১. অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি রাষ্ট্র-সংস্কারের লক্ষ্যে কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে, তার মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্যতম। সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠিত হওয়ার পর বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, ‘সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণেই কার্যত বাংলাদেশের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ এক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ব্যক্তিগতভাবে এ অনুচ্ছেদের সংস্কারও চেয়েছেন তিনি।’ তার এ বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ১৯৭২ সালের সংবিধানের নেপথ্যে রয়েছে হাজারো বছরের বাঙালি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা, সংগ্রাম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রথা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক মূল্যবোধ। সংস্কারের প্রশ্নে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
২. সংবিধান প্রণেতার সামনে কিছু প্রশ্ন ছিল যা আপাত বিবেচনায় সহজ মনে হলেও তা ছিল গুরুতর। শাসনব্যবস্থায় পার্লামেন্টারি বা প্রেসিডেনসিয়াল সিস্টেমের মধ্যে কোনটি গ্রহণীয় হবে? ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ গৃহীত হয় এবং ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগরে পঠিত, উক্ত ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতি সর্বপ্রকার নির্বাহী, প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতায় অধিকারী এবং একই সঙ্গে তিনি ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। দ্ব্যর্থহীন ঘোষণায় বলা হয়, রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অবর্তমানে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের মৃত্যু-কারাগার থেকে স্বদেশে ফিরে এলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। স্বাধীন বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থার মৌলিক প্রশ্ন ছিল কোন পদ্ধতির সরকার হবে। রাষ্ট্রপতি শাসিত বা সংসদীয় গণতন্ত্র। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ’ জারি করেন। আদেশে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন একজন পরিষদ সদস্যকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করবেন। রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তিত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
৩. ওই আদেশ জারির আলোকে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত সংবিধান প্রণয়ন কমিটি কর্তৃক ৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধানে সংযোজিত হয়। ৭০ অনুচ্ছেদের বিরুদ্ধে আবদুল মুনতাকীম চৌধুরী, আসাদুজ্জামান খান, মোশারফ হোসেন আখন্দ ও হাফেজ হাবীবুর রহমান এই চারজন আওয়ামী লীগ সদস্য এর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘যদি কোনো সংসদ-সদস্য দল থেকে পদত্যাগ অথবা বহিষ্কৃত হন, তবে তিনি সদস্য পদ হারাবেন।’ তারা এই অনুচ্ছেদকে অগণতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, এতে ভোটারদের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে।
৪. তারা বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ থাকলে দলীয় কোন্দল ও রেষারেষি বৃদ্ধি পাবে এবং সংসদ সদস্যগণ দলীয় কর্মকর্তাদের বংশবদে পরিণত হবেন। আবদুল মুনতাকীম চৌধুরী সুপারিশ করেন যে, যদি কোনো সদস্য সংসদে তার দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেন, শুধু তবেই তার সদস্য পদ বাতিল হওয়া উচিত। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কেন সংযোজন করা হয়েছিল তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ঘটনাবলি তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই অনুচ্ছেদ না থাকলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকবে। সংসদীয় গণতন্ত্রচর্চা, সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশ, স্থিতিশীল সরকার গঠন ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হবে।’ এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ইতিহাস।’ সেই চক্রান্তের ধারায় তৎকালীন সময়ে রাজনীতিকে কীভাবে অস্থিতিশীল ও কলুষিত করেছিল তার কলঙ্কময় অধ্যায় আজও ইতিহাসে বিধৃত। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করলে সেই বিজয় ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের শিকারে পরিণত হয়। জনগণের বিপুল আশা-আকাক্সক্ষা ও রায় ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থে ছিনতাই হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্রে আদমজী পাটকলে দাঙ্গার অজুহাতে ৩০ মে হক মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় শাসন জারি হয়। কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্রের ফাঁদে যুক্তফ্রন্ট বিভক্ত হয়ে পড়ে। ’৫৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইন পরিষদে হক সাহেবের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের নোটিস দিলে ৩৫ জন আওয়ামী লীগ সদস্যকে ক্ষমতাসীন সরকার ভাগিয়ে নিতে সমর্থ হয়। এমনকি লোভ-প্রলোভনে ১৯ জন সদস্য আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে হক সাহেবের কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগদান করেন। দলবদলের পালায় ৩৪ ঘণ্টার মধ্যেই মন্ত্রিসভা ও সরকার পরিবর্তনের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। সংসদ সদস্য ‘হর্স ট্রেডিং’য়ে পরিণত হয়। রাতারাতি দলবদলের ফলে স্থিতিশীল সরকার গঠিত হতে পারেনি। পরিষদের ভিতরেই তাৎক্ষণিকভাবে পরিষদ সদস্যবৃন্দ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেয়। পরিষদ সদসদের কেনাবেচার সুযোগ থাকায় গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি তার সুযোগ গ্রহণ করে। সরকার গঠন, রাতারাতি সরকার পতন, স্পিকার শাহেদ আলীকে ষড়যন্ত্রকারীদের আঘাত ও তার মৃত্যুর কারণ দেখিয়ে সামরিক শাসন জারি, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের একনায়কতান্ত্রিক শাসন ও শোষণ এসব তিক্ত অতীত পরিস্থিতি ও বাঙালি মানসিকতা বিবেচনায় রেখেই সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে দলবদলের খেলা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
৫. ৭০ অনুচ্ছেদে ‘রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোটদানের কারণে আসন শূন্য হবে বলে বলা হয়েছে।’ প্রতিবেশী দেশ ভারতের পার্লামেন্টের সদস্যরা পার্টি থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর সেই পার্টির বিরুদ্ধে ভোট দিলে তিনি পদত্যাগ করেন। এই অনুচ্ছেদ না থাকলে সংসদ হবে সদস্যদের কেনাবেচার হাট। সংবিধান কমিটির সদস্য সিরাজুল হক বলেন, আবু হোসেন সরকারের আমলে সকালে এক সরকার, বিকালে ফ্লোর ক্রসিং করে অন্য সরকার। এক সপ্তাহে তিনবার সরকার গঠন ও সরকার পতন।
৬. ৭০ অনুচ্ছেদের বিপক্ষে যুক্তি : সংবিধানে স্বাক্ষর করার আগে হাফেজ হাবীবুর রহমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে নিজের আপত্তি বা ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে কিছু সংশোধনী প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, দলে শৃঙ্খলা রক্ষার নামে ফ্লোর ক্রসিং ঠেকাতে এই বিধান যুক্ত করা হয়। গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোথাও কোনো রাজনৈতিক দল থেকে বহিষ্কারের কারণে সংসদের সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায় না। সংসদ সদস্য পদের এ ধরনের অবসান কেবল একটি স্বৈরাচারী শাসনে পাওয়া যায়, যেখানে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বিরাজ করে। একজন সংসদ সদস্য ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হন, দলের সদস্যদের দ্বারা নন। একবার নির্বাচিত হলে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য হন এবং তখন তিনি কেবল তার রাজনৈতিক দলের সদস্য থাকেন না। সদস্য পদ বাতিলের এ ধরনের ব্যবস্থার ফলে দলীয় একনায়কত্ব এবং দলের নেতার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। হাফেজ হাবীবুর রহমানের মতে, কোনো দলের কখনোই জনগণের রায় অর্থাৎ নির্বাচন বাতিল করার অধিকার থাকতে পারে না। কোনো অবস্থাতেই দল কর্তৃক বহিষ্কারের ভিত্তিতে সদস্য পদ বাতিলের মতো জঘন্য ব্যবস্থা থাকতে পারে না। এ ধরনের ব্যবস্থা বহাল থাকলে দলীয়ভাবে হেনস্তার শিকার হওয়ার ভয়ে সদস্যরা সংসদীয় দলের বৈঠকেও দলের মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাবেন না। অধিকন্তু, আমাদের দেশে সংসদীয় নেতা ও দলীয় নেতাদের আন্তসম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়মরীতি বা প্রথা গড়ে ওঠেনি। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে একজন দলীয় নেতা ও সংসদীয় নেতা আধিপত্য বিস্তারের জন্য একে অপরের সঙ্গে লড়াই করতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের বা সমর্থকদের দল থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে অথবা শুধু প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এবং সেখানে দলীয় নেতার প্রিয়ভাজনকে স্থলাভিষিক্ত করতে বহিষ্কারের হুমকি দেওয়া হতে পারে। সুতরাং দল কর্তৃক বহিষ্কারের কারণে সংসদ সদস্য পদ বাতিলের এমন একটি বিধান একটি দলের মধ্যেও অনেক দ্বন্দ্ব ও অচলাবস্থার জন্ম দেবে। দলীয় শৃঙ্খলা এবং নির্বাচনি এলাকা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা সবসময় একই নয় এবং কখনো কখনো তা সাংঘর্ষিক হতে পারে।
৭. স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৩ বছর পর সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলে অনেকে ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করার কথা উত্থাপন করেছেন। কিন্তু এর ফলে বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রের অবস্থা কী দাঁড়াবে তা বিবেচনায় নিতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশের নীতিহীন, আদর্শহীন, ব্যাংক লুটেরা, কালো টাকা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তবর্গের কব্জায় সংসদ সদস্য পদ চলে যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে ৭০ অনুচ্ছেদ বর্তমান অবস্থা তুলে দিলে রাতারাতি সরকার বদলের তেলেসমাতিতে পরিণত হবে কি না তা যেমন ভেবে দেখতে হবে তেমনি ৭০ অনুচ্ছেদ বহাল থাকার ফলে দলীয় কর্তৃত্ব, সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব পালন বা জনগণের স্বার্থে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে তাও বিবেচনায় নিতে হবে।
৮. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দিলে ‘হর্স ট্রেডিংয়ের’ সম্ভাবনা উন্মুক্ত থাকে। বরং এই অনুচ্ছেদ সংশোধন করে এর সঙ্গে যুক্ত করা যেতে পারে, যে দলের যে কোনো সদস্যই সংসদে মুক্ত আলোচনা করবেন, আত্মসমালোচনা করবেন, আত্মজিজ্ঞাসা ও জনস্বার্থের কল্যাণে বিবেকী তাড়নায় তিনি যে দল থেকে নির্বাচিত হয়েছেন সে দলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কণ্ঠস্বর উচ্চকিত থাকবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি থাকবেন স্বাধীন। পার্লামেন্টারি পার্টি বা দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বা তার আসন শূন্য ঘোষণা করতে পারবে না। তবে অর্থবিলে দলের পক্ষে থাকবেন। সংবিধান কমিশন সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে রক্তে লিখিত ৭২-এর সাংবিধানিক দলিলটি বিশেষ গুরুত্বসহকারে সংশোধন বা পরিমার্জন করবেন এটাই মুক্তিকামী জনগণের কাম্য।
লেখক : ’৭২ সালের খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী, লেখক ও গবেষক