বুধবার, ২০ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

চুকনগর গণহত্যা

সুমন পালিত

চুকনগর গণহত্যা

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে সংঘটিত অসংখ্য গণহত্যার মধ্যে চুকনগর গণহত্যা

অন্যতম। প্রায় ১০ হাজার মানুষ এক দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসরদের হাতে প্রাণ হারায়। চুকনগর গণহত্যায় যারা প্রাণ হারায় তার ৯০ শতাংশের বেশি ছিল সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর একটি সুপরিচিত জনপদ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ-দেশীয় অনুচরদের জিঘাংসার টার্গেটে পরিণত হয় প্রথমত আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। দ্বিতীয়ত, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্বিবাদে হত্যা করা হতো। নারীরা হতো ধর্ষণের শিকার। ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য দলে দলে ভারতে পাড়ি জমিয়ে জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করে। সে সময় ভারতে যাওয়ার ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতো চুকনগর।

প্রতিদিন শরণার্থী হওয়ার জন্য গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, বরিশাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর থেকে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমাত চুকনগরে। সেখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভারতে পাড়ি জমাত। ২০ মে, ১৯৭১। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত মানুষ অপেক্ষায় ছিল ভারতে পাড়ি দেওয়ার। জন্মভিটার মায়া ত্যাগ করে তারা সবকিছু ফেলে পালাচ্ছিল জীবন বাঁচানোর জন্য। সকাল ১০টা নাগাদ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর একটি কনভয় চুকনগরে প্রবেশ করে। তারপর নির্বিচারে চুকনগরবাসী ও ভারতে যাওয়ার জন্য অপেক্ষারত লোকজনের ওপর মেশিনগানের তপ্ত বুলেট ছুড়তে থাকে। চারদিকে লাশ আর লাশ! পাকিস্তানি বর্বরদের নৃশংস হামলায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কোলাহলমুখরিত চুকনগরে নেমে আসে কবরের নিস্তব্ধতা। কোথাও কোনো জীবিত মানুষ নেই। পাকিস্তানি জল্লাদরা যাকেই পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। সামান্য কয়েকজন পালাতে পেরেছিল ভাগ্যগুণে।

১৯৭১ সালের ২০ মের ভয়াবহ সেই গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের নানা ঘটনা উঠে এসেছে। চুকনগর অবস্থানগত দিক থেকে ছিল গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। খুলনার উত্তরে যশোর ও ফরিদপুর, পুবে ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল ও পটুয়াখালী। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। ধারেকাছের জেলাগুলো থেকে শরণার্থীরা এ পথটিকেই বেছে নিত ভারতে যাওয়ার জন্য। যাতায়াতের ক্ষেত্রে ছিল বাড়তি সুবিধা। পাশের জেলাগুলো থেকে নদীপথে সহজেই শরণার্থীরা চুকনগরে পৌঁছে যেত।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি খুলনায়ও গণহত্যা শুরু করে। ফলে হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ দলে দলে পালাতে শুরু করে ভারতে। এপ্রিলের শেষ দিকে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ-দেশীয় দালালদের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ বেড়ে যায়। ধারেকাছের জেলাগুলো থেকে ’৭১ সালের ২০ মে কিংবা তার দু-এক দিন আগে হাজার হাজার শরণার্থী চুকনগরে এসে তাদের নৌকা নোঙর করে। চুকনগর শরণার্থীদের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে- পাকিস্তানি হানাদাররা এ খবর পায় দালালদের মাধ্যমে। ২০ মে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা। শরণার্থীরা সকালের নাশতা শেষ করে ভারতে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সবাই ভাবছিল ভারতে পা দিতে পারলে আতঙ্ক থেকে রেহাই পাবে। এ সময় সাতক্ষীরা সড়ক ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দুটি সামরিক কনভয় চুকনগরের পাতখোলায় প্রবেশ করে। ঠিক তখন পুঁটিমারী বিলের পাশে নিজ বাড়ি থেকে অল্প দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন চিকন আলী নামে এক ব্যক্তি। বয়স্ক চিকন আলীকে ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা করে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। অল্প দূরে দাঁড়িয়ে থাকা চিকন আলীর ছেলে এরশাদ আলী গুলিবিদ্ধ বাবাকে ফেলে বাড়িতে চলে যায আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে। এর পরই শুরু হয় একটানা গুলির শব্দ। এ রকমই বর্ণনা দিয়েছেন চুকনগরের প্রথম শহীদ চিকন আলী মোড়লের ছেলে এরশাদ আলী। তারপর পুঁটিমারীর ঋষিপাড়ার দিগম্বরসহ আরও কয়েকজনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বর্বররা।

চুকনগর গণহত্যার শিকার যারা তার বেশির ভাগ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন। স্থানীয়দের সংখ্যা কম। গণহত্যা শেষে যারা লাশ অপসারণের দায়িত্বে ছিলেন তাদের জবানবন্দিতে বলা হয়েছে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নয়।

গণহত্যার পর মাঠঘাট, ঝোপঝাড়, জঙ্গল, ধান খেতে অসংখ্য লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। চুকনগর বাজার কমিটির সদস্য সিরাজ উদ্দীন মোড়ল, গোলাম হোসেন নুরুজ্জামান ও হায়দার নামের তিন ব্যক্তি লাশ নদীতে ফেলার জন্য লোক ঠিক করে। ঠিক করা হয় প্রতিটি লাশ নদীতে ফেলে দিলে পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া হবে ৫০ পয়সা। অর্থের বিনিময়ে সে সময় নদীতে লাশ ফেলার কাজ করেন অন্তত ৪০ জন। নদীতে লাশ ফেলানোর দায়িত্বে থাকা ওয়াজেদ আলী বলেন, দুজনে মিলে একেকটি লাশ ধরে সে সময় আমরা ভদ্রা নদীতে ফেলেছি। এভাবে ৪ হাজার লাশ আমরা গুনেছিলাম। এরপর আর গুনিনি। সত্যি কথা বলতে কি, একটি লাশ ফেললে ৫০ পয়সা দেওয়ার কথা থাকলেও লাশের গায়ে যেসব সোনা ও টাকাপয়সা আমরা সে সময় পেয়েছি সে কারণে গুনে গুনে লাশ ফেলানোর ব্যাপারে আমাদের আর কোনো ইচ্ছা ছিল না। তবে যতগুলো লাশ আমরা গুনে রেখেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণের লাশ আমরা ফেলেছি। ওয়াজেদ আলীর দেওয়া তথ্যমতে ৪ হাজার লাশ গুনে ভদ্রায় ফেলা হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী এর পরও অনেক লাশ খেতের মধ্যে, বনজঙ্গলে, বাড়ির মধ্যে পড়ে ছিল। এমনকি ভদ্রার আশপাশে তখন যাওয়া যেত না লাশপচা বিকট গন্ধে।

 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

ইমেইল :[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর