ঘর থেকে বের হলেই পিঠে যেন ডানা গজায়, সেই সাথে মন উরু উরু। যত সমস্যা থাক নিজেকে বলছি, অসুবিধা নাই, সব ঠিক আছে ( বিজি ৭০১-এর বিড়ম্বনা সত্ত্বেও)! কোনো কারণেই মন খারাপ করা চলবে না ।
এক ঘণ্টা দশ মিনিট উড়াল দিয়ে চলে এলাম ভালোলাগার শহর কাঠমুণ্ডুর ত্রিভূবন বিমানবন্দরে। জুন মাসের চল্লিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপেও প্রাণ জুড়িয়ে গেল মাউনটেন ক্লাবের মনীষাকে দেখে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে গাড়ি নিয়ে। হোটেলে না গিয়ে মনীষার পরামর্শে গাড়িতে লাগেজ নিয়েই ছুটলাম নাগরকোট হিল স্টেশন।
‘সিটি অফ টেম্পল’ বলে খ্যাত কাঠমুন্ডু শান্ত ছিমছাম শহর। শহর একপাশে রেখে আমরা উঠে যাচ্ছি পাহাড়ে, নাগরকোটে সূর্যাস্ত দেখবো। গাড়িতে এসি ছিল না, জানালা খুলে দিলাম! ভাগ্যিস ছিল না! মিষ্টি ভেজা ভেজা বুনো ঘাসপাতার গন্ধ আর ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে আসা মাথার ভিতর কেমন এক ঘোর লাগিয়ে দেয়। সারি সারি পাইন গাছ আকাশ ছোঁয়ার বাসনায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পথ ঘেঁষে পাথর ফুঁড়ে উঁকি দিচ্ছে বর্ণিল বুনোফুল।
পাহাড়ের ধাপে ধাপে বাড়িগুলি বসানো। মাত্র দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম নাগরকোটের হিমালয় ক্লাবে, সতের হাজার মাইল উপরে ।
গাড়ি থামতেই কাঁধে ব্যাগ আর হাতে ক্যামেরা নিয়ে ছুটলাম ছবি তুলতে। বেগুনি বাগানবিলাস আগে কখনো দেখি নাই। গল্পের ম্যাগনোলিয়া ফুলেরও দেখা পেলাম এখানে এসে। পাহাড় থেকে মেঘেরা যেন ভেসে ভেসে নেমে আসছে। হিমালয় ক্লাবটি সাজিয়েছে উঁচু-নিচু পাথরের বাঁকে টেরাকোটা ও ফুলের সমন্বয়ে। শিলাখণ্ড কাটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দিশেহারা আমরা কোনটা দেখব! আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘ নাকি আইভিলতায় ছেঁয়ে রাখা ক্লাবের অপরূপ দৃশ্য।
হঠাৎ খুট খুট শব্দ পেয়ে পাহাড়ের কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে দেখি ছোট একটি ঘরে ২৪/২৫ বছর বয়সী এক তরুণ কাঠের মুখোশ বানাচ্ছে। হাতের কাজের সুক্ষ্মতা দেখে মুগ্ধ। বেশির ভাগ বুদ্ধের মুখ, ছোট-বড় নানা আকারের। এছাড়া রাবণের রাগত মুখ, নারী-পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের মুখোশ। পাহাড়ে ছোটাছুটিতে খিদেও পেয়েছে। একদিকে খিদে, অন্যদিকে ড্রাইভার তাগাদা দিচ্ছে আরও দেরি করলে পাহাড়ি রাস্তায় নামতে অসুবিধা হতে পারে। পাকৌড়া আর চা খেয়ে ফিরতে হল।
আমরা কাঠমুন্ডু হোটেলে ফিরে এলাম। পরদিন পোকহারা যাব, বাসে প্রায় আট ঘণ্টা পথ।
বাসে প্রায় শ'খানেক যাত্রী। আমরা চারজনই বাঙালি। সাত/আটজন নেপালি, বাকি সবাই ইউরোপিয়ান বা আমেরিকান। আমি তৈরি দীর্ঘযাত্রার জন্য। সাথে চয়ন খায়রুল হাবিবের কবিতার বই 'রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ'। গাড়িটা যখন পাহাড়ি পথে চলতে শুরু করল বইয়ের পাতা খুলতেই চোখ পড়ল,
'তেনজিং নোরগের মূর্তিকে পিছে রেখে/ কাঞ্চনজঙ্ঘাকে সুধিয়েছিলাম কোন দিশিরে তুই...'
বাস যতই উপরে উঠছিল পাথরের পাহাড় যেন একটু একটু করে আকাশ ছুঁতে চলেছে। যেখানে বসতি আছে সেখানে দু'একটা ঘর, মিষ্টি কুমড়ার ফুল। কয়েকটা বাড়ির আঙিনায় রক্তজবার গাছ। বেশকিছু জায়গায় গাছভর্তি লিচু। আর পথের পাশের ধাবার খাবারের কথা তো বলাই বাহুল্য। সরু চিকন চালের ভাত আর সবচে' সুস্বাদু নেপালের ডাল। আরও আছে রাজমা কারি, পাপড় আর নেপালের বিখ্যাত মোমো। ধাবাগুলোর পাশেই ছোট ছোট সবজি ও ফলের দোকান। অবাক হয়ে দেখলাম ফলের দোকানে প্রচুর শুটকি মাছ ঝুলানো।
কাঠমুণ্ডু থেকে পোকহারার মাঝামাঝি পথে কারিনতার। একমাত্র ক্যাবল কার স্টেশন ৩০০ মিটার উঁচুতে। বাস থেকে কয়েকজন এখানে নেমে গেল নদী পার হয়ে ক্যাবল কারে উঠবে বলে।
তিনটায় আমরা পৌঁছে গেলাম পোকহারা বাসস্টপে। ১০/১৫ মিনিটের মাথায় এসে গেলাম মোহনীয় সৌন্দর্যের ফুলবারি রিসোর্টে। আট ঘণ্টার ক্লান্তি যেন নিমিষেই উধাও। একদিকে হিমালয় বাতায়নের প্রকৃতি, আরেকদিকে ফাইভ স্টার হোটেলের আপ্যায়ন। ঘুরতে ঘুরতে এখানেও এমনকিছু গাছ চোখে পড়লো যা আগে কখনো দেখিনি। একটা গাছের গোড়ায় বেগুনি রঙের অর্কিড দেখলাম, নাম ফক্সটেইল অর্কিড। নীল হাইড্রেনজা আর নীল কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেল। ফুলবারি রিসোর্টের সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন নিজ হাতে সাজিয়েছে। রিসোর্ট দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এলো। জনহীন বনপ্রান্তর আর ছোট ছোট ঘরগুলোতে কুপির আলোর মত জ্বলছিল নিয়নবাতি। রুম থেকে দেখতে পেলাম নক্ষত্রভরা আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে অন্নপূর্ণা পাহাড় ।
সারাদিনের ক্লান্তিতে খুব ভাল ঘুম হল আজ ।
বেশ ভোরেই বেরিয়ে পড়লাম। মাউন্টেন ক্লাবের গাড়িও নয়টার মধ্যে এসে হাজির। প্রথমেই গেলাম পোকহারার ঝর্ণা 'ডেভিস ফল' দেখতে। পার্কে ঢোকার মুখেই বাজার। সেখানে নারীদের আধিক্য। বাজারের বেশিভাগ টেবিল পাথরের মূর্তি, পুঁতির মালা, নেপালের 'ঢাকা টুপি', অসংখ্য পিতল ও কাঁসার তৈরি ছোট ছোট জীব-জন্তুর মূর্তি দিয়ে সাজানো। পার্কে ঢুকেই ঝর্ণা খুঁজে বেড়াচ্ছি। দেখি কিছু লোক নিচে নেমে যাচ্ছে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে। কিছুটা নামতেই প্রবল পানির শব্দ পেলাম। এগোতে এগোতে দেখি বিশাল অন্ধকার গুহা একপাশে কিন্তু পানির দেখা নেই। অথচ শুনতে পাচ্ছি প্রবল বেগে পানি পড়ার শব্দ। আরও কিছুদূর এগিয়ে শব্দের উৎসের দেখা পেলাম। পাথরের ভেতর থেকে প্রচণ্ড স্রোতে পানি বেরিয়ে আসছে আর সেই শব্দ গুহার গায়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। গল্প আছে, এই ঝর্ণার পানিতে এক বিদেশি দম্পতি গোসল করতে নেমে স্রোতে ভেসে গিয়েছে। তাদের আর কোনোদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই দম্পতির নামেই এই ঝর্ণার নাম ডেভিস ফল। ঝর্ণার পাশে কালো পাথরের অন্ধকার গুহার দিকে তাকিয়ে ভয়ে শিহরিত হলাম। ওখানটায় আর দাঁড়িয়ে না থেকে উপরে উঠে আসি ।
ডেভিস ফল থেকে গেলাম মাচ্ছাপুচ্ছরে পাহাড় ঘেঁষে ফেওয়া লেকে। পাহাড়টা দেখতে বিশাল এক মাছের মত। একটা নৌকা ভাড়া করা হল। লেকের মাঝখানে বারাহি মন্দির। নৌকাটা লেকের পানিতে নামতেই একটা শীতল বাতাস বয়ে গেল প্রাণের ভেতর। মেঘগুলি যেন ছোঁয়া যায়। বর্ষা বলেই হয়তো মেঘ বেশ নিচুতে। পাহাড়টা দেখতে যেন একটা বিশাল মাছ লেজ উচিয়ে সাঁতার কাটছে। এ কারণেই মনে হয় পাহাড়টার নাম মাচ্ছাপুচ্ছরে। পাহাড় ঘেঁষে বেশ কয়েকটা রিসোর্ট দেখতে পেলাম।
প্রায় আধা ঘণ্টা নৌকায় গিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম বারাহি মন্দিরে। এটা ছোটখাটো একটি শিব মন্দির। নৌকায় করে প্রচুর স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা দল বেঁধে আসছে আর চলে যাচ্ছে। মন্দিরে নব্য বিবাহিত এক কিশোর দম্পতির দেখা পেলাম। কিছুক্ষণ মন্দির চত্বরে থেকে নৌকায় ফিরে এলাম।
ফেরার পথে শপিং-এ গেলাম ঢাকার বন্ধুর ফরমায়েশ পুঁতির মালা নিতে হবে। দোকানে সব সুন্দর সুন্দর মেয়ে দিদি দিদি বলে ডাকাডাকি করছে। মনে হচ্ছিল যেন শৈশবের মেলায় এসেছি। ইয়াকের উলের শাল, স্কার্ফ নিলাম। নেপালের টুপি আর অনেকগুলি পুঁতির মালাও কেনা হয়ে গেল। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে মোমো খেলাম।
পরদিন ভোর সাড়ে ৭টায় পোকহারা থেকে রওয়ানা হয়ে কাঠমুণ্ডু ফেরত এলাম প্রায় চারটায়। হোটেলে ফিরে কিছুটা ফ্রেশ হয়ে আমরা চলে গেলাম ‘পাতান সিটি’ দেখতে। বাগমতি নদীর দক্ষিণে শত শত বছর পুরনো ‘পাতান’ কাঠমুন্ডু উপত্যকায় সবচেয়ে প্রাচীন শহর। প্রচলিত যে, রাজা অশোক তার কন্যা চারুমতিকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন। পাতানে প্রায় ছোট বড় বিভিন্ন আকারের ১২০০ বৌদ্ধ স্থাপত্য রয়েছে ।
পাতান সিটিতে পর্যটক এবং স্থানীয় লোকদের প্রচুর ভিড়। স্থাপত্য শৈলীর নিদর্শন দেখে মুগ্ধ। ঐতিহ্যবাহী কাঠের কারুশিল্প ও পাথরের খোদাই মূর্তির জন্য এই এলাকা প্রসিদ্ধ। এখান থেকে বের হয়ে আমরা চলে গেলাম স্বয়ম্ভুনাথ মন্দিরে। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব রয়েছে এই দেশে। দক্ষিণ নেপালে লুম্বিনী শহরে সিদ্ধার্থ গৌতম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রচুর বানর ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে-ওখানে। আমরা ভয়ে ভয়ে উপরে উঠছিলাম। কিন্তু দেখলাম তারা পর্যটকদের কোনোরকম বিরক্ত তো করেই না; বরং ক্যামেরায় ছবি তোলার সময় পাশে এসে দাঁড়ায়। দিনের আলো নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের চেহারাটি একেবারেই যেন বদলে গেল। চারপাশে নিয়ন বাতি জ্বলে উঠতেই মনে হলো যেন এক সোনার খনির মাঝে সোনার মন্দির গড়ে উঠেছে। দেখলাম মন্দিরের ভেতরে কীর্তনের আসর বসেছে। আমরা কিছুক্ষণ ওখানে বসে গান শুনে হোটেলে ফিরে এলাম।
পঞ্চমদিন সকালে আমরা গেলাম পশুপতিনাথ মন্দিরে। কাঠমুণ্ডু শহরে এটাই হচ্ছে সবচে' বড় মন্দির। সেই সকালেই স্কুলের ছেলে-মেয়েরা এসে মন্দির ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করছে। সঙ্গে শিক্ষক ও আছেন। সকাল থেকেই সেখানে পূজারিদের ভিড়। পাশেই শ্মশান ঘাট। ফেরার সময় দেখলাম তিনটি চিতা জ্বলছে।
এরপর এলাম রাজবাড়িতে। ক্যামেরা ও ব্যাগ জমা দিয়ে ঢুকতে হলো। একটু মন খারাপ হলো ছবি তোলা যাবে না বলে। রাজপ্রাসাদের ভেতরে ঢুকে ছবি তুলতে না পারার মনখারাপ আরও বেড়ে গেল বিষণ্ণ পরিবেশ দেখে। প্রত্যেকটি রুমের আলাদা করে নেপালী ভাষায় নাম লেখা আছে। যেমন: হলরুমের নাম 'কাসকিবৈঠক'। মনে হচ্ছিল এই চেয়ারটায় রাজা খাবার পর একটা বই নিয়ে বসতেন। ২০০১ সালের ১ জুন দুপুরে 'ধাডিং' ঘরটিতে বসে রাজা কিংবা রানী শেষ কোন বইটা পড়েছিলেন জানতে ইচ্ছা করলো। নেপালের এই নারায়ণহিতি রাজপ্রাসাদের সন্ধ্যায় ডিনার টেবিলে যে ঘটনাটা ঘটেছিল সেটা একমুহূর্ত আগেও হয়তো কেউ কল্পনা করতে পারেনি। প্রিন্স দীপেন্দ্র অতিমাত্রায় মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় সামান্য কারণে রাজা বীরেন্দ্র এবং তার পরিবারের সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলেন। প্রিন্স দীপেন্দ্র সবাইকে মেরে ফেলার পর নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। ৪ জুন তিনি মারা যান। নেপালের সাংবাদিক কৃষ্ণ ভট্টরাই প্রত্যক্ষ সাক্ষী শান্তা রানী নামে একজন আয়ার বর্ণনা থেকে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেন। বইটির নাম দেন 'রক্তকুণ্ড'।
এরিমধ্যে আমাদের এয়ারপোর্ট যাওয়ারও সময় হয়ে এলো। হোটেলে এসে লাঞ্চ সেরে ব্যাগ গুছিয়ে এয়ারপোর্ট চলে এলাম। নেপালকে বিদায় জানিয়ে মনে মনে আবারও হিমালয় কন্যার কাছে যাবো বলে বিমানে উঠে বসি।