বুধবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
দক্ষিণের প্রার্থীদের হলফনামা

সম্পদের পাহাড়ে কাউন্সিলর প্রার্থীরা

অনেকেই পেরোননি স্কুলের গণ্ডি, ক্যাসিনো সাঈদ স্বশিক্ষিত, মামলা বেশি বিএনপি প্রার্থীদের

গোলাম রাব্বানী

সম্পদের পাহাড়ে কাউন্সিলর প্রার্থীরা

ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির সমর্থন পাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীরা অঢেল সম্পদের মালিক। আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে রয়েছে দখল-চাঁদাবাজির অভিযোগও। অনেকের বিরুদ্ধে আগে মামলা থাকলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিগত নির্বাচনে কাউন্সিলর হওয়ার পর পাল্টে গেছে অনেকের সম্পদের চিত্র। বার্ষিক আয়ের পাশাপাশি স্থাবর-অস্থাবর সম্পদও বেড়েছে হু হু করে। এর মধ্যে অনেক প্রার্থী কোটিপতি। আবার অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতাও তেমন নেই। স্বশিক্ষিতও রয়েছেন অনেকে। বাস্তবে দামি দামি গাড়ি ব্যবহার করলেও হলফনামায় গাড়ি-বাড়ির হিসাব নেই অনেক প্রার্থীর। আবার অনেক প্রার্থীর ঋণ রয়েছে। স্ত্রীর নামেও রয়েছে সম্পদের পাহাড়। দক্ষিণের প্রার্থীদের জমা দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তবে দক্ষিণের হলফনামা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলেও উত্তরের কাউন্সিলর প্রার্থীদের হলফনামা ইসি এখনো প্রকাশ করেনি। আবারও ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন স্বশিক্ষিত মমিনুল হক সাঈদ। ক্যাসিনোকান্ডের অন্যতম পুরোধা সাঈদ ২৭ ডিসেম্বর দেশে ফিরেছেন। এবার তিনি দক্ষিণের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী হয়েছেন। তার নামে দুদকের মামলা চলমান রয়েছে। এই প্রার্থীর হলফনামার প্রথম পাতা ইসির ওয়েবসাইটে নেই। এর আগের নির্বাচনে তিনি নিজেকে স্বশিক্ষিত হিসেবে দাবি করেছিলেন। পেশা ব্যবসা। ২০১৫ সালে সিটি নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় সাঈদ উল্লেখ করেছিলেন, মেসার্স বৈশাখী এন্টারপ্রাইজ নামে তার ঠিকাদারি ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখান থেকে তার বার্ষিক আয় ১৮ লাখ ৬৮ হাজার ৯৭৬ টাকা। এর বাইরে তার নগদ ৫ লাখ ৫ হাজার ৬৯৭ টাকা আছে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক পণ্য, আসবাব ও প্রাইজ বন্ড রয়েছে ৫ লাখ টাকার। আর মূলধন ১ কোটি ২ লাখ ৯৭ হাজার ৯০১ টাকা। এবারের হলফনামায় তিনি বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৩১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। এর আগের নির্বাচনে হলফনামায় ব্যাংকে জমা না থাকলেও এবারে জমা রয়েছে ৩৪ লাখ ৩৪ হাজার ৩৩৭ টাকা। এবার মূলধন দেখিয়েছেন ১ কোটি ৩৭ লাখ ৫২ হাজার ১৮৮ টাকা। প্রাইজ বন্ড রয়েছে ২ লাখ টাকার। নিজের নামে কোনো গাড়ি-বাড়ি নেই। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে জানা যায়, মোহামেডান স্পোর্টিং ও আরামবাগ ক্লাবে তিনি ক্যাসিনো চালু করে বিপুল টাকা অবৈধভাবে অর্জন করেছেন।

দক্ষিণের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মোহাম্মদ আনিসুর রহমান। পেশায় তিনি ব্যবসায়ী। তিনি বর্তমান কাউন্সিলর। তার বার্ষিক আয় বেড়েছে। বিগত নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় বার্ষিক আয় ছিল ৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এবারের হলফনামায় তিনি বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ ছাড়া বেড়েছে স্থাবর সম্পদের পরিমাণও। বিগত নির্র্বাচনের সময় তার ৩৪ লাখ ১২ হাজার টাকা দামের অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। কিন্তু বর্তমানে তার ৬০ লাখ ৭৭ হাজার টাকা দামের অ্যাপার্টমেন্ট ও ১৭ লাখ ৭৮ হাজার টাকার অকৃষি জমি রয়েছে। এ ছাড়া এখন তার হাতে নগদ টাকা রয়েছে ৭ লাখ ৫০ হাজার। বিগত নির্বাচনের আগেও তার কাছে নগদ ৭ লাখ টাকা ছিল। কিন্তু তা ব্যাংক ঋণ থেকে পাওয়া বলে উল্লেখ ছিল। এবারের নগদ টাকা ব্যাংক ঋণের কিনা তার উল্লেখ নেই। তার বিরুদ্ধে দখল-চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে। বিগত নির্বাচনের হলফনামায় আগের ফৌজদারি মামলার তথ্য দিলেও এবারে কোনো মামলার তথ্য দেননি। আগের সব মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করার তথ্য তিনি বিগত নির্বাচনী হলফনামায় দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের এই বিতর্কিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিগত নির্বাচনে কাউন্সিলর হওয়ার পরই তিনি পূর্ব গোড়ান ঝিলের ছয় বিঘা জমি দখলে নিয়ে প্লট আকারে বিক্রি করে দেন। এ ছাড়া নিজস্ব ‘আনিস বাহিনী’ রয়েছে তার। এই বাহিনী চাঁদা না দিলে বন্ধ করে দেয় নির্মাণকাজ।

দক্ষিণের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন আশ্রাফুজ্জামান ফরিদ। তিনি বর্তমান কাউন্সিলর। তিনি এইচএসসি পাস। পেশা তার ব্যবসা। তার বিরুদ্ধে এর আগে তিনটি মামলা ছিল। এবারে তার বার্ষিক আয়ও বেড়েছে। বিগত নির্বাচনের হলফনামায় তার ব্যবসা থেকে বার্ষিক আয় ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বর্তমানে তার বার্ষিক আয় ২৫ লাখ ৪৬ হাজার ২৪০ টাকা (ব্যবসার পুঁজি)। এ ছাড়া এবার তার ওপর নির্ভরশীলদের আয় হচ্ছে ৪৩ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা। বিগত নির্বাচনের আগে নির্ভরশীলদের কোনো আয় ছিল না। এ ছাড়া তার নামে গাড়ি-বাড়ি কিছু নেই। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তার সহযোগীরা সবাই বিএনপির নেতা-কর্মী। ডিস ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে পুরো এলাকা তার নিয়ন্ত্রণে।

২০ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন ফরিদউদ্দিন রতন। তিনি নিজেকে স্বশিক্ষিত দাবি করেছেন। পেশায় তিনি ঠিকাদার। বিগত নির্বাচনের হলফনামায় তার বার্ষিক আয় ছিল ৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এবারে আয় দেখিয়েছেন ৬ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। তার কাছে নগদ টাকা রয়েছে ৬ লাখ ৩০ হাজার। এর আগের বারও তার নগদ টাকা ছিল ৬ লাখ ৩০ হাজার। তার স্ত্রীর নামে আগে ছিল ৫৭ লাখ ২১ হাজার। এবারও তার স্ত্রীর নামে নগদ টাকা রয়েছে ৫৭ লাখ ২১ হাজার টাকা। বিজয়নগরে নিজের নামে রয়েছে ফ্ল্যাট। স্ত্রীর নামে কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। তার সঙ্গে ক্যাসিনোকান্ডের হোতাদের সম্পর্ক রয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

২৬ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন হাসিবুর রহমান মানিক। তিনি বর্তমান কাউন্সিলর। পেশায় তিনি ব্যবসায়ী। শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস। বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকা। হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তার নামে স্থাবর-অস্থাবর কোনো সম্পদ নেই। তার নামেও রয়েছে নানা অভিযোগ। আজিমপুর এলাকায় লেগুনাসহ বিভিন্ন পরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বলা হয়, মানিক বর্তমানে যে বাড়িতে বসবাস করেন, ওই বাড়িটি চুক্তিতে একজনের কাছ থেকে নিয়ে আর ফেরত দেননি।

৩০ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. হাসান। অষ্টম শ্রেণি পাস। কোনো মামলা নেই। পেশায় ব্যবসায়ী। তার বার্ষিক আয় ৬ লাখ টাকা আসে ব্যবসা থেকে। তার অস্থাবর সম্পদ আছে মোট ৬৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকার। এর মধ্যে তার হাতে নগদ আছে ২ লাখ টাকা। বাকি টাকা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা। তার স্ত্রীর নামে আছে ৬০ ভরি সোনা। তার কোনো স্থাবর সম্পদ নেই। ঋণও নেই।

১৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী মুন্সী কামরুজ্জামান। বিএসএস পাস। তার নামে মামলা নেই। পেশা ব্যবসা। একমাত্র আয়ের উৎস ব্যবসা। ব্যবসা থেকে তার বার্ষিক আয় ১২ লাখ ১৮ হাজার ৮২০ টাকা। তার অস্থাবর সম্পদ আছে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৭৬৩ টাকার। এর মধ্যে হাতে নগদ আছে ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। তার স্ত্রীর আছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৬৬২ টাকার সম্পদ ও ২৫ ভরি সোনা। স্থাবর সম্পদের মধ্যে কামরুজ্জামানের একটি ফ্ল্যাট আছে। দাম দেখানো হয়নি। পাঁচ বছর আগে তার বার্ষিক আয় ছিল ১৩ লাখ ৮৭ হাজার ৪২৫ টাকা। তার অস্থাবর সম্পদ ছিল সব মিলিয়ে ৫ লাখ ৪৯ হাজার ২০৩ টাকার। নগদ ছিল ৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। তখন তার কোনো ফ্ল্যাট ছিল না।

মামলা বেশি বিএনপির কাউন্সিলরদের : দক্ষিণের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির প্রার্থী মাসুদ চৌধুরী। শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাস। তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। তার পেশা গৃহকর্ম। বার্ষিক আয় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এই প্রার্থীর গাড়ি না থাকলেও একাধিক বাড়ি রয়েছে। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির প্রার্থী মনোয়ার হোসেন মানু। তিনি স্বশিক্ষিত। ডিস ব্যবসার এক প্রতিষ্ঠানের চিফ অ্যাডভাইজার তিনি। চাকরি থেকে তার আয় ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। শাহবাগ থানায় তার নামে মামলা রয়েছে। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থী আশরাফ আলী আজম। মামলা রয়েছে ৪৫টি। এ ছাড়া আটটি থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। বার্ষিক আয় ৩৩ লাখ টাকা। নগদ টাকা রয়েছে ৪৩ লাখ টাকা। ৪০ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে।

অনেক প্রার্থী কোটিপতি : দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী সৈয়দ রফিকুল ইসলাম স্বপন। এসএসসি পাস তিনি। হলফনামায় তিনি রাজনৈতিক মামলা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছেন। ১৫টি মামলার তালিকা তিনি দিয়েছেন। ব্যবসা থেকে তার বার্ষিক আয় ৩ লাখ টাকা। নগদ টাকা রয়েছে ২১ লাখ ৫০ হাজার। ৭ লাখ টাকার ঋণ রয়েছে। এই ওয়ার্ডের আরেক প্রার্থী সাদেকুল ইসলাম। এইচএসসি পাস। তার নামে মামলা নেই। তার বার্ষিক আয় ১ কোটি ১৯ লাখ। নগদ রয়েছে ১০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার। বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার রয়েছে ২ কোটি ২৩ লাখ টাকার। গাড়ি রয়েছে চারটি। ঋণ রয়েছে ৯৪ লাখ টাকার।

সর্বশেষ খবর