মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মন্ত্রিসভায় রদবদল কতটা জরুরি!

আরিফুর রহমান দোলন

মন্ত্রিসভায় রদবদল কতটা জরুরি!

জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে মন্ত্রিসভায় তার নাম অনেক ওপরে। রাজনৈতিক জীবনে যা তিনি কোনোদিনই আশা করেননি। কিন্তু পরপর দুবার মন্ত্রী হওয়ার পরেও তিনি নাকি খুশি নন। শুনেছি শপথ গ্রহণ ও দফতর বণ্টনের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে জ্যেষ্ঠ ওই মন্ত্রী বলেছিলেন, দফতরটা এবার বদলাতে পারলেন না! আগের পাঁচ বছর এমন কোনো নজরকাড়া কাজ যে এই মন্ত্রী করতে পেরেছেন এমনও নয়। তবু দলীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচে পরেরবারও তাকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়েছে। তবে সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে নিজ নির্বাচনী এলাকার একটি উপজেলায় দলীয় প্রতীক নৌকাকে পরাজিত করতে এই মন্ত্রীর পরোক্ষ ভূমিকা কার্যত প্রকাশ্যেই ছিল। দল ও দলীয় সভানেত্রীর প্রতি এই মন্ত্রীর প্রশ্নাতীত আনুগত্য আছে কি-না তা নিয়ে তখন থেকেই প্রশ্ন ওঠে। মন্ত্রিসভায় এমন রাজনৈতিক নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ সরকার ও সরকার-প্রধানের জন্য কতখানি সহায়ক এ প্রশ্ন যদি ওঠে তার যুৎসই উত্তর আসলে কি আছে?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সভায় সুইজারল্যান্ডে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে যেদিন বক্তব্য রাখার কথা সেদিন দিব্যি হোটেলে বিশ্রামে কাটিয়েছেন আমাদের বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সরকারি দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন সংসদ সদস্য জানান, বাংলাদেশের মন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত আসনটি খালি ছিল। বাংলাদেশের পক্ষে মন্ত্রীর বক্তব্য উপস্থাপন করেন সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। তবে অনুষ্ঠান শেষে ওইদিনই মন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থল থেকে অন্তত ৩০ কিলোমিটার দূরে একটি ভোজসভায় ঠিকই যোগদান করেন যথাসময়ে। সরকারি দলের ওই সংসদ সদস্য একান্ত আলোচনায় বলেন, তিনি শুনেছেন এ ঘটনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওই সভায় যোগ দেওয়া বাংলাদেশের অন্য সদস্যরা মুখ টিপে হেসেছেন। দুঃখও করেছেন। যে সভায় যোগ দিতে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী বিদেশে এলেন, কেন সেই কর্মসূচিতে তিনি গরহাজির এর ব্যাখ্যা কি পরবর্তীতে তিনি কাউকে দিয়েছেন? দেননি। দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ তখনো কি আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ পেয়েছি? সস্ত্রীক ব্যক্তিগত সফরে মন্ত্রী মালয়েশিয়া গেছেন, আবার সমন্বয় সভা ডেকে তা বাতিল করেছেন। সব মিলিয়ে জাহিদ মালেক স্বপন তার নেতৃত্বে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কোনো ম্যাজিক দেখাতে পারেননি। বরং বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে একেরপর এক অনিয়মের খবর যেভাবে প্রতিনিয়ত পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয়ে উঠছে তাতে পরিষ্কার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নেতৃত্বের দুর্বলতা রয়েছে।

বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পাবে কি-না সেটি কোটি টাকার প্রশ্ন। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে দেশের সব মহলে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে, টিপু মুনশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। ‘বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়’ ‘ভারত কথা দিয়ে কথা রাখেনি’ জাতীয় মন্তব্য করে বাণিজ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের মুখে কোথায় কলুপ আঁটতে হয় তা এখনো রপ্ত করে ওঠতে পারেননি তিনি।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম সচিবালয়ে নির্দেশিকা অনুসরণ করে ফাইল নিষ্পত্তি করছেন কি-না এ নিয়ে এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কানাঘুষা লেগেই আছে। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা একান্ত আলাপচারিতায় বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ অনেক ফাইল মন্ত্রীর দফতরে দিনের পর দিন পড়ে থাকছে। স্থানীয় সরকার বিভাগে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতির বিষয়টি এমন সব মহলেই আলোচনা হয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারছে কি-না এ প্রশ্ন ওঠলে কোনো সদুত্তর মিলবে কি? শহর থেকে গ্রাম সবখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পয়োনিষ্কাশন, সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের সবগুলো স্তরের কাজ তদারকির দায়িত্ব যে মন্ত্রণালয়ের সেখানে কাজের ধীরগতি কতটা সমর্থনযোগ্য?

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে রীতিমতো কটাক্ষ করে কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কে না নামায় অর্থমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করেছেন এফবিসিসিআই সভাপতি। বলেছেন, ব্যাংক খাত পুনর্গঠনে এ ১১ মাসে উনি কী করলেন? ৫ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে সিরামিক প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘উনি কি হাইবারনেশনে (শীতনিদ্রা) ছিলেন?’ সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকের সরাসরি আশীর্বাদে মনোনীত এফবিসিসিআই সভাপতি যখন অর্থমন্ত্রীকেই তার কাজের সাফল্য নিয়ে আক্রমণ করে বসেন তখন নড়েচড়ে বসতে হয় বৈ-কি। অর্থনীতির প্রায় সব সূচক নিম্নমুখী, পত্রিকার পাতায় যখন একের পর এক এমন খবর আসতে থাকে তখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষে যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বসে আছেন তার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

ঢাকার বায়ু পৃথিবীর সব শহরের চেয়ে এখন বেশি বিষাক্ত, এমন খবরে আমরা কাকে দায়ী করব? পরিবেশ দূষণ রোধ, ঢাকার আশপাশে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ, অবৈধ পলিথিন ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার দায়িত্ব যদি বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হয় তাহলে তারা কতটুকু সফল বা ব্যর্থ সেই সালতামামি করা কি খুব অন্যায় হবে? আর এটি করতে গিয়ে যদি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা মন্ত্রীর দক্ষতা, যোগ্যতা, আন্তরিকতা নিয়ে আমরা কথা বলি তাহলে ভুলটা কোথায়? দেশের বিশিষ্ট একজন পরিবেশবিদের সঙ্গে রাজধানীর ভয়াবহ বায়ু দূষণ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন প্রসঙ্গে কথা হলে তিনি এসব প্রশ্ন ছুড়ে দেন। কোনো সদুত্তর দিতে পারি না। আমার মনের মধ্যেও তো হাজারো প্রশ্ন। উত্তর পাব কোথায়? প্রায় এক যুগ বন্ধ থাকার পর বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা এমপিওভুক্তি করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা ক্ষেত্রে তার শতভাগ কমিটমেন্ট পুনর্বার প্রমাণ করেছেন। বিস্ময়কর হলো, যেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এ প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর যাচাই বাছাই করা হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সেখানে সাইনবোর্ড সর্বস্ব অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্তি পেয়েছে। দফতর পরিচালনায় গাফিলতি, ব্যর্থতা বা ত্রুটি-বিচ্যুতি যা-ই বলি না কেন এর দায়িত্ব আসলে কে নেবেন?

রেলের কালো বিড়ালকে কি আসলেই ধরা গেছে? ফি বছর ঈদে ঢাকা থেকে বিভিন্ন শহর, গ্রামে যাওয়া-আসা নিয়ে টিকিট কেলেঙ্কারি কেন এত বছরেও ঠিক হলো না বোধগম্য নয়। দায়িত্ব নিয়ে নতুন রেলমন্ত্রী অনলাইনে টিকিট কেনাবেচার যে ঘোষণা দিলেন বাস্তবে প্রয়োগ করতে গিয়ে সেটি মুখ থুবড়ে পড়ল। বিষয়টি কাকতালীয় না-কি পরিকল্পিত সেটিও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রেলপথ সংস্কারে সরকারের বিপুল বিনিয়োগের সঠিক ব্যবহার হলে ঘন ঘন রেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ  ‘খারাপ রেললাইন’ হওয়ার কথা নয়। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষে যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব গত এক বছরে তিনি কতটা আশা জাগানিয়া কাজ দেখাতে পেরেছেন। গত এক বছরে বিদেশে শ্রম রপ্তানি আশাতীতভাবে কমে যাওয়া, নতুন বাজারগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। যদিও স্বরাষ্ট্র, পূর্ত, নৌপরিবহন, বিমান, কৃষি, ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম নিয়ে ইতিবাচক কথাই শোনা যায় কান পাতলে। আবার নতুন সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করতে না পারা, আর সারা বছর সড়ক পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলা সব মহলেই আলোচনার বিষয়।

সংবাদকর্মী হিসেবে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে নিয়মিত কথা হয়। সব মহলেই এক কথা, সরকার-প্রধান শেখ হাসিনা তার মেধা, সততা, দক্ষতা, আন্তরিকতা, শ্রম আর প্রজ্ঞায় পৃথিবীর অনেক সরকার-প্রধান থেকে এগিয়ে। কিন্তু দেশ পরিচালনায় তাকে খুব কাছ থেকে সহযোগিতা করছেন মন্ত্রিসভার যেসব সদস্য তারা কতখানি দক্ষতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন? জোরেশোরে এ প্রশ্ন সবমহলেই যে, ‘নতুনভাবে কাজ করে দেশকে এগিয়ে’ নেওয়ার সুযোগ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাদের হাতে তুলে দিয়েছেন সেই ভার সামলানোর মতো সক্ষমতা সবার রয়েছে কি-না? বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ছোট-বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নেই শুধু যে ধীরগতি তা নয় বরং সামগ্রিকভাবে সরকারের কাজে ধীরগতি এসেছে জনমনে এ ধারণা এখন প্রবল। কীভাবে এ ধারণা হলো, কারা এটি সৃষ্টি করল সেটি বড় কথা নয়। বরং সরকার আরও বেশি সক্রিয় এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডে গতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে এ ধারণাই সৃষ্টি করা জরুরি। একটি স্থিতিশীল, রাজনৈতিক অস্থিরতামুক্ত সরকারের কাজের গতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ক্ষিপ্রতা আরও বাড়বে জনগণের এ চাওয়া কি খুব বেশি প্রত্যাশা? জনগণের এ প্রত্যাশা পূরণে যদি মন্ত্রিসভায় রদবদল করতে হয় বা খোলনোলচে বদলাতে হয় নিশ্চয়ই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তা করবেন। আর যত দ্রুত সেটি করা হবে বোধকরি সেটি দেশ ও আওয়ামী লীগের জন্য ততবেশি মঙ্গল।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস২৪.কম, সাপ্তাহিক এই সময়।

সর্বশেষ খবর