সোমবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

একজন শহীদ এম মনসুর আলী

তানভীর শাকিল জয় এমপি

একজন শহীদ এম মনসুর আলী

সিরাজগঞ্জের মাটি ও মানুষের সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত সহচর জাতীয় নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শহীদ এম মনসুর আলীর ১০৫তম জন্মদিন ছিল গত ১৬ জানুয়ারি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর ও সহযোদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শহীদ এম মনসুর আলী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরেই যাদের ত্যাগ, অবদান ও জীবনদান উজ্জ্বল এবং ভাস্বর, তাদের মধ্যে শহীদ এম মনসুর আলী অন্যতম। তিনি তাঁর নাম ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন নিজের মনন, মেধা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে। শহীদ এম মনসুর আলীর নাম বাদ দিলে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই মহৎপ্রাণ শহীদ এম মনসুর আলী সম্পর্কে এ প্রজন্মের অনেকেরই অজানা রয়েছে। শহীদ এম মনসুর আলী সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শেষ সীমানা এবং কাজীপুর উপজেলা সীমানা লাগোয়া রতনকান্দি ইউনিয়নের সে সময়ের অজপাড়াগাঁ কুড়িপাড়া গ্রামে ১৯১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই অজপাড়াগাঁয়ের মনসুর আলী নিজের মনন, মেধা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেছেন। ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত সহচর হয়ে উঠেছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধে প্রকৃতির একজন মানুষ। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী সিরাজগঞ্জ-১ কাজীপুর সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী। সে সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ বিরোধী দল। দেশজুড়ে তাদের হুংকারে জনজীবনে ত্রাস সৃষ্টি হয়েছিল। সেই নির্বাচনে শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে নির্বাচনী মাঠে নামেন জাসদ নেতা এম খোশলেহাজ উদ্দিন খোকা। জাসদ নেতা নির্বাচনী মাঠে প্রতিপক্ষ হিসেবে শহীদ এম মনসুর আলীর নামে অনেক মিথ্যা প্রচার করেছিল। কিন্তু জনগণ তাদের মিথ্যাচারের জবাব দিয়েছেন ব্যালটের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তিনি হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হয়ে সফরে এসেছিলেন সিরাজগঞ্জে। তখন ভিআইপিদের জন্য সিরাজগঞ্জ শহরের বাহিরগোলা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তথা পাওয়ার হাউসের রেস্ট হাউস ছাড়া বিকল্প ছিল না। সেই রেস্ট হাউসে খোশলেহাজ উদ্দিন খোকা এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য। খোকা সাহেব দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলীর সঙ্গে এবং দরখাস্ত এগিয়ে দেন লাইসেন্স পাওয়ার জন্য। সে সময় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন এই সেই খোকা যিনি নির্বাচনে প্রতিপক্ষ হিসেবে আপনার বিরোধিতা করে মিথ্যাচার করেছিলেন। কিন্তু শহীদ এম মনসুর আলী তাদের কথায় কর্ণপাত না করে প্রতিপক্ষ জাসদ নেতাকে লাইসেন্স পাইয়ে দেওয়ার সুপারিশ করে উদারতা দেখিয়েছিলেন। এটাই ছিল দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাজ, মানবিক মানুষের দায়িত্ব। আজকের বঙ্গবন্ধু সেতু দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের যে যোগাযোগের নবদিগন্তের সূচনা হয়েছে, সেই বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের প্রস্তাবক ছিলেন শহীদ এম মনসুর আলী। ১৯৭৩ সালে সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজে আওয়ামী লীগের বিশাল নির্বাচনী সভায় প্রধান অতিথি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে অনগ্রসর ও অবহেলিত উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের দাবি করেছিলেন। তাঁর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের শহীদ এম মনসুর আলীকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে যমুনায় সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটি হচ্ছে শহীদ এম মনসুর আলীর উন্নয়ন চিন্তা।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, প্রবাসী সরকারের অর্থমন্ত্রী শহীদ এম মনসুর আলীর নামের আগে কী করে শহীদ শব্দ যোগ হলো, কীভাবে ক্যাপ্টেন শব্দ সংযোজন হলো তা এ প্রজন্মের মানুষের জানা দরকার। এম মনসুর আলী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড (পিএনজি) ক্যাপ্টেন পদে অধিষ্ঠিত হয়ে যশোর সেনানিবাসে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেই থেকে তিনি ক্যাপ্টেন পদবি লাভ করেন এবং তাঁর নামের সঙ্গে ক্যাপ্টেন পদবি যোগ হয়। তিনি রাজনীতির মাঠে হয়ে ওঠেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। আর শহীদ শব্দটি যোগ হয় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ইতিহাসের নিষ্ঠুর এবং জঘন্যতম ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি থাকা তৎকালীন দেশের প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এম মনসুর আলী ছিলেন পাবনার বাড়িতে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসঘাতকদের হাতে ১৫ আগস্টে সপরিবারে নিহত হন। ছেলে মোহাম্মদ নাসিমের টেলিফোনে এ খবর জানতে পারেন। এরপর মনসুর আলী আবার ঢাকায় আসেন। ‘মীরজাফর’ খন্দকার মোশতাক আহমেদের অবৈধ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করায় মনসুর আলীসহ বঙ্গবন্ধুর চার বিশ্বস্ত অনুসারীকে আটক করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে ঘটে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড। জেলখানার ভিতরে নৃশংসভাবে খুন করা হয় জাতীয় চার নেতা এম মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। এ বিষয়ে আমার বাবা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এমপি বলেন, ‘শহীদ এম মনসুর আলী আমার পিতা, আমার অহংকার। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ও আমার জীবনের বড় পরিচয় আমার পিতা শহীদ এম মনসুর আলী। আমি আমার পিতাকে হারিয়েছি এর চেয়ে বড় বেদনা আর এর চেয়ে বড় কষ্ট আমার জীবনে কিছু নেই।’

লেখক : সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ও এম মনসুর আলীর দৌহিত্র

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর