নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে ধস নামা চলচ্চিত্রশিল্প গত বছর অনেকটা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। এতে আশায় বুক বেঁধে নবীন-প্রবীণ নির্মাতারা ব্যাপক হারে নির্মাণে আসে। প্রেক্ষাগৃহ মালিকরাও বন্ধ প্রেক্ষাগৃহ চালু করতে শুরু করে। কিন্তু চলতি বছর আবার হতাশা দেখা দিয়েছে চলচ্চিত্রাঙ্গনে। খরার কবলে পড়েছে চলচ্চিত্র। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া সিংহভাগ চলচ্চিত্রই সফল হয়নি। 'রাজত্ব' এবং 'অগি্ন'র মতো বিগ বাজেটের ছবিও আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেনি। 'অগি্ন' ছবিটি ব্যবসা করলেও, 'রাজত্ব' মুখ থুবড়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র 'সংগ্রাম', কমেডি ধাঁচের 'দবির সাহেবের সংসার' কিংবা মৌলিক ধারার 'জোনাকির আলো'ও দর্শক আনুকল্য পায়নি। এতে চলচ্চিত্রকাররা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, এর কারণ অনেক।
নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের পূর্বশর্ত হচ্ছে উন্নত চিত্রনাট্য এবং অভিনয়শিল্পী। যার অভাব এখন প্রকট। সিনিয়র চিত্রনাট্যকারদের বেশির ভাগই বেঁচে নেই। তা ছাড়া নির্মাতাদের নকল প্রবণতা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে। সীমিত বাজেট দিয়ে বলিউড বা তামিল ছবির নকল করাও যে সম্ভব নয় তাও তারা বোঝে না। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, শুধু আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে দর্শকদের আকৃষ্ট করা যাবে না, প্রয়োজন সত্যিকারের বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণ।
আমজাদ হোসেন বলেন, ভালো গল্প আর অভিনয়শিল্পীর অভাব এখন প্রকট। সঙ্গে রয়েছে নকল ছবির ছড়াছড়ি। ঘরে বসে এখন সহজেই বিদেশের ছবি দেখা যায়। বলতে গেলে এমন অনেক কারণেই আবার আমাদের চলচ্চিত্র গতি হারিয়েছে। চাষী নজরুল ইসলাম বলেন, শুধু প্রযুক্তিগত গ্লামার দিয়ে তো দর্শকমন জয় করা যাবে না। গল্প ও অভিনয়ে জোর থাকতে হবে। যা এখন নেই। এখনকার গল্প এবং শিল্পীর মধ্যে গভীরতা নেই। নির্মাতাদের মধ্যেও জ্ঞান ও গুণের অভাব রয়েছে। বোম্বে এবং তামিল ছবির নকল করতে অনেকে ব্যস্ত। কিন্তু আমাদের স্বল্প বাজেট দিয়ে তো তাদের ছবি নকলও সম্ভব নয়। দর্শক স্যাটেলাইট চ্যানেলে আসল ছবি দেখে এর তারতম্য সহজেই বুঝতে পারছে। তাই দর্শকদের বোকা ভাবা বা ধোঁকা দেওয়ার সুযোগ নেই। বুঝতে হবে আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ভিন্ন। ছবি হবে বিনোদনের জন্য।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, কয় বছর আগেও আমাদের চলচ্চিত্রে যে দুরবস্থা ছিল এখন তা কাটিয়ে ওঠা গেছে। নতুন প্রযোজনা সংস্থা, নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পী আসছে এবং তারা ভালো করছে। তাদের সময় দিতে হবে। রাতারাতি সব বদলে ফেলা সম্ভব নয়। ষাট-সত্তর বা আশির দশক থেকে এখন বিনোদনের মাধ্যম অনেক বেড়েছে। তাই পলিসি মেকারদের প্রয়োজন কীভাবে চলচ্চিত্রে পূর্ণমাত্রায় প্রাণসঞ্চার করা যায় সেই চিন্তা করা। প্রেক্ষাগৃহের উন্নয়ন ও চলচ্চিত্র নির্মাণসহ সব ক্ষেত্রে সরকার যদি ব্যাংক লোন দেয় তাহলে নিঃসন্দেহে অবস্থার উন্নয়ন হবে। তবে নিজ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি লক্ষ্য রেখে জীবনের গল্প বলতে হবে। মানে নকল নয়, আমাদের ঢংয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। স্বপন আহমেদ বলেন,এখনকার নির্মাতাদের মধ্যে নকল প্রবণতা জেঁকে বসেছে। আগে ধ্যানধারণা ছিল শিল্পমুখী। আর এখনকার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি বাণিজ্যিক। ফলে দর্শক বড়পর্দায় জীবনের প্রতিচ্ছবি আর স্বপ্নের বাস্তবায়ন না পেয়ে হতাশ হচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু এক বা দুই মাসের মধ্যে যেনতেনভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে এর মান নষ্ট হচ্ছে। এভাবে দর্শকদের বোকা বানাতে গিয়ে চলচ্চিত্রকাররা তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এ অবস্থার উন্নতি তখনই ঘটবে যখন আমরা দর্শকদের এমন জিনিস দেব যা তারা আগে পায়নি। তা ছাড়া সেন্সর বোর্ডের উদার এবং সুস্থ নির্মাণের প্রতি নির্মাতাদের দায়িত্ববান হতে হবে।