শনিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

তারকাদের এত প্রবাসপ্রীতি কেন?

আলাউদ্দীন মাজিদ

তারকাদের এত প্রবাসপ্রীতি কেন?

এবার প্রবাসী হওয়ার তালিকায় নাম লেখাচ্ছেন অভিনেতা শাকিব খান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব পেতে ইতিমধ্যেই আবেদন করেছেন বলেও জানা গেছে। যদিও তাঁর পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। আবেদন করার কারণে তাঁকে ৬ মাস সেখানে থাকতে হবে। জানা গেছে, একজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নেপালি আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন করেছেন শাকিব খান। এর আগে নব্বই দশক থেকে বহু তারকা দেশ ছেড়েছেন। বিদেশে হয়েছেন থিতু। সাধারণ দর্শক এবং চলচ্চিত্র জগতের অনেকের প্রশ্ন- এসব তারকা শোবিজ জগৎ থেকে আয় করেই শূন্য থেকে পূর্ণতা পেয়েছেন। তারপরও একসময় দেশ এবং শোবিজ জগৎকে পাশ কাটিয়ে কিসের মোহে প্রবাসী হন? এসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন বেশ কজন সিনিয়র চলচ্চিত্রকার। খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘যাঁদের অভিনয়ে গুরুত্ব কমে গেছে কিংবা বয়স হয়েছে তাঁরা যদি দেশান্তরী হন তাতে তো কোনো সমস্যা নেই। তাঁরা নিজেদের শেষ জীবনে উন্নত নাগরিক সুবিধার জন্য প্রবাসী হওয়ার বিষয়টিকে আমি ইতিবাচকই দেখি। কারণ বয়োবৃদ্ধ তারকাদের দেশে সেভাবে সুবিধা দেওয়া হয় না। আর কেউ যদি মনে করেন যে, দেশের চেয়ে বিদেশে তাঁর জন্য উন্নত জীবন অপেক্ষা করছে, তাহলে তিনি যেতে পারেন। আমার মতে অনেক তারকার মনেই শেষ জীবনে শঙ্কা তৈরি হয়। যার ফলে কেউ বয়সের কারণে আবার কেউ পরবর্তী জীবনের কথা ভেবে দেশান্তরী হচ্ছেন। এ বিষয়গুলো নিয়ে সবার ভাবা দরকার বলে আমি মনে করছি।’ আরেক প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার কাজী হায়াৎ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার ছেলে অভিনেতা কাজী মারুফও প্রবাসী হয়েছে। তার বিদেশ চলে যাওয়াটা বলতে গেলে বাধ্য হয়েই বলা যায়। কারণ তার প্রচুর জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তাকে কেউ কাজ দিত না। অথচ শাকিব খানের পরই ছিল তার অবস্থান। তাই সে কাজের খোঁজেই যুক্তরাষ্ট্র চলে যায়। এ ছাড়া অতীত থেকেই বেশ কিছু শিল্পী যাঁদের বাড়ি, গাড়ি, অর্থ প্রাচুর্য সবই এ জগৎ থেকে অর্জন হয়েছে, মানে শূন্য থেকে পূর্ণতা পেয়েছেন তাঁরা দুঃখজনকভাবে এই জগৎ আর দেশকে ফেলে বিদেশে চলে গেছেন। এখানে তো তাঁরা গার্ড, কাজের লোকসহ নানাভাবে বলতে গেলে ভিআইপি লাইফ লিড করতেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাঁদের নিজের সব কাজ নিজেকেই করতে হয়। এমন কি বাসার ময়লা নিজ হাতে নিয়েই বাইরে ফেলে আসতে হয়। শিল্পীদের বিনা কারণে প্রবাসী হওয়ার এমন মানসিকতা পরিবর্তন করা উচিত। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দেশের জন্য কিছু করা দরকার। তাঁরা কীভাবে দেশের অর্থ বিদেশ নিয়ে যাচ্ছেন তা অবশ্যই সরকারের দেখা দরকার। সরকার যদি এই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে তাহলে অহেতুক এই প্রবাসী হওয়ার প্রবণতা কমবে।’ আরেক জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা নার্গিস আকতার বলেন, ‘আসলে দীর্ঘ সময় কাজ করতে গিয়ে একসময় এসব মানুষ শান্তি খোঁজেন, জীবনযাত্রার একঘেয়েমি দূর করতে বিদেশ পাড়ি দেন। অনেকের আত্মীয়স্বজনও বিদেশে থাকেন। তাই তাঁদের মধ্যেও বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। আবার অনেকের এখানে তেমন কাজের সুযোগ থাকে না। আসলে আমাদের সরকার যদি সিনিয়র এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীদের জীবনের আর্থিক নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা করে দেন যা বিশ্বের অনেক দেশেই আছে, সেরকম কিছু করে দিলেই এসব শিল্পী আর্থিক অনিশ্চয়তার অভাব বোধ করবেন না এবং প্রবাসী হওয়ার চিন্তাও তেমনভাবে আর করবেন না। যেমন পেনশন, বাসস্থানসহ যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ। যাঁরা মোহ আর চাকচিক্যের আশায় দেশ আর শোবিজ জগৎ ছাড়েন তাঁদের কথা কিছু বলতে চাই না। কারণ বিবেক বোধ সবারই আছে বলে আমার বিশ্বাস।’ এ পর্যন্ত যেসব শিল্পী প্রবাসী হয়েছেন তার তালিকা বেশ দীর্ঘ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী হতে গিয়ে আলোচনা-সমালেচনায় আসা অভিনেতা, নির্মাতা ও নাট্যকার তৌকীর আহমেদ। তিনি আমেরিকায় স্থায়ী হন। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী অভিনেত্রী, নাট্যকার ও চিত্রশিল্পী বিপাশা হায়াতও। সেখানে তাঁদের দুই সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছেন। এ দম্পতি আমেরিকার নাগরিকত্বের জন্য চেষ্টা শুরু করেছে। ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থেকেও আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন অভিনেতা টনি ডায়েস। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করছেন। মডেল ও অভিনেত্রী মোনালিসা আমেরিকা প্রবাসীকে বিয়ে করে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকেও বিদেশে চলে যান। বর্তমানে সংসার জীবনে বিচ্ছেদ ঘটলেও এ অভিনেত্রী আমেরিকায়ই চাকরি করছেন। চিত্রনায়িকা রোমানাও ক্যারিয়ারের পড়তির দিকে আমেরিকায় চলে যান। সেখানে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। মডেল ও অভিনেত্রী নাফিজা জাহান ক্যারিয়ারে তুঙ্গে থাকাবস্থায় আমেরিকায় চলে যান। বর্তমানে বিয়ে করে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন। অভিনেত্রী রিচি সোলায়মান আমেরিকায় এক পুলিশ অফিসারকে বিয়ে করে সংসারী হন এক যুগ আগে। মডেল ও অভিনেত্রী মাহবুবা ইসলাম সুমীর অভিনয় ক্যারিয়ারে ভাটা পড়লে তিনিও আমেরিকামুখী হন। আমেরিকার নাগরিকত্ব নেন অভিনেত্রী নওশীন ও অভিনেতা হিল্লোল দম্পতি। অভিনেত্রী ও মডেল মিলা ইসলাম। প্রায় দুই দশক ধরে তিনি আমেরিকায় বসবাস করছেন। করোনাকাল শুরু হওয়ার আরও আগে অভিনেত্রী তমালিকা কর্মকার আমেরিকায় পাড়ি জমান। করোনাকালের মধ্যে আরেক মঞ্চনাটকের অভিনেত্রী বন্যা মির্জা আমেরিকায় স্থায়ী হওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছেন। বিষয়টি স্বীকার না করলেও তাঁর ঘনিষ্ঠরা বলছেন বন্যা মির্জা প্রবাসেই স্থায়ী হওয়ার চেষ্টায় আছেন। ব্যান্ডশিল্পী খালিদ সপরিবারে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন অনেক আগেই। সেখানে থেকেই সংগীত সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মডেল ও অভিনেত্রী মিম মানতাসা। তিনি আমেরিকায় স্থায়ী হচ্ছেন। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে অভিনয় ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছিলেন সত্তর দশকের অভিনেত্রী জয়শ্রী কবির। সেখানে তিনি যুক্ত আছেন শিক্ষকতা পেশায়। ১৯৯৯ সালে অভিনয় থেকে অবসর গ্রহণের পর ২০০০ সালে ঢালিউডের বিউটি কুইনখ্যাত অভিনেত্রী শাবানা চলে যান আমেরিকায়। স্বামী-সন্তান নিয়ে সেখানেই তিনি থিতু হন। অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষ ১৯৯৬ সালে হঠাৎ করেই পাড়ি জমান কলকাতায়। সেখানে চলচ্চিত্র ও যাত্রাপালায় নিয়মিত হন তিনি। থাকেন কলকাতার সল্টলেক এলাকায়। অভিনেত্রী রোজিনা নব্বই দশকের শেষের দিকে হঠাৎ করে লন্ডন প্রবাসী হন। সেখানে স্বামী- সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও প্রায়ই দেশে আসেন। অভিনেত্রী শাবনূর ২০১৩ সাল থেকে সন্তান নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায়ই স্থায়ী হন। সেখানে নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেন তিনি। মাঝে মধ্যে দেশে আসেন। অভিনেত্রী তামান্না সুইডেন প্রবাসী হয়ে সেখানকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডেন্টিস্ট হিসেবে কর্মরত হন। মডেল, নৃত্যশিল্পী, উপস্থাপিকা এবং অভিনেত্রী রিয়া। ২০১৩ সালে নিউইয়র্ক প্রবাসী ইভানকে বিয়ে করে অভিনয়ে ইতি টানেন। ইপসিতা শবনম শ্রাবন্তী পরিবারসহ বর্তমানে বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। অভিনেতা-নির্দেশক টনি ডায়েস ও তাঁর সহধর্মিণী অভিনেত্রী-নৃত্যশিল্পী প্রিয়া ডায়েস দীর্ঘদিন ধরে মেয়ে অহনাকে নিয়ে নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের হিকসভিল শহরে বসবাস করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী হয়েছেন প্রমিথিউস ব্যান্ডের সদস্য বিপ্লব। লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টারের মাধ্যমে মিডিয়ায় অভিষেক হয়েছিল আমব্রিনের। স্বামী ও মেয়ে নিয়ে টরেন্টোতে বসবাস করছেন। এদিকে, চিত্রনায়িকা শাহনূরও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন বলে একটি সূত্রে প্রকাশ। এ ছাড়া আরও যাঁরা প্রবাসী হয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন- শান্তা ইসলাম, লুৎফুন নাহার লতা, মিলা, রাখি, নিসা, হাসিন, স্বাধীন খসরু, কাজী উৎপল, লামিয়া মিমো, পিয়া বিপাশা, সিমলা, প্রিয়া আমান, রুহি, কুমকুম হাসান, শামীম শাহেদ, সোনিয়া, প্রিয়াঙ্কা অগ্নিলা, আশিকুজ্জামান টুলু  প্রমুখ।

সর্বশেষ খবর