বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

৪০০ কোটি টাকার করোনা কিট কিনে ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দাবি

চার প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়ে ‘ঘটনা-উত্তর’ অনুমোদন প্রার্থনা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

৪০০ কোটি টাকার করোনা কিট কিনে ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দাবি

‘কভিড-১৯’ পরিস্থিতি মোকাবিলার কারণ দেখিয়ে চারটি কোম্পানির কাছ থেকে সরকারি অনুমোদন ছাড়াই ৩ লাখ ৭৫ হাজার পিসিআর টেস্ট কিট কিনেছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। এসব কিটের বিল বাবদ ৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকার কার্যাদেশের ওপর এখন ‘ঘটনা-উত্তর’ অনুমোদন প্রার্থনা করছে সংস্থাটি। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন খাতে ৪০০ কোটি টাকা ওষুধসামগ্রী কেনার জন্য বাজেট বরাদ্দ চেয়েছ তারা। এমনকি সে বাজেটের সঙ্গে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে আরও ১০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

গত ৫ জুলাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পৃথক দুটি চিঠিতে ওষুধসামগ্রী কেনার জন্য দাবিকৃত ৪০০ কোটি টাকার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করা হলেও ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ও এডিবির সাবেক বিকল্প নির্বাহী পরিচালক ড. মাহবুব আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার জরুরি ওষুধসামগ্রী কেনার জন্য বাজেট চাইতে পারে, কিন্তু তারা কেন থোক বরাদ্দ চাইল তা আমার বোধগম্য নয়।’ অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক এই সিনিয়র সচিব বলেন, ‘থোক বরাদ্দ দেওয়া হয় সাধারণত জরুরি বা আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায়। হঠাৎ ধেয়ে আসা বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো কোনো দুর্যোগ থেকে দেশের মানুষকে রক্ষায় থোক বরাদ্দের প্রচলন রয়েছে। আবার জাতীয় সংসদ সদস্যরাও থোক বরাদ্দ নিয়ে থাকেন। তবে তাঁরা সেগুলো কীভাবে ব্যবহার করবেন তার নীতিমালা রয়েছে। মন্ত্রণালয়গুলোরও থোক বরাদ্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কর্মপদ্ধতি মেনে চলতে হয়। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়া কোনো ধরনের থোক বরাদ্দ ব্যবহারের সুযোগ নেই।’ সূত্র জানান, কভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলায় গত ২৪ জুন জরুরি ভিত্তিতে ওষুধসামগ্রী কিনতে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের ৩৭৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার প্রস্তাব ওঠে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে। পরে ১ জুলাই সে প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২৭৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকার ক্রয়প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা।

এখন কেন্দ্রীয় ঔষধাগার বলছে, মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়া আরও চারটি প্রতিষ্ঠানকে ৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টেস্ট কিট সরবরাহের কার্যাদেশ দিয়েছে তারা। অননুমোদিত সে কার্যাদেশের বিপরীতেও চিঠিতে অর্থ বরাদ্দের অনুরোধ জানানো হয়েছে। সূত্রগুলো জানান, গত জুনে স্টার্লিং মাল্টি টেকনোলজি লিমিটেডের কাছ থেকে ২৫ হাজার অ্যানাটোলিয়া ব্র্যান্ডের টেস্ট কিট কেনা হয়। প্রতি ইউনিট ২ হাজার ১০০ টাকা হিসেবে মোট ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকার কিট সরবরাহ করে এ প্রতিষ্ঠানটি। মাইশা রাও টেলসেট জেভির কাছ থেকে প্রতি ইউনিট ২ হাজার ৩০০ টাকা দরে বাইওনিয়ার ব্র্যান্ডের ৫০ হাজার টেস্ট কিট সংগ্রহ করা হয় যার মূল্য ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। প্রতি ইউনিট একই দামে জেরিন এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে সানসিওর বাইওটেক ব্র্যান্ডের মোট দেড় লাখ টেস্ট কিট সংগ্রহ করা হয় যার মূল্য ৩৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ওভারসিজ মার্কেটিং কোম্পানির কাছ থেকে সমমূল্যে সমপরিমাণ টেস্ট কিট সংগ্রহ করে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। সূত্রগুলো জানান, এ চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ওষুধ সংগ্রহের লক্ষ্যে কার্যাদেশ দেওয়ার আগে সরকারি পর্যায়ে কোনো ধরনের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি। পরে ৫ জুলাই যখন এসব কেনাকাটার বিপরীতে অর্থ পরিশোধের জন্য বাজেট চাওয়া হয়, তখন এ চারটি প্রতিষ্ঠানের কিট সরবরাহের কার্যাদেশের ওপর ‘ঘটনা-উত্তর’ অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে অনুরোধ জানিয়ে পৃথক চিঠি পাঠায় কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামানের সঙ্গে তার দাফতরিক টেলিফোনে একাধিকবার কল করা হলেও কেউ রিসিভ করেননি। তবে বাজেট বরাদ্দের জন্য যে চিঠি পাঠানো হয়েছে, সেখানে এ চারটি প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। তারা বলেছে, ‘জরুরি ভিত্তিতে উক্ত কার্যাদেশ প্রদান না করা হলে এবং টেস্ট কিটের সরবরাহ পাওয়া না গেলে কিটের সাপ্লাইচেইন ব্যাহত হতো, করোনা পরীক্ষা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হতো, জনগণের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হতো এবং সর্বোপরি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হতো।’ ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আইইডিসিআরের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে অবহিত রেখেই এসব কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আগের বিষয়গুলো নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। স্বাস্থ্য অধিদফতরে নতুন মহাপরিচালক নিয়োগ দেওয়ার পর আমরা একটি কমিটি করে দিয়েছি। সে কমিটির অনুমোদন ছাড়া এখন কেন্দ্রীয় ঔষধাগার কোনো ওষুধ কিনতে পারবে না।’

সিন্ডিকেটমুক্ত হওয়ায় ৯৪ কোটি টাকা সাশ্রয় : সরকারের উদ্যোগের ফলে সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরিয়ে অধিকতর দরকষাকষির মাধ্যমে ওষুধসামগ্রী কেনায় গত কয়েকদিনে শুধু করোনার ওষুধ কিনেই প্রায় ৯৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। বাজেট চাওয়ার জন্য লিখিত একই চিঠিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘সিএমএসডি’র সাম্প্রতিক তৎপরতায় বাজারে গুটিকয় কোম্পানির একচ্ছত্র আধিপত্য ক্ষুণœ হওয়ায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দরকষাকষির কারণে গুণগত মান অটুট রেখেই অধিকাংশ সামগ্রীর মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস করা গেছে। এর ফলে করোনা মোকাবিলায় কেনাকাটার ক্ষেত্রে ৯৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়েছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণকারী আগের মুষ্টিমেয় প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। মালামাল সরবরাহ করা হলেও ঠিক সময়ে বিল পাওয়া যাবে না মর্মে প্রচার করে নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে। তাই আগের অনিষ্পন্ন বিলগুলো জরুরি ভিত্তিতে নিষ্পন্ন করা দরকার। বিলগুলোর বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থ দ্রুত বা যথাসময়ে পরিশোধ করতে পারলে চক্রান্তকারী প্রতিষ্ঠানের চক্রান্ত যেমন নস্যাৎ করা যাবে আবার নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আশ্বস্ত করা যাবে। এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জার্মানভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অধিকতর দরকষাকষি করে যে অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব ৯৪ কোটি টাকা সাশ্রয়ের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে তা-ই প্রমাণ করল কেন্দ্রীয় ঔষধাগার। তবে এর সঙ্গে এও প্রমাণিত হলো যে, আগের কেনাকাটায় সেই দরকষাকষি ও স্বচ্ছতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘যে চরটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনুমোদন ছাড়াই ওষুধসামগ্রী কেনার কার্যাদেশ দেওয়া হলো, সেটি অনুমোদনের আগে খতিয়ে দেখা উচিত ন্যূনতম বাজারদর, প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে কিনা।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘জরুরি প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণœ করা যাবে না। জরুরি ওষুধ কেনার জন্য থোক বরাদ্দ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং মুষ্টিমেয় সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে ইতোপূর্বে যেসব ওষুধসামগ্রী কেনা হয়েছে, সেখানে শুধু অসাধু ব্যবসায়ীরাই লাভবান হয়নি, এর কমিশনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও নিয়েছেন। সুতরাং সেগুলো খতিয়ে দেখে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর