শান্তির সমাজ বিনির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেই অপরাধ দমনে ইসলামের অবস্থান কঠোরতম : ‘আল্লাহর বিধান কার্যকরকরণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের প্রভাবিত না করে, তোমরা যদি আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাসী হও।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ২)
খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনামলে হত্যাকাণ্ডের অপরাধে বেদুইন যুবকের মৃত্যুদণ্ড হয়। যুবক জামিন প্রার্থনা করে। জামিনদার হলেন সাহাবি আবুজর গিফারি (রা.)। শর্ত হলো, যুবক না ফিরলে মৃত্যুদণ্ড হবে সাহাবির!
ঘটনাক্রমে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা। মদিনায় থমথমে অবস্থা। নিষ্পাপ সাহাবি বিনা দোষে দণ্ডিত হবেন! জল্লাদ প্রস্তুত!
যুবকের ফিরে আসা দেখে সবাই হতবাক! খলিফা বলেন, ‘তুমি জানো তোমার মৃত্যুদণ্ড; তার পরও ফিরে এলে?’ যুবক বলল, ‘আমি ফিরে এসেছি, কেউ যাতে বলতে না পারে, এক মুসলমানের বিপদে আরেক মুসলমান সাহায্য করতে গিয়ে নিজেই বিপদে পড়ল...!’
এটাই ইসলামের শাশ্বত সাধুতা। বর্তমানকালে অপরাধী অনুতপ্ত হয় না। ধরা দেয় না স্বেচ্ছায়, বরং ছলচাতুরী করে। অথচ দুর্নীতির ছদ্মাবরণে সম্পদের পাহাড় গড়াদের জীবন গড়ায় সরকারি মেহমানদারির জেলখানায়!
পাপ-পতনের মাধ্যম দুর্নীতি জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে যথেষ্ট। এতে পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা লঙ্ঘিত হয়—‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না...।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২০)
দুর্নীতিবাজরা বাঁচার জন্য ছদ্মবেশ ধরে। ইসলামে ছদ্মবেশী হওয়া, রূপ বিকৃতির অনুমোদন নেই। সুরা বাকারার ৪২ নম্বর আয়াতের নির্দেশনা হলো—‘তোমরা সত্যকে মিথ্যার সঙ্গে মিশিয়ো না এবং জেনে-বুঝে সত্য গোপন কোরো না।’
মহান আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন করা প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের বাণী—‘শয়তান বলল, আমি অবশ্যই তোমার বান্দাদের পথভ্রষ্ট করব, তাদের আল্লাহর সৃষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করতে আদেশ করব...।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১১৯)
ইসলামের দৃষ্টিতে সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ও অসৎ পন্থাবলম্বন কবিরা গুনাহ। এটা মুনাফিকির লক্ষণ এবং ধ্বংসই হলো অসত্যের চূড়ান্ত পরিণতি। ইসলামের সমাজ বাস্তবতায় অপরাধী অনুতপ্ত হয়ে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে শাস্তির আওতায় নিজেকে সমর্পণ করে ধর্মভীরুতায় ও পারলৌকিক মুক্তি প্রত্যাশায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ মার্জনা করেন...।’ (সুরা : জুমার, আয়াত : ৫৩)
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তান দোষত্রুটিপূর্ণ ও অপরাধী, আর অপরাধীর মধ্যে ওই সব লোক উত্তম, যারা তাওবা করে।’ (তিরমিজি)
এ জন্যই ইসলামে উদাহরণ আছে—
তাবুকের যুদ্ধের সময় তিনজন সাহাবির অনিচ্ছাকৃত ও সাময়িক ভুলের আত্মগ্লানির প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয় সুরা তাওবার কয়েকটি আয়াত।
বুখারি শরিফে আছে—‘এক ব্যক্তি ১০০টি খুন করেছিল। খুনি তারপর আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হয়। তাই আল্লাহ ওই জঘন্য অপরাধীকেও ক্ষমা করেন।’
বুখারি শরিফের অন্য বর্ণনায় আছে—‘মাইজ আসলামি (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সমীপে উপস্থিত হয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! নিশ্চয়ই আমি আমার আত্মার ওপর জুলুম করেছি...আমি চাই আপনি আমাকে পবিত্র করবেন।’
মুসলিম শরিফে আছে, গামিদি গোত্রের এক অনুতপ্ত নারী মহান আল্লাহর শাস্তি তার ওপর কার্যকরকরণের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সমীপে ফিরে ফিরে এসেছেন।
পরিশেষে অপরাধের যথাযথ বিচার এবং অপরাধীর আত্মগ্লানি না হলে সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করা যাবে না। (লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান-ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ,কাপাসিয়া, গাজীপুর)