রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

কেন বজ্রপাতে এত মৃত্যু

মারা গেছে আরও ছয়জন, আগস্টেই মৃত্যু ২২৮ জনের

জিন্নাতুন নূর

কেন বজ্রপাতে এত মৃত্যু

বজ্রপাতের কারণে বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ বজ্রপাতের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি এবং এই প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের প্রাণহানির সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। হিসাব বলছে, বাংলাদেশে সপ্তাহে গড়ে চারজন মানুষ বজ্রপাতে মারা যাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা জানান, বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি, অতিরিক্ত তাপমাত্রা, মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ফোনের ব্যবহার এবং এর রেডিয়েশন, গ্রামে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক টাওয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি, উঁচু বৃক্ষের সংখ্যা কমে যাওয়া এবং জলাভূমি ভরাটের কারণে বজ্রপাতের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের শুধু আগস্ট মাসেই বজ্রপাতে ২২৮ জনের মৃত্যু হয় (সূত্র : সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস  ফোরাম)। ৮ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় বজ্রপাতে ১০ জনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া গতকাল বজ্রপাতে খুলনার ডুমুরিয়া ও পাইকগাছায় দুই ভাইসহ তিনজন এবং মুন্সীগঞ্জে দুই খালাতো ভাই বোন ও মামাসহ তিন শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্যে, ২০১১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বজ্রপাতে দেশে ২ হাজার ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়। এই হিসাবে সপ্তাহে বজ্রপাতে গড়ে চারজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যে, ২০১০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৩ হাজার ২৭৩ জন মানুষ বজ্রপাতে নিহত হন। এর মধ্যে ২০২১ সালেই বজ্রপাতে মারা যান ৩৬৩ জন। দেশের নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ এবং সিলেটসহ বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রামাঞ্চলে খোলা স্থানে বজ্র নিরোধক স্থাপনা ও উঁচু গাছের অভাবে প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটছে। সাধারণত গ্রামে বড় বড় গাছ বজ্র প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বসতবাড়ি নির্মাণ ও কৃষিকাজের জন্য গাছ কেটে ফেলায় বজ্রপাতে প্রাণহানি আগের চেয়ে বেশি ঘটছে। সাধারণত এপ্রিল-মে এই সময়ে গ্রামাঞ্চলে কৃষকরা ধান কাটায় ব্যস্ত থাকেন। এর ফলে তাদের বজ্রপাতে দুর্ঘটনায় পড়তে বেশি দেখা যায়। তারা আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বজ্রপাত আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত দেশে বর্ষা এবং বর্ষা মৌসুমের আগে পরে বজ্রপাত বেশি হয়। কিন্তু বদলে যাওয়া আবহাওয়ার কারণে এখন এ সময়ের বাইরেও বজ্রপাতের ঘটনা ঘটছে। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধিও এর অন্যতম কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। গবেষণা বলছে, ১৯৮৪ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের তাপমাত্রা গড়ে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে এ সময়ের মধ্যে রংপুরে বজ্রপাতের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাতে মানুষের হতাহতের শঙ্কা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তথ্য বলছে, বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করছে জেলে ও কৃষকরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কয়েক বছর ধরেই বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ এখন খোলা মাঠে অনেক বেশি কৃষিকাজে জড়িত। আবার আগের তুলনায় মৎস্য চাষও বেশি হচ্ছে। এই দুই পেশায় জড়িতরা খোলা স্থানে থাকেন। এ জন্য বজ্রপাতে এদের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এপ্রিলের শুরু থেকেই এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার। এ বিষয়গুলো পাঠ্যবইতে রাখতে হবে। হাওর এলাকাগুলোতে বজ্রপাত থেকে রক্ষার জন্য আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে। একই সঙ্গে বজ্রপাতে চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ততটা জানেন না। এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। আবার বজ্রপাতের শিকার ব্যক্তিদের সরকারি অর্থ সহায়তার পরিমাণ খুব কম। এটি বৃদ্ধি করা উচিত। 

 

বিশেষজ্ঞরা জানান, আগে শহর-গ্রামে যে সংখ্যায় উঁচু গাছ ছিল তা এখন কমে এসেছে। এ জন্য বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেঘের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। যখনই মাথার ওপর গভীর কালো মেঘ দেখা যাবে তখনই বুঝতে হবে যে এখানে বজ্রপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। আর খোলা জায়গায় কোথাও আশ্রয় না থাকলে নিজেকে গুটিয়ে বসতে হবে। একইভাবে হাওর বা নদীতে বসে থাকলেও গুটিয়ে বসতে হবে। মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে কৃষকদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। অনেকেই বুঝতে পারেন না যে, বজ্রপাতের সময় কী করবেন। এ জন্য এ বিষয়ে যত বেশি প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে ততই ক্ষতির পরিমাণ কমবে।

বজ্রবৃষ্টি শুরু হলে তা ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সময়ে মানুষকে ঘরে অবস্থান করতে হবে। অতি জরুরি প্রয়োজনে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে বলেছেন। টিনের চালা এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। উঁচু গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ও তার, ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকতে হবে। এ ছাড়া বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টিভি ও ফ্রিজ ব্যবহার থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। বজ্রপাতের সময় শিশুদের খোলা মাঠে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখতে হবে। প্রতিটি বিল্ডিংয়ে বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন নিশ্চিত করতে বলেছেন।

সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রাশিম মোল্লা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে যদি বজ্র নিরোধক দণ্ড স্থাপন করা যায় তাহলে কিছুটা উপকার হবে। কিন্তু শুধু ছাউনি বানিয়ে কোনো লাভ হবে না। দেশে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি কৃষকরা মারা যাচ্ছেন। সাধারণত কৃষকরা গরমে কৃষিকাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তারা বৃষ্টির সময় কাজ করতে আগ্রহী। বৃষ্টি শুরু হলে কৃষকদের অনেকে গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ান কিন্তু এতে প্রাণহানির ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। এ জন্য দেশের হাওরাঞ্চলে কৃষকদের জন্য বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপন করা জরুরি। আমরা দেশীয় প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এ স্থাপনা তৈরি করতে পারি। 

সরকারি উদ্যোগ : সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বজ্রপাত থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে বেশ কিছু প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকাতে গ্রহণ করা হয়েছে ‘তালগাছ প্রকল্প’। যা কার্যত ফলপ্রসূ হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর, মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার সহযোগিতায় বজ্রপাত সম্পর্কে আগাম তথ্য পেতে ‘হাই ইমপেক্ট ওয়েদার এসেসমেন্ট’ নামে একটি প্রযুক্তি চালু করেছে। এই টুলিকিটের মাধ্যমে ৫৪ ঘণ্টা আগেই বজ্রপাত সম্পর্কে আগাম তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানা যায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষক ও জেলেদের কাছে এ ধরনের প্রযুক্তি সহজলভ্য না হওয়ায় এটি খুব বেশি কাজে লাগবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বজ্রপাত থেকে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সরকার ‘হাওর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ নামে নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। মূলত দেশের হাওর এলাকার যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল সেখানে বজ্রপাতের ধরন দেখা হবে। এসব এলাকায় ঘরবাড়ি না থাকায় কেউ বজ্রপাতের সময় আশ্রয় নিতে পারে না। এ জন্য ঝুঁকি বেশি থাকার কারণে এই হাওর এলাকা ঘিরেই সরকার প্রথম প্রকল্প নিতে যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ভৈরবে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এসব এলাকায় কিছু স্থাপনা গড়ে তোলা হবে। সেখানে কিছু বজ্রপাত প্রতিরোধক দণ্ড স্থাপন করা হবে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ যেখানে মাঠের বিস্তৃতি বেশি এবং আশ্রয় নেওয়ার স্থান নেই সেসব এলাকায় আরও কিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।

বড় গাছ কমে যাওয়ায় বেড়েছে মৃত্যু : ড. কবিরুল বাশার

বায়ুদূষণের কারণে বজ্রপাত বাড়ছে : ড. গোলাম মোহাম্মদ

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর