করলে তিনি গত বুধবার সংশ্লিষ্ট সহকারীকে নামজারী সৃজনের নির্দেশ দেন।
‘গত বুধবার আমরা মাত্র ১,১৫০ টাকা সরকারি ফি’র বিনিময়ে নামজারী খতিয়ান হাতে পেলাম’, বলেন রুপম দাস।
কথা হয় নিজাম উদ্দীন নামক একজন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কিছু দিন আগে আবুল কালাম নামের একজন প্রতারক আমার নামজারী করে দেবেন বলে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) নাম করে সাতহাজার টাকা নিয়েছিলেন। পরে আশরাফুল আলম জানতে পেরে সেই প্রতারককে আটক করেন। তিনি আমার সাত হাজার টাকা ফেরত নিয়ে দিয়েছিলেন। সেইসঙ্গে কানুনগোকে আমার নামজারী করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আজ সেই খতিয়ানটি হাতে পেলাম। আমি অত্যন্ত আনন্দিত।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) নিজ অফিস রুমের বাইরে খোলা আকাশের নিচে এভাবেই প্রতি সপ্তাহের বুধবার গণশুনানি করেন। অফিস চত্বরে দেখা যায় নানা রকম জনসচেতনতামূলক ও জনসেবামূলক পোস্টার ঝুলছে।
আরও ভালো করে তাকালে দেখা যাবে, একজন কর্মচারী একটি স্ট্যান্ডের ওপরে মোবাইল রেখে ভূমি অফিসের ফটকের দিকে তাক করে ভিডিও করছেন। তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, ভূমি অফিসে কতজন সেবাপ্রার্থী আসছেন, তারা ঠিক মতো সেবা পাচ্ছেন কি না, কতজন দালাল আসছেন, কতজন অনাকাঙ্ক্ষিত লোক আসছেন তা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। সেবাপ্রার্থীরা তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা নির্বিঘ্নে পাচ্ছেন কি না, তা মনিটরিং করার জন্য ভূমি অফিসের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীর রুমে ভিডিও ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মচারী বলেন, জনগণের কাঙ্ক্ষিত সেবা নির্বিঘ্ন করার পাশাপাশি যারা ভুঁইফোড় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী বা অন্য কোনো পরিচয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মচারীদের কাছে অবৈধ তদবীর, দালালি বা অনৈতিক সুবিধা দাবি করে তাদের বিষয়গুলোও মনিটরিং করা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত কিছু ভিডিও ফুটেজ ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সহসাই আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।
জানা যায়, এ পর্যন্ত আদালতের জাল আদেশ দাখিল, জাল ওয়ারিশ সনদ, জাল দলিল সৃজনের কারণে বিভিন্ন ধরনের দণ্ড প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া সমুদ্র হতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, পাহাড় কাটা, মাটি কাটা, পুকুর ভরাট, সরকারি সম্পত্তি দখলসহ নানা কারণে অনেককে দণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সেবাপ্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা মনির হোসেনের কাছে বর্তমান ভূমি সেবা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, বর্তমান সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম সীতাকুণ্ডে আসার পর থেকে পাহাড়খেকো, ভূমিখেকো, দালালরা আতঙ্কে রয়েছে। মানুষের দোরগোড়ায় ভূমি সেবা পৌঁছে দিতে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। যেকোনো মানুষ যেকোনো সময় সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সঙ্গে কথা বলতে পারছেন।
সেবাগ্রহীতা হিসেবে কলেজ শিক্ষক ইয়াকুব আলী বলেন, ‘আমি সহকারী কমিশনার (ভূমি) মহোদয়ের সেবা ও আচরণে অত্যন্ত সন্তুষ্ট। দিন বদলের প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিনি।’
সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘জনবান্ধন জনসেবা নিশ্চিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর। একজন মানুষও যাতে ভোগান্তির স্বীকার না হয় সেজন্য ভূমি অফিসের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী তৎপর রয়েছেন। তবে আইনগত কারণেই সকল মানুষকে সকল সেবা প্রদান করা সম্ভব হয় না। তারপরও আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি সর্বোচ্চ সেবা দিতে। আমরা পাহাড়খেকো, সরকারি ভূমিখেকো, দালাল ও প্রতারকদের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ