ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বিতসেলেম অবশেষে গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধকে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০২৫ সালের ২৭ জুলাই প্রকাশিত এই বিস্তারিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য, পরিকল্পিতভাবে বেসামরিক জীবন ধ্বংস এবং সরকার-পরিচালিত দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির চিত্র।
তবে এত গুরুত্বপূর্ণ এক অভিযোগ আনতে সংস্থাটির প্রায় দুই বছর সময় নেওয়া নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের দেরি শুধু দুঃখজনক নয় বরং এটি এমন এক রাজনীতি-প্রভাবিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের নমুনা, যা ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধকে টিকিয়ে রাখতে অবদান রেখেছে।
প্রতিবেদনের তাৎপর্য দ্বিগুণ এই কারণে যে, এটি কোনো বিদেশি সংগঠন নয় বরং ইসরায়েলি একটি মানবাধিকার সংস্থার নিজ দেশের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ।
বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে এই প্রতিবেদন নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা গেলেও প্রশ্ন রয়ে গেছে। ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের বা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বারবারের সতর্কতা ও প্রতিবেদন এতদিন ধরে কেন উপেক্ষিত হলো? গাজার ভিতর থেকে বারবার গণহত্যা, শিশুহত্যা, পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষের খবর এলেও পশ্চিমা গণমাধ্যম ও একাডেমিক মহল তেমন মনোযোগ দেয়নি।
১৯৪৮ সালের তানতুরার হত্যাকাণ্ড, ১৯৮২ সালে লেবাননের সাবরা ও শাতিলায় গণহত্যা, কিংবা ২০০২ সালের জেনিনের ঘটনাও প্রথমে ফিলিস্তিনি ভাষ্যে অস্বীকৃত ছিল। বহু সময় পরে, কোনও ইসরায়েলি বা পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান তা ‘স্বীকার’ করলেই কেবল আন্তর্জাতিক গুরুত্ব পায়।
প্রশ্ন উঠছে—বিতসেলেমের এই স্বীকৃতি পেতে এত দেরি হলো কেন? ইসরায়েলি সংস্থাগুলোর রয়েছে হিব্রু ভাষা ও সামরিক তথ্যের বিশেষ প্রবেশাধিকার। ফলে গণহত্যার মতো বিষয় নির্ধারণে তাদের দেরি হওয়ার কথা নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন ইচ্ছাকৃত দেরিই আন্তর্জাতিক মহলের ‘নৈতিক দ্বিধা’র অংশ, যা গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
২০২৪ সালের ২৬ জানুয়ারি, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) দক্ষিণ আফ্রিকার করা অভিযোগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার ‘প্রাথমিক সম্ভাবনা’ মেনে নিলেও এখনো পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো রায় দেয়নি। বরং আদালত ইসরায়েলকেই নিজেকে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছে—একটি কার্যত অবাস্তব প্রত্যাশা, যখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেই গাজা ‘পরিষ্কারের’ ঘোষণা দিয়েছেন।
একইভাবে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গত বছর নভেম্বরে নেতানিয়াহু এবং তার তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও আজও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টোভাবে, মামলার প্রধান কৌঁসুলি করিম খান এখন মার্কিন প্রশাসন ও মিডিয়ার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।
যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসওম্যান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ কিংবা সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স—যারা ‘বিপ্লবী রাজনীতি’র প্রতীক হিসেবে পরিচিত তারা পর্যন্ত গণহত্যা শব্দটি ব্যবহারে দ্বিধায় ছিলেন। মার্চ ২০২৪-এ কর্তেজ বলেছিলেন, গণহত্যা চলছে বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু আমি এখনো শব্দটি ব্যবহার করতে প্রস্তুত নই।
স্যান্ডার্স আরও এগিয়ে গিয়ে আইরল্যান্ডে এক বক্তব্যে বলেন, গণহত্যা শব্দটি আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে। এমন ‘নৈতিক দ্বিধা’ আর ‘ভদ্র রাজনীতি’ হাজারো প্রাণহানির বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে গেছে।
এটি শুধু নৈতিক ব্যর্থতা নয় বরং এই ধরণের দেরি ও দ্বিধাই ইসরায়েলকে বিনাশয়ী যুদ্ধে উৎসাহিত করেছে। আন্তর্জাতিক আদালত, মানবাধিকার সংস্থা, রাজনীতি ও গণমাধ্যম যদি সময়মতো সঠিক অবস্থান নিত, তাহলে বহু প্রাণ বাঁচানো যেত।
ফিলিস্তিনিদের কষ্ট, অভিজ্ঞতা, ও সত্যকে ইসরায়েলি বা পশ্চিমা অনুমোদনের অপেক্ষায় বসে থাকলে চলবে না। তাদের কণ্ঠই যেন মূল সত্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানজনক হয়—এটাই বর্তমান সময়ের ন্যূনতম নৈতিক দাবি।
যারা এতদিন ‘অপেক্ষা’ করে থাকলেন, তারা ইতিহাসের আদালতে যেমন অভিযুক্ত হবেন, তেমনি গাজার অসহায় মা-বাবার আর্তনাদও তাদের ক্ষমা করবে না। যারা শেষ পর্যন্ত নিজের সন্তানকেও রক্ষা করতে পারলেন না বিশ্বের নিরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে।
এই প্রতিবেদন আমাদের জন্য একটি কঠিন আয়নার মতো। যেখানে আমরা নিজের বিবেক ও ভূমিকা দেখছি। সময় এসেছে, নিরবতা ভেঙে ফেলার। এখনো দেরি হয়নি—কিন্তু সময় ফুরিয়ে আসছে।
সূত্র: মিডলইস্ট মনিটর
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল