শিরোনাম
২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৭:৩৫

কাঁধের দখল নিয়েছে ‘শোরুম’: তবুও রন্টু হাঁক ছেড়ে যান!

আব্দুর রহমান টুলু, বগুড়া

কাঁধের দখল নিয়েছে ‘শোরুম’: তবুও রন্টু হাঁক ছেড়ে যান!

ভাঁড়ে করে দই বিক্রি করছেন রন্টু ঘোষ।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটকের বর্ণনায় ‘দই দই ভালো দই!’ এমন হাঁক শুনেই নাটকের চরিত্র অমল দইওয়ালাকে তিনবার ডেকেছিল দইওআলা, দইওআলা, ও দইওআলা! অমল দইওআলার কাছ থেকে দই কিনেতে না পারলেও দইওআলার সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছিল। অমলের দূর থেকে দইওআলার হাঁক মধুর লেগেছিল।

রবীন্দ্রনাথের ডাকঘরের মত আজও বগুড়ায় টিকে আছেন দু’একজন দইওআলা। যারা কাঁধের ওপর আড়াআড়ি করে রাখা বাঁশের লাঠিতে বিশেষ কায়দায় ঝুড়ি বাঁধিয়ে তৈরি করা ভাঁড়ে করে দই বিক্রি করেন। যদিও কালের বিবর্তনে কাঁধে চাপা সেই দইয়ের ভাঁড়ের জায়গার অধিকাংশ দখলো নিয়েছে এসিঘর। টাইলস মোজাইক আর এসিময় শোরুমেই এখন বগুড়ার দইয়েরর বাজার রমরমা। তবু কালের বিপরীত স্রোতে হেঁটে বাপ দাদার পেশা ধরে রেখেছেন অল্প কিছু মানুষ। তারা সেই সনাতন নিয়মেই ভাঁড়ে করে দই বিক্রি করে যাচ্ছেন।

দইয়ের শহর বগুড়ায় স্বাধীনতার আগে ও পরে দই বিক্রি হতো ভাঁড়ে করে। বাঁশের তৈরি বিশেষ ধরণের ভাঁড় বহনকারী ভাঁড়ে দইয়ের হাঁড়ি বসিয়ে ফেরি করে দই বিক্রি হতো। পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে, ফেরি করে দই বিক্রির একটি প্রচলিত রীতি ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন অনেকাংশে কমে গেছে। ভাঁড়ে করে দই বিক্রি তেমন আর দেখা যায় না, এখন কালেভদ্রে এই দৃশ্য চোখে পড়ে। দই বিক্রেতারাও আর কাঁধে ভারী ভাঁড় তুলতে চাইছেন না। সে দিক থেকে জেলার সকল এলাকায় কম বেশি দই বিক্রির শোরুম গঁজিয়ে উঠছে।

বগুড়ার পথেই দেখা মিললো রন্টু ঘোষের। গাবতলী উপজেলার হাতীবান্ধা গ্রামের রন্টু ঘোষ এখনও ভাঁড়ে করে দই বিক্রি করছেন জেলা শহরের ভাটকান্দি এলাকায়। তিনি কয়েক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ভাঁড় নিয়ে দই বিক্রি করছেন। তার ভাঁড়ে সাজানো রয়েছে মিষ্টি দই, টক দই, সাদা দই। তিনি দই নিবেন দই বলে হেঁকে যাচ্ছেন। আর কেউ বা নিচ্ছেন আবার কেউ বা দর দাম করে যাচ্ছেন। কোথাও ভাঁড় রেখে জিরিয়ে নিচ্ছেন রন্টু। আবার দই বিক্রির জন্য ফেরি করতে রওনা হচ্ছেন।

ফেরি করে দই বিক্রেতা রন্টু ঘোষ জানান, তার দাদাও ভাঁড়ে করে ফেরি করে দই বিক্রি করেছেন। তার বাবার পর রন্টু ঘোষ ফেরি করে দই বিক্রির পেশায় নিয়োজিত। তিনি বলেন, তার পরিবারের সকলেই দুধ থেকে দই তৈরির কাজে সিদ্ধহস্ত। ভালো মানের দই বিক্রি করা তার নেশা ও পেশা। ভোক্তাদের একবার দই দিলে তারা বারবার দই নেয়। ভালো দই দিতে পারলে ক্রেতারা খুঁজে নিবে। সে কারণে ভালোমানের দই বিক্রি করেন। তিনি জানান, সাধারণত তিন প্রকার দই বিক্রি করেন। এর মধ্যে সাদা, টক ও মিষ্টি দই। মিষ্টি দইয়ের চাহিদা বেশি। মিষ্টি দই বড় হাড়ি ১৫০ টাকা, ছোট দই ৮০ টাকা করে বিক্রি করেন। সাদা ও টক দই ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করেন। রন্টু ঘোষ জানান, আগে ফেরি করেই দই বিক্রি হতো। কিন্তু এখন ফেরি করে তেমন দই বিক্রি হয় না। সবাই শোরুম করেছে। শোরুম থেকেই দই বেশি বিক্রি হয়। যাদের বাপ দাদার আমল থেকে দইয়ের ব্যবসা ছিল তাদের কেউ কেউ ফেরি করে দই বিক্রি করে থাকে। তাছাড়া এখন আর গোয়ালারা তেমন দই বিক্রি করে না। গোয়ালারা দই তৈরি করে দেন আর বড়বড় ব্যবসায়িরা টাইলস এসি শোরুম দিয়ে দই বিক্রি করছেন।

বগুড়ার প্রবীণরা জানান, দইয়ের শুরুটা হয়েছিল বগুড়া শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর উপজেলায়। কথিত আছে, উনিশ শতাব্দীর ৬০ এর দশকের দিকে গৌর গোপাল পাল নামের এক ব্যবসায়ী প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে সরার দই তৈরি করেন। তখন দই সম্পর্কে সবার ভালো ধারণা ছিলো না। গৌর গোপালের এই দই’ই ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী নবাব পরিবার ও সাতানী পরিবারের কাছে এ দই সরবরাহ করতেন গৌর গোপাল। সে সময়ে এই দইয়ের নাম ছিল নবাববাড়ীর দই। নবাবী আমলে বিশেষ খাবার ছিল এই দই। কালে কালে দিন গড়িয়ে গেলেও এখনো বিশেষ খাবার হিসেবে ধরে রেখেছে দই। বিয়ে, জন্মদিন, ঈদ, পূজা, আকিকা হালখাতা বা পারিবারিক যে কোন অনুষ্ঠানে দই বিশেষ খাবার হিসেবে পরিবেশিত হয়ে থাকে।

বগুড়ায় খাবার হিসেবে দইয়ের প্রচলন বেশি হওয়ায় জেলা শহরের আনাকে কানাচে দইয়ের শোরুম গড়ে উঠেছে। হিসেব কষলে ১২ উপজেলায় প্রায় দুই সহস্রাধিক দইয়ের শোরুম রয়েছে। এসব শোর রুম থেকে প্রতিদিনিই দই বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে বর্তমানে সুনাম ছড়িয়েছে বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কের আকবরিয়া লিমিটেড, এশিয়া সুইট মিট ও দই ঘর, নবাববাড়ীর রুচিতা, বিআরটিসি মার্কেটের দইবাজার, মিষ্টিমহল, মহরম আলী, শ্যামলী, এনাম দই ঘর, শেরপুর দই ঘর, চিনিপাতা, বাঘোপাড়ার রফাত দই ঘর, শেরপুরের রিপন দধি ভান্ডার, সাউদিয়া, জলযোগ, শম্পা, বৈকালী ও শুভ দধি ভান্ডার থেকে প্রতিদিন প্রচুর দই বিক্রি হয়।
 
বগুড়ার আকবরিয়া লিমেটেডের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল জানান, আধুনিকভাবে শোরুম গড়া হয়েছে। দই বিক্রি হয় প্রতি পিছ হিসেবে। দই তৈরির যাবতীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে দিগুণ এ কারণে দইয়ের দামও বেড়েছে। তাদের শো রুমে বিভিন্ন স্বাদের দই পাওয়া যায়। মিষ্টি দইয়ের পাশাপাশি বিক্রি হয় টক বা সাদা দই। বিভিন্ন ব্রান্ডের দই পাওয়া যায়। যার প্রতি পাতিল বিক্রি হয় ৩৫ টাকা থেকে ৩০০ টাকায়। ছোট বড় বিভিন্ন আকৃতির মাটির পাত্রে দই ভরানো হয়। 
 
বগুড়া দই ঘরের মালিক আলহাজ এনামুল কবির জানান, প্রতিযোগিতার এই বাজারে দইয়ের মান টিকে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাজারে নিম্নানের দই’এর ভিড়ে বেশি দামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি নিয়ে হয় ঝুট ঝামেলা। আবার দাম কমিয়ে দই’এর গুণগত মান ঠিক রাখাও যায় না।


বিডি প্রতিদিন/নাজমুল

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর