শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

চালকদের মাদকমুক্ত রাখা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে

বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী

চালকদের মাদকমুক্ত রাখা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে

গত এক দশকে বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা অভূতপূর্ব উন্নতি লাভ করেছে। সরকার দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করেছে। ফলে, দেশে বেশ কিছু প্রশস্ত সড়ক, মহাসড়ক ও সেতু বিশ্বমান বজায় রেখে নির্মিত হয়েছে।  এ ছাড়া পুরনো অনেক সড়ক ও মহাসড়ক সম্প্রসারণ করা হয়েছে এবং কিছুর কাজ চলমান রয়েছে।  মহাসড়কের মধ্যে ২০১৬ সালে গৃহীত ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেনের মহাসড়ক অন্যতম। সেতুর মধ্যে অবশ্যই পদ্মা সেতুর কথা সবার আগে বলতে হয়। এ সেতু নির্মাণে সংশয় দেখা দিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বে সরকার নিজ দেশের জনগণের অর্থে এই সেতু নির্মাণ করেছে। এটি একটি দুঃসাহসিক ও সফল কাজ। এ ছাড়া আরও অনেক সেতু ও প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ এবং মেরামতের মাধ্যমে সারা দেশের সড়ক যাতায়াত ব্যবস্থাকে দ্রুতগতি সম্পন্ন করেছে। এটি সর্বজন স্বীকৃত যে, সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক যাতায়াতে সরকার ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে এবং জনগণ এর সুফল পেয়েছে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি বাস্তবতার নিরিখে দেখা প্রয়োজন। আধুনিক সড়ক ও সেতু হয়েছে, তবে সড়ক দুর্ঘটনাও কমছে না। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে অকাল পঙ্গুত্ব ও মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলছে। এটা ভালো কথা নয়। সড়কে মৃত্যু না কমে আরও বেড়েই চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিষয়টি সবারই আরও গভীর মনোযোগের দাবি রাখে। করোনা মহামারির সময়েও সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। সরকারি হিসাব মতে, ২০২১ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ।

বিআরটিএর হিসাবে প্রতিদিন সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০ জন প্রাণ হারান। সে হিসাবে বছরে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার ৮০০ জন। তবে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বিষয়ে বিন্ডাব্যাংক এক প্রতিবেদনে বলছে, এ সংখ্যা ১২ হাজার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ২০ হাজার। বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছেন। এসব কারণের মধ্যে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং, জরাজীর্ণ সড়ক, অযোগ্য যানবাহন, অদক্ষ চালক, গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন বা হেডফোন ব্যবহার এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব অন্যতম। এ ছাড়া আরও কিছু কারণের কথা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে জানা যায়। চালকদের দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানো ও ট্রিপকেন্দ্রিক গাড়ি চালানোর বিষয়টিও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।

আমি গত ৪০ বছর দেশে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। তন্মধ্যে, মাদক ও ধূমপানবিরোধী কার্যক্রম অন্যতম। আমি মনে করি, মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাদক ও তামাকের নেশা শুধু মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নানাবিধ সমস্যা তৈরি করে। সামাজিক কাজে যুক্ত থাকার সুবাদে দেখেছি, মাদক ও ধূমপানের নেশা যানবাহন চালকদের মনস্তত্ত্বে প্রভাব ফলে। 

মাদকের সঙ্গে ধূমপান ও তামাকের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বলা যায়, এ বিষয়টি সর্বস্তরেই পরিষ্কার। ধূমপান ও তামাকে আসক্ত ড্রাইভারদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা গেছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে, গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ হওয়ায় যাত্রী সাধারণ বর্তমানে বাসের ভিতরে ধূমপান করেন না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস ছাড়া অধিকাংশ সিটি সার্ভিস ও আন্তনগর বাসে প্রায়শই চালক ও তাদের সহকারীদের ধূমপান করতে দেখা যায়। আমি ঢাকায় বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত গাড়িতে করে যাতায়াতের সময় লক্ষ্য করি, বাসে চালকদের অনেকের হাতে সিগারেট থাকে। বাসে ধূমপান করার বিষয়টি একেবারেই অনৈতিক। এতে অনেকগুলো আইনের লঙ্ঘন হয়। যাত্রী সাধারণ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। বিশেষ করে, বাসে নারী ও শিশুরা যেখানে বসে তার পাশেই চালক ও সহকারীরা ধূমপান করে। এতে শিশু ও নারীরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়।

তার চেয়েও বড় কথা, চলন্ত গাড়িতে সিগারেট ধরানোর জন্য দুই হাতের ব্যবহার করতে হয়। অল্প সময়ের মনোযোগে এই বিচ্যুতি দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। এ ছাড়া সিগারেটটি জ্বালানোর পর একহাতে যখন সিগারেট থাকে, বারবার সিগারেটকে ঠোঁটের কাছে নিতে হয়। জ্বানালা দিয়ে মুখ বের করে ধোঁয়া ছাড়তে দেখা যায়। তখন স্বাভাবিকভাবেই নেশার দিকে মনোযোগ যায়। এটিও দুর্ঘটনার ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে। চালকদের আচরণগত এ সমস্যা সার্বিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনাকে প্রকট করে তুলছে। অর্থাৎ চালকদের মধ্যে মাদকদ্রব্য ও অন্যান্য ক্ষতিকর নেশাজাত দ্রব্য সেবনকে সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির পেছনে গুরুতর কারণ হিসেবে দেখছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্য-মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, দেশে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ। বিশেষ করে, বাসের মতো গণপরিবহন শতভাগ ধূমপানমুক্ত। এ ছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট করপোরেশন সড়ক পরিবহন বিধিমালা ২০২২ অনুমোদিত হয়েছে। এই বিধিমালার তফসিল-২ ও ৩-এ গণপরিবহনের চালক, কন্ডাক্টর ও সুপারভাইজারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অংশে ধূমপান এবং অ্যালকোহল বা অন্য কোনো মাদকের নেশা থেকে বিরত থাকার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছে। এটি বিআরটির অন্যতম একটি ভালো সিদ্ধান্ত। এখন সিদ্ধান্তের কার্যকর বাস্তবায়ন করাটা জরুরি।

‘বেপরোয়া ড্রাইভিং’ বাংলাদেশে সড়কে প্রাণহানির প্রধান কারণ এবং এই বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের জন্য প্রধানত মাদকাসক্তিকে দায়ী করা হয়। চালকদের মধ্যে মাদকাসক্তি প্রতিরোধে ডোপ টেস্টের উদ্যোগ নিয়েছে বিআরটিএ। এমনকি ড্রাইভিং লাইসেন্স নবায়ন করতে গেলেও লাগবে ডোপ টেস্ট। ৩০ জানুয়ারি ২০২২ থেকে ডোপ টেস্ট ছাড়া কোনো পেশাদার চালককে আর লাইসেন্স না দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং সময়োপযোগী একটি উদ্যোগ। ডোপ টেস্ট সারা দেশে সব পর্যায়ের সরকারি হাসপাতাল এবং ঢাকা মহানগরীর ক্ষেত্রে ছয়টি প্রতিষ্ঠানে (ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল) করা যাবে বলে বিআরটিএ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল। ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চালকদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করার যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন; সেটার একটি ধাপ বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে তা ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট হাসপাতালগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি, লোকবল সংকটসহ অনেকগুলো সীমাবদ্ধতা আছে। সীমাবদ্ধতা আছে পুলিশ বাহিনীতেও। বিশেষ করে-শনাক্তকরণ মেশিন না থাকায় পুলিশ মাদক সেবনকারীদের শনাক্ত করতে পারে না। এ ছাড়া শনাক্তকরণ কার্যক্রম পরিচালনায় পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ জনবল নেই।

মাদকাসক্ত চালকদের শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ সড়ক যাত্রীর জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি চালকের জন্য প্রয়োজন। সড়কে যত্রতত্র রাস্তা পারাপারের বিষয়টি বন্ধ করতে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সঠিক ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীও অত্যন্ত আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। এ বিষয়ে সংসদে আইন পাস হয়েছে। এখন সেটার যথার্থ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

Email: [email protected]

সর্বশেষ খবর