আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট পূর্বাভাস অনুযায়ী হলেও প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। সৎ, উদ্যমী মনোভাবের করারও সুযোগ ছিল। মূল দর্শন যেটা ছিল, সেখানে বড় ধরনের পরিবর্তনের পূর্বাভাস নেই। উন্নয়ন পুরোটাই ঋণনির্ভর। বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা প্রতিফলিত হয়নি বাজেটে। কর্মসংস্থান ও বৈষম্য কমাতে বড় ধরনের দাবি ছিল। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। ঘোষিত ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এসব মতামত দেয় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
রাজধানীর হোটেল লেকশোরে ‘জাতীয় বাজেট ২০২৫-২৬ : সিপিডির পর্যালোচনা’ শীর্ষক অনুষ্ঠান আয়োজন করে সিপিডি। এতে স্বাগত বক্তব্যে বাজেটের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। আলোচনায় অংশ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমসহ প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা দল।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের প্রতিফলন নেই। এটি পূর্বাভাস অনুযায়ী হলেও প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। বাজেটে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সুপারিশ; যেমন ইনোভেশন ল্যাব গঠন, ডিজিটাল জনসেবা বৃদ্ধি এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপের মতো প্রস্তাবগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়নি। শ্রম সংস্কার কমিশন বাজেটসংক্রান্ত দুটি ও রাজস্বসংক্রান্ত ৭৮টি সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে কিছু দীর্ঘমেয়াদি হলেও কিছু সুপারিশ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রতিফলিত হতো। উদাহরণস্বরূপ, একটি সুপারিশ ছিল কর সুবিধার সঙ্গে শ্রম অধিকার সম্মতির যোগসূত্র স্থাপন করা। বর্তমানে তৃতীয় লিঙ্গ ও বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু কর ছাড় রয়েছে। কিন্তু এর বাইরে নতুন কোনো ব্যবস্থা বাজেটে নেই। শ্রম অধিকার পর্যবেক্ষণে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। যদিও শ্রম পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তর এবং মজুরি বোর্ডের বরাদ্দ কিছুটা বেড়েছে, বাস্তব পরিমাপে তা উল্লেখযোগ্য নয়। তিনি বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজড করতে হবে, যদিও সেটা খুবই দুরূহ বিষয়। রেমিট্যান্স প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার কমায় প্রবাসী আয় বেড়েছে। আগামী অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে, যেখানে চলতি অর্থবছর রয়েছে ২০ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ছিল ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ। সরকারের আয় এবং ব্যয়ের হিসাবে দেখা যায় ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন ব্যয় পুরোটাই ঋণনির্ভর। বাজেটের মূল দর্শন হওয়া উচিত ছিল রাজস্ব নীতির মাধ্যমে আয় বৈষম্য হ্রাস।
প্রস্তাবিত বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট কেনায় কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ অব্যাহত রাখার উদ্যোগ সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে বলে মন্তব্য করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, এ বিষয়টি জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ঘটনায় বৈষম্য বাড়বে। এটা নৈতিকতার ওপর আঘাত। এভাবে আবাসন খাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলে আবাসনের দাম বেড়ে যায়। আবাসন অনেকের নাগালের বাইরে চলে যায়। তিনি বলেন, সব সময় রাজস্ব আদায় একই ধারায় রয়েছে। এবারও উচ্চ আকাঙ্ক্ষার রাজস্ব আহরণ বাজেটের বড় চিন্তার বিষয়। গত ১০ বছর ধরেই আমরা দেখছি, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না। এটা পূরণ করতে হলে ‘বড় ধরনের’ সংস্কার কার্যক্রম লাগবে। গত তিন বছর থেকে মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ হারে খেলাপি ঋণের কারণে অর্থনীতি একটি চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনা এবং মূল্যস্ফীতি কমানোই আগামী বাজেটের মূল্য লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটে সেই পদক্ষেপ ও কৌশল বিস্তারিত থাকা দরকার। সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের সংকট মোকাবিলায় এসব সংকট আমলে নেওয়া দরকার ছিল।