রবিবার, ২২ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

‘এত বড় দায়িত্ব নিতে হবে কোনো দিন ভাবতে পারিনি’

ওয়াহিদা আক্তার

‘এত বড় দায়িত্ব নিতে হবে কোনো দিন ভাবতে পারিনি’

১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে ফিরে এসে দলের দায়িত্ব নেওয়া প্রসঙ্গে ‘এত বড় দায়িত্ব নিতে হবে ভাবতে পারিনি’- বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার উক্তিটি দিয়ে আজকের লেখা শুরু করছি। কিছুদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করেছি। নির্বাসনের দিনগুলো নিয়ে নিজে থেকেই স্মৃতিচারণায় কথা বলতেন, মাঝখানে প্রশ্ন করে বা কোনো কথা বলে তাঁকে প্রসঙ্গচ্যুত করতাম না। লক্ষ্য করেছি লন্ডন ও দিল্লি এ দুই জায়গায় তিনি নির্বাসনের ছয় বছরের অজানা কিছু কথা বলতেন। যেন এক এক যুগের সমান দীর্ঘ ছিল এক একটি দিন। ২০১৯ সালের ৪ আগস্ট লন্ডনে প্রবাসী বাঙালি সমাবেশে তাঁর দেওয়া বক্তব্যটি ছিল অসাধারণ। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে যে সম্মান বিশ্বে অর্জিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্ট হত্যাকান্ডে বাংলাদেশ খুনি, বিশ্বাসঘাতক, ক্ষুধা ও বন্যার দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। সেই হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করেছেন চারবারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আজ বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকান্ডে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ পরিবারের ১৮ জনকে হত্যা করা হয়। প্রবাসে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ৩১ জুলাই  ছোট বোন রেহানা ও দুই সন্তান নিয়ে স্বামীর কর্মস্থল জার্মানিতে যান। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শেখ রেহানা ছিলেন বদরুন্নেছা কলেজের ছাত্রী। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে তাঁরা পৃথিবীতে রিক্ত-নিঃস্ব-অসহায়, এতিম হয়ে পড়েন। আশপাশের চেনা অনেক মানুষ হঠাৎই যেন অচেনা হয়ে যায়। স্বজন হারালে সবাই বিচার চায়; কিন্তু এ দুই বোনের বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছিল সেদিন। ইনডেমনিটি আইন দিয়ে খুনিদের বিচার বন্ধ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মদদে খুনিদের বিভিন্ন রাষ্ট্রের দূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। দেশে স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী একে একে পুনর্বাসিত হতে থাকে তখন। জার্মানি থেকে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ভারত সরকার নিয়ে যায়। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কিছুদিন পর দেখা হলে তাঁরা নিশ্চিত জানতে পারেন যে পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। এর আগে ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো রাসেল ও মা বেঁচে আছেন। পরিচয় গোপন করে তাঁদের নতুন পরিচয় হয় মিস্টার ও মিসেস তালুকদার। দুটি শিশু সন্তান নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় শোকে মুহ্যমান বঙ্গবন্ধুকন্যাদের নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে তেজস্বী বাবা-মায়ের আদরের সন্তান শেখ রেহানা ভাবলেন এভাবে আর চলতে পারে না। চাচার সঙ্গে ১৯৭৭ সালে চলে যান লন্ডন। শেখ রেহানার বিয়ে হয় পূর্বনির্ধারিত পরিবারে।

১৯৭৯ সালে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আবদুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চান। সরকারি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৯ সালের ১০ মে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত সর্বইউরোপীয় বাকশালের এক সম্মেলন থেকে প্রথমবারের মতো সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচারের দাবি তোলা হয়। সুইডেনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চেয়ে যে সভা হয় সেখানে প্রধান অতিথি শেখ হাসিনার পক্ষে শেখ রেহানা উপস্থিত হয়ে বক্তব্য পাঠ করেন। সেই হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে শেখ রেহানা কান্নায় ভেঙে পড়েন, যা গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্ব মিডিয়ায় আসে। ১৯৮০ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তায় শেখ হাসিনা লন্ডনে যান। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও তদন্তের জন্য ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করতে সক্ষম হন। আয়ারল্যান্ডের ব্রিটিশ এমপি কিউসি স্যার টমাস উইলিয়াম দায়িত্ব নেন যে বাংলাদেশে গিয়ে তদন্ত করবেন। জিয়া সরকার তখন অনুমতি দেয়নি তাঁকে বাংলাদেশে আসার। ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট ব্রিটেনের একটি হলে শোকসভার আয়োজন করা হয়। ব্রিটিশ এমপিদের নিয়ে দুই কন্যা সম্মেলন করেন দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার। শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্কুল-কলেজ জীবনে রাজনীতি করেছি। বাবা রাজনীতি করতেন, আমরা কর্মীদের মতো কাজ করতাম। মিছিল করেছি, ভোট চেয়েছি। কিন্তু এত বড় দায়িত্ব নিতে হবে- কোনো দিন ভাবিনি।’ যাঁরা সেদিন ছিলেন তাঁদের পাশে, তাঁরা অনেকে বেঁচে নেই। তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে কৃতজ্ঞতা জানান শেখ হাসিনা। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করতে চড়াই-উতরাই বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। সবাই বলেছে তিনি পিতা হত্যার প্রতিশোধ নিতে ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি আদালতের স্বাভাবিক বিচারের মাধ্যমে বিচার করেছেন। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আবার স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে দেশ চলে যায়। তারা অপরাধের বিচার না করে দেশে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়ে মন্ত্রী-উপদেষ্টা বানিয়ে ক্ষমতায় আনে এবং লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তুলে দেয় রাজাকারের হাতে।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৮১ সালের কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করে। ১৭ মে দেশে ফিরে দেখি সারি সারি কবর। একটাই দুঃখ ছিল- এ হত্যাকান্ডের বিচার না হলে দেশ অভিশাপমুক্ত হবে না। মৃত্যু সামনে নিয়ে পথ চলেছি। ভরসা ছিল আল্লাহর প্রতি, জনগণের ওপর। বাবা-মা, ভাই-হারিয়ে বাংলাদেশে যাই। বারবার হত্যার সম্মুখীন হয়েছি। যতক্ষণ বেঁচে আছি কাজ করে যাব, বাবার স্বপ্ন পূরণ করব ইনশা আল্লাহ।’

সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে জাতির জনকের দেখানো পথেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য ২১ ভাগে নেমে এসেছে। ২০৪১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ যেন উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হতে পারে সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। জাতির পিতা স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যেন অন্ন পায়, বস্ত্র পায়, উন্নত জীবন পায়; এ লক্ষ্যে তিনি সারা জীবন রাজনীতি করেছেন। জাতির পিতা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত হিসাবি ছিল। যে কোনো আন্দোলন লক্ষ্যে নিয়ে যেতে তাঁর পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনারও একটাই দায়িত্ব- তাঁর বাবার ভালোবাসার বাংলাদেশের মানুষকে উন্নত জীবন দান করা।

ভোটের অধিকার মানুষকে মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের আশ্বাস দেয়। ভোটের অধিকার নিশ্চিত হলে সে সঠিক নেতৃত্ব বেছে নিতে পারে। সঠিক নেতৃত্ব দেশ ও জনগণের কল্যাণে সরকার পরিচালনা করে, জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন হয়। মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে। এতসব আইনকানুন, সংবিধান, পরিকল্পনা, ভোটাধিকার অর্জন সবই মানুষের কল্যাণের জন্য। দেশবাসী শান্তি চায়। নিরাপত্তা চায়। জঙ্গিবাদ, বোমাবাজি, খুন, গুম, হানাহানি, সাম্প্রদায়িকতার চর্চা দেখতে চায় না। বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক ভালো আছে। ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সেদিন জীবনের পরোয়া না করে অমিত সাহসে বাংলাদেশে ফিরেছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। দেশ অভিশাপমুক্ত হয়েছে। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

একটি অনুগল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি : একজন ধনী ব্যক্তি দেখতে পেলেন এক জেলে তার মাছ ধরার নৌকায় অলস শুয়ে আছে। বিকালের উষ্ণ সোনারোদে শরীর এলিয়ে দিয়ে আরাম করছে। ধনী ব্যক্তি জেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন কেন তুমি অলস সময় কাটাচ্ছ? তুমি তো মাছ ধরতে যেতে পার। জেলে নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন, আমি আজকের দিনের জন্য যথেষ্ট মাছ পেয়েছি। ধনী ব্যক্তি বললেন, তাতে কী! তুমি তো ইচ্ছা করলে আরও মাছ ধরতে পার। জেলে বললেন, আমি অতিরিক্ত মাছ দিয়ে কী করব! তিনি বললেন, তুমি সেই মাছ বিক্রি করে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করতে পার। তোমার নৌকায় ইঞ্জিন লাগাতে পার। তখন আরও গভীর সমুদ্রে গিয়ে বেশি মাছ ধরতে পারবে। বেশি মাছ বিক্রি করে তুমি অনেক উপার্জন করতে পারবে। তখন তুমি আরও ভালো জাল কিনতে পারবে, যা দিয়ে অনেক অনেক মাছ অনায়াসে ধরতে পারবে। তুমি আরও মাছ ধরার নৌকা কিনতে পারবে এবং তোমার উপার্জন অনেক বৃদ্ধি পাবে, অনেক টাকা আয় করতে পারবে। তখন তুমি আমার মতো ধনী ব্যক্তি হতে পারবে। জেলে বললেন, তখন কী করব! ধনী ব্যক্তি বললেন, তখন তুমি সত্যিই জীবন উপভোগ করতে পারবে। পায়ের ওপর পা রেখে বসে খেতে পারবে। জেলে হেসে বললেন, আপনার কী মনে হচ্ছে? আমি এখন তাহলে কী করছি? আমি তো এখনই তা-ই করছি।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যাঁরা খুব উদ্বিগ্ন তাঁদের জন্য এটুকু বলা যায় যে, বাংলাদেশের কল্যাণের জন্য  আপনারা যা চাইছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সে কাজটিই করছেন।

                                লেখক : অতিরিক্ত সচিব।

সর্বশেষ খবর